৩১ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৩৬

চলমান পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন

# নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন
# বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি গণতান্ত্রিক নয়
# লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড হয়নি
# বিরোধী দল মামলার জালে বন্দী
# মাঠে গণতান্ত্রিক তৎপরতার সুযোগ নেই
# নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়ে প্রশ্ন
# নির্বাচন কারচুপির শত পথ খোলা

চলতি বছর ডিসেম্বরের শেষাংশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। দীর্ঘ সময় বাকি থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো এনিয়ে এখনই সাজ সাজ রব তুলেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বলতে গেলে একতরফা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যেতে শুরু করেছে। অন্যদিকে বিরোধী জোট এই সময়ে ব্যস্ত মামলা আর কারাগার নিয়ে। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্ক ও প্রশ্ন জনমনে সৃষ্টি হয়েছে। এনিয়ে আইনগত ও নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছে।

দেখা যাচ্ছে, সংবিধানে চলমান জাতীয় সংসদ, দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা এবং বর্তমান এমপি পদ বহাল রেখেই ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে সরকার। আর নির্বাচনের প্রাক্কালে কোনপ্রকার ‘সহায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোন নিশ্চয়তা আদৌ না থাকায় নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নতুন বছরকে ‘নির্বাচনী’ বছর বিবেচনা করে রাজনীতির মাঠে নানা প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তবে সরকারি মহল তাদের বিরোধীজোটকে আদালতের বারান্দায় আটকে রেখেই নির্বাচন পার করার কৌশল নিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। এই কৌশলেরই অংশ হিসেবে অসংখ্য মামলায় জড়িয়ে রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের মূল নেতাদের। সারা দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে নৌকায় ভোট চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। সমানে ব্যক্তি ও নির্বাচনী প্রতীকের নামে চলছে ব্যানার, সম্ভাব্য প্রার্থীর ছবিসহ রঙিন পোস্টার, দেয়াল লিখন প্রভৃতি মাধ্যমে জোরদার প্রচার-প্রচারণা। আগামী কয়েক মাস পর অনুষ্ঠিতব্য কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে মহানগরীগুলোতে এই প্রচারণা এখনই তুঙ্গে তুলে দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। যা নির্বাচনী আইন-বিধি ও নৈতিকতার চরম লঙ্ঘন। কিন্তু এসব নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি)’র কোন নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে না।

নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্ন
সংবিধানে চলমান জাতীয় সংসদ, দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা এবং বর্তমান এমপি পদ বহাল রেখেই ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে সরকার। আর নির্বাচনের প্রাক্কালে কোনপ্রকার ‘সহায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোন নিশ্চয়তা আদৌ না থাকায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকারের এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত জানুয়ারিতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে। এসময় তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষদিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর সে নির্বাচন ‘সংবিধান অনুসারেই’ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সংবিধান মেনে, অর্থাৎ তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই চলতি বছর শেষে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে। প্রধানমন্ত্রী জানান, ২০১৩ সালের মতই নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ সম্পর্কে সংবিধানে কোনপ্রকারের বিধানই নেই। ফলে তিনি সংবিধানেরই রেফারেন্স দিয়ে কীসের ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়ার কথা বললেন তা বিশ্লেষকদের বোধগম্য হয়নি। তাহলে তাঁর কথার কি এই অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে, বর্তমান দলীয় সরকার অর্থাৎ মহাজোট সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়ার বিষয়েও কোন নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়নি।
সংবিধানের বিধান যা বলে
বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা বাতিলের পর যে সংশোধনী সংযোজিত হয়েছে তাতে বিদ্যমান সংসদ ও মন্ত্রিসভা পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ ও মন্ত্রিসভা দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত বহাল থাকবে। যদি রাষ্ট্রপতি পূর্বেই তা ভেঙে না দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ আসন্ন যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে তাতে চলমান জাতীয় সংসদ, দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা এবং বর্তমান এমপিগণের পদ বহাল থাকছেই। এবিষয়ে সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।’ আর ৫৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ ভাংগিয়া যাওয়া অবস্থায় যেকোন সময়ে কোন মন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের (১) দফার (ক), (খ) ও (ঘ) উপ-দফার কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে; তবে এই পরিচ্ছেদের বিধানাবলী-সাপেক্ষে তাঁহাদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাঁহারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকিবেন।’
এছাড়া সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে। তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’
প্রধানমন্ত্রী ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে’ বলে তাঁর যে নীতিনির্ধারণী বক্তব্য দিয়েছেন তাতে মনে হতে পারে যে, সংবিধানে সে ব্যবস্থা হয়তো বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু ভাষ্যকাররা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণের পর সংবিধান খুঁজে কোথাও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে কোন অনুচ্ছেদ বা উপ-অনুচ্ছেদ পাওয়া যায়নি। কীভাবে কোন সূত্রে প্রধানমন্ত্রী এই কথা বললেন সে কথাও পরিষ্কার হয়নি। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠন ব্যতীত কোন বিকল্পও দেখা যাচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর সর্বসাম্প্রতিক ভাষণে ২০১৩ সালের মতই নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন। তাঁর এই ঘোষণা মোতাবেক সম্ভাব্য যেটুকু করা হতে পারে তা হলো, এই নির্বাচনকালীন সময়ে জাতীয় সংসদ বহাল থাকলেও অধিবেশন বসবে না। মন্ত্রিসভা থাকবে, তবে কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে না। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের সময় যে অভিজ্ঞতা জাতি অর্জন করেছে তাতে এধরনের নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের অতি উৎকট রূপেরই প্রকাশ ঘটেছে।
এটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নয়
রাজনৈতিক মহলের অভিযোগ, মহাজোটের শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে সংবিধানকে ইচ্ছেমত কাটাছেঁড়া করার পর এখন এই সংবিধানের দোহাই দেয়া হচ্ছে। অথচ সরকার যদি নিজেদের সুবিধার পথ সুগম রাখার জন্য সংবিধানে ব্যাপক রদবদল ঘটাতে পারে তাহলে বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে সামান্য পরিবর্তন মেনে নিতেই পারে। এদিকে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন ঘটলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের নিজ নিজ পদে বহাল রেখেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ বর্তমান সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের আসন শূন্য ঘোষণা না করেই বর্তমান সংবিধানের বিধান অনুযায়ী তিনশ’ আসনে নির্বাচন করতে হবে। আর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিন আগে। নতুন সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা আগের সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বও নিতে পারবেন না। এমতাবস্থায় নির্বাচনের তফশীল ঘোষণা এবং তার পরেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীগণ, প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীগণ স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন, আইন প্রয়োগ করবেন, পুলিশ-র্যা বকে হুকুম দেবেন, প্রশাসনে রদবদল করবেন, সমগ্র প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবেন, উন্নয়ন কাজে অর্থ বরাদ্দ করবেন এবং সেগুলোর উদ্বোধন করবেন, ত্রাণ বিতরণ করবেন ইত্যাদি। প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কাজের অসিলায় তাঁরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাবেন, বক্তব্য দেবেন, মিডিয়ায় প্রচারের অগ্রাধিকার পাবেন। এসব কাজ নিশ্চয়ই সামগ্রিক নির্বাচনী আবহ ও পরিবেশকে প্রভাবিত করবে। সংবিধানের বিধানের জোরেই তাঁরা এসব কাজ অব্যাহত রাখবেন। অন্যকোন বিষয়ই তাঁদেরকে এ থেকে বিরত রাখতে পারবে না।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতের সংবিধানে অনির্বাচিত ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ভারতের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পর। যে কারণে সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, রাষ্ট্রপতি তখন প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার অনুরোধ জানান। তবে ওই সরকার দৈনন্দিন কাজ ছাড়া নীতি-নির্ধারণীমূলক কোন কাজে অংশ নেয় না। এটা মূলত কেয়ারটেকার সরকারই। এছাড়া নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত সকল সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের অধীন থাকে। এই সরকারকে ভারতের আদলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলারও কোন সুযোগ নেই। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে একটি কেয়ারটেকার কিংবা অন্তর্বর্তী অথবা অস্থায়ী সরকার। কিন্তু বাংলাদেশের মহাজোট সরকার জাতীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছে ¯্রফে একটি দলীয় সরকারের অধীনে। এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের কোন মিল পাওয়া যাবে না।
লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড-এর প্রশ্ন
জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলো একটি দেশের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সব বৈধ রাজনৈতিক দল ও সকল বৈধ ভোটার তথা নাগরিক অবাধে এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারেন। এজন্য প্রয়োজন লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড তথা সমতল নির্বাচনী মাঠের। এটি নিছক কোন শ্লোগান নয়- একটি অপরিহার্য বিষয়। পর্যবেক্ষরা বলে আসছেন, সংসদ বহাল থাকলে এবং এমপি পদ অব্যাহত থাকলে তা হবে নির্বাচনী মাঠের জন্য এক অসম অবস্থা। একজন নির্বাচিত ব্যক্তি হিসেবে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী মাঠে থাকবেন এবং অন্য প্রার্থীরা তার বিপরীত অবস্থানে থেকে নির্বাচন করবেন। এতে কী করে নির্বাচনী মাঠ সমতল হবে- সে প্রশ্নও উঠছে।
সংবিধান ও প্রচলিত রীতি অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রপতি তাকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন যিনি বিদ্যমান সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন হন। কিন্তু সংসদ ভেঙে গেলে তো প্রধানমন্ত্রী আর সেই সংসদের আস্থাভাজন থাকার প্রশ্ন আসে না। এছাড়া যে সকল মন্ত্রী নির্বাচনকালে বহাল থাকবেন সংসদ কার্যকর না থাকার কারণে তারাও আর নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন না। ফলে ‘নির্বাচিত’ সরকারের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ধারণারও কোন যুক্তি নেই। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ যেহেতু সংবিধানেই বিদ্যমান রয়েছে ফলে তা কার্যকর করতেও কোন সমস্যা দেখা যাচ্ছে না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়ররা পদত্যাগ করেই নির্বাচন করেন। তাহলে সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমস্যা কেন হবে- সে প্রশ্ন তুলছেন রাজনীতির বিশ্লেষকরা।
বিরোধীজোট কোর্টের বারান্দায়
নতুন বছরকে ‘নির্বাচনী’ বছর বিবেচনা করে রাজনীতির মাঠে নানা প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তবে সরকারি মহল তাদের বিরোধীজোটকে আদালতের বারান্দায় আটকে রেখেই নির্বাচন পার করার কৌশল নিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। এই কৌশলেরই অংশ হিসেবে অসংখ্য মামলায় জড়িয়ে রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের মূল নেতাদের।

নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকলেও প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনের আগাম প্রচার-প্রচারণা মাঠে গড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন সাংগঠনিক ও নির্বাচনী তৎপরতা জোরদার করছে তখন বিএনপিজোটের নেতাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে আদালতে। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শুধু রাজধানীর বকশীবাজারের অস্থায়ী আদালতেই বিচারাধীন রয়েছে ১৬টি মামলা। এরমধ্যে একটি মামলা একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চলতি মাসেই এ মামলার কার্যক্রম শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। সপ্তাহের ৩-৪ দিন খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজিরা দিয়ে সময় কাটাতে হচ্ছে। তার সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও হাজির থাকছেন আদালতে। সামনের দিনগুলোতে এ হাজিরার সংখ্যা আরো বাড়তে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিস্থিতি না বদলালে কোর্ট-কাছারিতেই চলতি বছর কাটাতে হবে বিএনপি নেত্রীকে। দলটির প্রায় সব নেতারই একই অবস্থা। সরকারের পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতিকে ‘আইনের নিজস্ব গতি’ বলে প্রচার চালানো হলেও এটা যে সরকারি কৌশলেরই একটা অংশ এব্যাপারে নিশ্চিত রাজনৈতিক মহল।
বিরোধীজোটের আইনজীবীদের অভিযোগ, মামলা-কৌশলেরই অংশ হয়ে ইতোমধ্যে বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমানের একটি মামলায় হাইকোর্টে সাজা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার কার্যক্রমও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে অবস্থান করা তারেক রহমান এসব মামলায় পূর্ণাঙ্গ আইনি লড়াইয়েরও সুযোগ পাচ্ছেন না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেও রয়েছে প্রায় একশ’ মামলা। তাকেও ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে আদালতপাড়ায়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে একাধিক মামলা। এসব মামলায় তাদেরকেও প্রতিনিয়ত হাজিরা দিতে হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্রই একই চিত্র। সাবেক এমপিদের কেউ কেউ এরইমধ্যে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ‘সরকার চায় না বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক। এ কারণে এসব মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। সরকার বিরোধীশক্তিকে নির্মূল করতে চায়। এ জন্যই এসব করা হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে তাকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।’ নেতাদের মতে, ‘বর্তমান পরিবেশে নির্বাচনী প্রচারণা দূরের কথা, তাদেরকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কার্যক্রমই পরিচালনা করতে দেয়া হচ্ছে না।’

মামলা-কৌশল প্রয়োগ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধীদের রাজনৈতিক ময়দান থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সবরকম কৌশল-অপকৌশল প্রয়োগ করে আসছে। সেই থেকে এযাবত দেশের সর্বত্র বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা, মামলা, গুম, খুন প্রভৃতি দমনমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে। বিশেষ করে একেকজন নেতা-কর্মীকে কাবু করার জন্য মামলা দায়ের করাকে এক ‘মোক্ষম’ হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দেয়া শুরু হয়। সারা দেশে কেবল কথিত নাশকতার অভিযোগেই জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। আসামী করা হয়েছে জোটের প্রায় সাড়ে চার লাখ নেতা-কর্মীকে।
গত কয়েক বছরের চিত্রে দেখা যায়, বিরোধী জোটের প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয়, জেলা ও তৃণমূল পর্যায়ের এমন নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যাদের নামে মামলা নেই। প্রতিদিনই কোন না নেতা গ্রেফতার হয়ে চলেছেন। দৌড়ের ওপর আর আত্মগোপনের মধ্যে থাকতে হচ্ছে তাদের। আর এটাই সরকারের কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল দু’টিকে ধ্বংস করার জন্য নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হয়ে দায়েরকৃত মামলাগুলো এখন যেনতেন বিচারকার্য সমাধা করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ নেতৃবৃন্দকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের নির্বাচনের অযোগ্য করানোর আয়োজন চলছে- এমন অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। আদালতে লড়াইরত আইনজীবী, ভুক্তভোগী বিএনপি-জামায়াত নেতৃবৃন্দ প্রমুখদের ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকার চাচ্ছে মামলার খড়গ ও শাস্তি দিয়ে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে। তারা জানান, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা থাকার কারণে তারা প্রতিনিয়ত পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মামলায় জামিন নিতে গিয়ে তারা গলদঘর্ম হচ্ছেন। কোনো কোনো নেতাকে সপ্তাহে অন্তত চার দিন আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মামলা ছাড়াও পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হুমকি-ধমকিতে তারা দিশেহারা। রাজনৈতিক সূত্রগুলো থেকে বলা হচ্ছে, নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত অর্ধলক্ষ মামলা আছে এবং দিন দিন এ মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এসব মামলায় লাখ লাখ নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ, নাশকতা ও মানহানির অভিযোগে প্রায় ৩৪টি মামলা রয়েছে। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ শতাধিক মামলা রয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে নাশকতা ও মানহানির অভিযোগে প্রায় ১শ’ মামলা, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৭৮টি, বিএনপি নেতা ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে ২২টি, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ৭০ থেকে ৭৫টি, হাবিব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ১১০টি, যুবদল নেতা সাইফুল ইসলাম নিরবের বিরুদ্ধে সর্বাধিক ১৪৩টি মামলা রয়েছে। অনেক জামায়াত নেতা-কর্মীর একেকজনের বিরুদ্ধেও বহুসংখ্যক মামলা বিদ্যমান। বর্তমানে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা আছে। এসব মামলার আসামী সাত লক্ষাধিক। অন্যতম বৃহৎ বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যাই প্রায় ২৬ হাজার। এগুলোর মোট আসামী প্রায় ৫ লাখ। এই বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীকে আদালতের বারান্দায় আটকে রেখে সরকারদলীয়রা অবাধে নির্বাচনী কর্মকা-ে নিয়োজিত থাকতে পারবে বলে তারা আশা করছে। এদিকে গ্রেফতারের পর জামিন পাওয়া মাত্রই জেলগেট থেকে পুনরায় গ্রেফতার যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এর ফলে আদালতের আদেশ-নির্দেশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। একজন বিশিষ্ট নাগরিক জানান, আদালতের নির্দেশে যারা মুক্তি পায় তাদের আবার নতুন করে কোনো মামলায় গ্রেফতার দেখানো বা পুনরায় গ্রেফতার করা আদালতের প্রতি অসম্মান দেখানো। এটা আইনের শাসনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ- যা মানুষের অধিকার ক্ষুণœ করে। অপর একজন শিক্ষাবিদ বলেন, ঢালাওভাবে প্রতিপক্ষের রাজনীতিকদের এই প্রক্রিয়ায় হয়রানি গণতন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক চর্চাই কেবল দেশকে স্থিতিশীল করতে পারে।

রাজনৈতিক কার্যালয় বন্ধ
দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনী পরিস্থিতি তৈরির জন্য মুক্ত রাজনৈতিক কার্যক্রমের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যালয় কোন কারণ ছাড়াই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরীর কার্যালয়। বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন মহানগরসহ সারা দেশের কার্যালয়গুলো। জামায়াতে ইসলামীর কোনো অফিসেই কার্যক্রম চালাতে পারছে না দলের নেতা-কর্মীরা। একটি বৈধ রাজনৈতিক দলকে প্রকাশ্য সভা সমাবেশও করতে দিচ্ছে না আইন-শৃংখলা বাহিনী। নিজেদের বাড়িতেও থাকতে পারছেন না তারা। একইভাবে বন্ধ রয়েছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের কার্যালয়গুলো। একজন বুদ্ধিজীবী জানান, বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেছে জামায়াতে ইসলামী। অংশ নিয়েছে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিটি নির্বাচনে। আন্দোলন সংগ্রামের কারণে জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অগণিত নেতা-কর্মী। ২০০৯ সালে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর বিরোধীদলের সভা সমাবেশে বাধা দেয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর সভা-সমাবেশ অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ধীরে ধীরে ঘরোয়া বৈঠক বন্ধ করে দেয়া হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা এসব কার্যালয়েও পুলিশ মাঝেমধ্যে হানা দিয়ে নানাপ্রকার ‘কাহিনী’ সাজায় বলে জামায়াতের অভিযোগ। কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করেও তাদের সঙ্গে সেরকম আচরণই করা হচ্ছে সরকারী মহল থেকে। তাদের রাজনৈতিক কর্মকা-ে বাধা প্রদান করা নিয়মিত ও সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সর্বসাম্প্রতিক সময়েও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে সেই একই কায়দা ও কৌশল প্রয়োগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। গোপন বৈঠক, নাশকতার পরিকল্পনা, বিনা অনুমতিতে মিছিল-সমাবেশ, বিস্ফোরক দ্রব্য-জিহাদি বই থাকা প্রভৃতির অভিযোগ তুলে যেকোন শান্তিপূর্ণ ও ঘরোয়া কার্যক্রমে আইন-শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে কর্মসূচি ভ-ুল করে দেয়া হয়। এমনকি ঘরোয়া সভা ও মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচিতেও বাধা দেয়া হয়, ব্যানার কেড়ে নেয়া হয়, ঘটনাস্থল থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারের সাধারণ নির্দেশনা ও স্থানীয় দলীয় নেতাদের ইঙ্গিতে সাধারণ কর্মসূচিতে বাধা প্রদানের ঘটনাগুলো ঘটে বলে প্রকাশ। এভাবে বিরোধীদলীয় রাজনীতিকে একপ্রকার চিপাগলি থেকে কানাগলিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাষ্যকারদের অভিমত, এর মূল লক্ষ্য আগামী নির্বাচনে বিরোধীদের কোণঠাঁসা করে রেখে সরকার সমর্থক জোটের নির্বিঘেœ নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া।

আইনগত ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন
দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় বেশ দেরি থাকলেও ক্ষমতাসীনদের আগাম নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে বিতর্ক বেড়ে চলেছে। এনিয়ে আইনগত ও নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছে। সারা দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে নৌকায় ভোট চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। সমানে ব্যক্তি ও নির্বাচনী প্রতীকের নামে চলছে ব্যানার, সম্ভাব্য প্রার্থীর ছবিসহ রঙিন পোস্টার, দেয়াল লিখন প্রভৃতির মাধ্যমে জোরদার প্রচার-প্রচারণা। যা নির্বাচনী আইন-বিধি ও নৈতিকতার চরম লঙ্ঘন। কিন্তু এসব নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
নির্বাচনী আচরণবিধি নিয়ে প্রশ্ন
নির্বাচনের কোন ঘোষণা না থাকলেও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকেই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করা শুরু করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনী আচরণবিধি সংক্রান্ত বিধিবিধানে দেখা যায় আগাম নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ নেই। বলা হয়েছে, ‘কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা উহার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাহাদের পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ের তিন সপ্তাহ সময়ের পূর্বে কোন প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করিতে পারিবেন না।’ (বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যা ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮, ক্রমিক ১২)। অপর এক বিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি যানবাহন, সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার বা অন্যবিধ সরকারি সুবিধা ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ উল্লেখ্য, এখানে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে প্রথমেই প্রধানমন্ত্রীর পদ উল্লেখ রয়েছে। (বাংলাদেশ গেজেট অতিরিক্ত সংখ্যা ২৪ নবেম্বর ২০১৩, ক্রমিক ১৪)। ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ অর্থ- প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের মন্ত্রী, চীফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা তাহাদের সমপদমর্যদার কোন ব্যক্তি, সংসদÑসদস্য এবং সিটি কর্পোরেশনের মেয়র’। (বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, নভেম্বর ২৪, ২০১৩)। নির্বাচনী আইনে ‘সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের নির্বাচনী প্রচারণা’ শীর্ষক বিধিতে বলা আছে, (১) সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনী কর্মসূচি বা কর্মকা- যোগ করিতে পরিবেন না। (২) সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাহার নিজের বা অন্যের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি যানবাহন, সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার অন্যবিধ সরকারি সুবিধাভোগ করিতে পারিবেন না এবং এতদুদ্দেশ্যে সরকারি আধাÑসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তাÑকর্মচারি বা কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা কর্মকর্তাÑকর্মচারিকে ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ (বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, নভেম্বর, ২৪, ২০১৩)। ‘সরকারি সুবিধাভোগী কতিপয় ব্যক্তির নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত বাধা নিষেধ’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘সংসদের কোন শূন্য আসনে উপÑনির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্রে সরকারের কোন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপÑমন্ত্রী কিংবা উক্ত মন্ত্রীদের পদমর্যাদাসম্পন্ন সরকারি সুবিধাভোগী কোন ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনÑপূর্ব সময়ের মধ্যে কোন সফর বা নির্বাচনী প্রচারণায় যাইতে পারিবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উক্ত নির্বাচনী এলাকায় ভোটার হইলে তিনি কেবল ভোট প্রদানের জন্য উক্ত এলাকায় যাইতে পারিবেন।’ (বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০০৮)।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্বাচনী আচরণবিধিতে উল্লিখিত ‘ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত সময়ের তিন সপ্তাহ সময়ের পূর্বে কোন প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করিতে পারিবেন না’- এই বিধানকে পছন্দমত ব্যাখ্যা করে এর সুযোগ নিচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। তাদের মতে, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরই কেবল এই বিধি-বিধান কার্যক্রম হবে। তার আগে এর কোন কার্যকারিতা নেই। ফলে সরকারি সুবিধার অবাধ ব্যবহার করে নির্বাচনের এক-দেড় বছর আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দের আগেই বিশেষ প্রতীকের পক্ষে ভোট চাওয়া হচ্ছে। যা প্রবল অনৈতিকতার পরিচায়ক।
গত ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচার অভিযান শুরু করে বলেন, এ বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, ‘হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরান (র.)-এর পুন্যভূমি সিলেট থেকে আমরা নির্বাচনী প্রচার শুরু করছি। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য আমি আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই।’ এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে একতরফা নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা।

অন্যদিকে নির্বাচনী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা দূরের কথা, সাধারণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিই পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। বিক্ষোভ মিছিল ও সভা-সমাবেশের কোন অনুমতি তো মিলছেই না, সাধারণ অবস্থান কর্মসূচি, মানববন্ধন, কালোপতাকা প্রদর্শন, লিফলেট বিতরণ, পোস্টার লাগানো প্রভৃতি অনুত্তেজক ও নিরীহ কার্যক্রমে হামলা চালানো হচ্ছে। লাঠিপেটা করে কর্মসূচি ভ-ুল করে দেয়া হচ্ছে। মানববন্ধনে ঢুকে নেতাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পোস্টার লাগানোর সময় আটক করা হচ্ছে। পোস্টার তুলে ফেলা হচ্ছে। এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে বিএনপির কয়েকশ’ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।

এবিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ভোট চাইতে পারেন- কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে। যদি প্রধানমন্ত্রী নিজের খরচে জনসভা করেন, তাতে কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু সরকারি খরচে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভোট চাইতে পারেন না। গত ৯ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি ভোট চান আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে। এ সময় সরকারি গাড়ি নেবেন না, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সভায় আনবেন না, নিরাপত্তা থাকবে না। বিধি মেনে আপনি করুন, আপত্তি নেই। আর আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে যদি আপনি ভোট চাইতে যান, তাহলে বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়াকেও ভোট চাইতে দিতে হবে। একই অধিকার দিতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এভাবে কী করে ভোট চাইতে পারেন, বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘একদিকে প্রধানমন্ত্রী ভোট চাইছেন, অপরদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন কারাগারে। এটা তো অন্যায়, অনৈতিক ও বেআইনি।’ নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ইসি বলছে, তফসিল ঘোষণার পরই তাদের নাকি কর্তৃত্ব। তারা এই অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকা-ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারকে একটি চিঠি দিতে পারেন না? ইসি সরকারকে বলুক, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ প্রচার বন্ধ করুন। আর তা না হলে খালেদা জিয়াকেও একই সুযোগ দিন।’ অপর এক স্থানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার সমালোচনা করে ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, এতসবের পরও নির্বাচন কমিশন বলছেন তাদের এবিষয়ে কিছু করার নেই। আসলে তাদের শক্তি নেই। তারা নিরপেক্ষ নয়। তারা সরকারের তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠান। সেজন্য তারা এই ধরনের কথা বলছেন। নির্বাচনের এত আগে ভোট চাওয়ার এই ঘটনা যদি আজকে ভারতে হতো তাহলে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিতো। নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘হয় সরকারি খরচে ভোট চাওয়া বন্ধ করুন অথবা আমাদেরও ভোট চাওয়ার সুযোগ করে দেন।’
নির্বাচনী কারচুপির রোগসমূহ
বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থায় ‘ভোট কারচুপি’ যেন একটা স্থায়ী রোগের রূপ নিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে এযাবত সংঘটিত নির্বাচনী কারচুপির ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অন্তত ২৫টি তরিকায় এই অপকৌশল অবলম্বন করা হয়।
এসব অপকৌশল থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে মুক্ত করার এবং এর প্রতিকারের দায়িত্ব সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এখানে এই কারচুপি-তরিকার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো। বিভিন্ন সময় নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
১. দলীয় প্রিজাইডিং-পোলিং অফিসার : নির্বাচনে কারচুপি করার জন্য পূর্ব থেকেই পরিকল্পনা করা হয়। কারচুপির পরিকল্পনা সফল করতে দলীয় অনুগত অথবা সুবিধাভোগী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার নিয়োগ দেয়ার জন্য সবরকম কলাকৌশল অবলম্বন করা হয়। কেন না এরা হলেন ভোট নিয়ন্ত্রণ ও গণনার মূল ব্যক্তি। এরাই হতে পারেন নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিপরীতে কারচুপিরও প্রধান ক্রীড়নক।

২. ভোটার তালিকার প্রতি নজর : ভোটের দিন প্রথমেই নজর দেয়া হয় ভোটার তালিকার প্রতি। এতে নাম থাকা মৃত ব্যক্তি, বিবাহ হওয়ায় অন্য স্থানে গমনকারী মহিলাগণ, প্রবাসীগণ, অন্যত্র চাকরিরত ব্যক্তিগণ, ভোটকেন্দ্রে যেতে অক্ষম রোগী বা পঙ্গু ব্যক্তি প্রভৃতিদের চিহ্নিত করা হয়। ভোট শুরু হওয়ার সূচনা লগ্নেই কারচুপির জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে এসব ভোট কাস্ট করে ফেলা হয়।
৩. মামলা-জেলের ভয় : কথিত ‘প্রতিপক্ষে’র নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মামলায় জড়ানো বা জেলে ঢোকানোর ভয় দেখানো হয়। এদেরকে ভয় দেখিয়ে বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে ভোট সংগ্রহ করতে বাধ্য করা হয়, নয়তো তাদেরকে ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকতে হুমকি দেয়া হয়। এর ফলে ‘প্রতিপক্ষে’র ভোট বৃদ্ধির হার কমে যায়।

৪. উদ্দেশ্যমূলক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি : নির্বাচনী এলাকার যেসকল স্থানে ‘প্রতিপক্ষ’ শক্তিশালী সেসব এলাকায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়। এতে কখনো দলীয় ক্যাডার এবং ক্ষেত্রবিশেষে আইনপ্রয়োগে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজে লাগানো হয়ে থাকে। এর ফলে সেসব স্থানের ভোটারগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে সাহস পায় না। ভোটের দিন কেন্দ্রে আসার পথেও ভীতি সৃষ্টি করা হয়।
৫. প্রচারণায় বাধা-হুমকি : বিরোধীপক্ষের প্রচার-প্রচারণায় বাধা প্রদান করা হয়ে থাকে। পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়, প্রচার মাইক কেড়ে নেয়া হয়, সভা-সমাবেশ ও প্রচার মিছিল প- করে দেয়া হয়। পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ‘বিরোধী’ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে হুঁশিয়ারি-হুমকি দেয়া হয়।
৬. ভোট কেনা-বেচা : নির্বাচনের প্রাক্কালে ভোট কেনা-বেচা করা হয়। এই অপকৌশল বাংলাদেশে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যেসব এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জনপ্রিয়তা বেশি সাধারণত সেসব এলাকায় ভোটের আগের রাতে চলে ‘টাকার খেলা’। দরিদ্রদের মধ্যে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করেও ভোট কেনা-বেচা চলে। এজন্য ‘দালাল’ নিয়োগ করা হয়। পাড়া-মহল্লার রাস্তা মেরামত করা, টিউবওয়েল বসিয়ে দেয়া, বিদ্যুৎ লাইন দেয়া প্রভৃতির মাধ্যমেও ভোটারদেরকে প্রতিশ্রুতির ফাঁদে আটকে ফেলা হয়।
৭. প্রার্থীর দেয়া ভোজে অংশগ্রহণ : ভোটের দায়িত্বে সম্ভাব্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পিকনিক-মিলাদের নামে বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। ভোটের দিন সকালে-দুপুরে কোনো বিশেষ প্রার্থীর বা তার লোকের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করানো হয়। এসময় ‘বিশেষ উপহার’ প্রদানের মাধ্যমে নির্বাচনী কর্মীদের প্রভাবিত করা হয়।

৮. প্রার্থীর বাড়ির কাছে কেন্দ্র : বিশেষ প্রার্থী পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে অনেক সময় তার বাড়ির কাছে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করতে সক্ষম হন। এর ফলে সেই প্রার্থীর গায়ের জোর বেড়ে যায়। তিনি সেই কেন্দ্রের ভোট প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেন। কেন্দ্রটি তার একান্ত ‘নিজের’ হয়ে যায়।
৯. পরিচয়পত্র কেড়ে নেয়া : মহল্লার ভোটারদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র কেড়ে নেয়া হয়। বিশেষ প্রার্থীর ক্যাডাররা ভোটারদের বলে যায়, ‘তোমাদের ভোট পেয়ে গেছি, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই।’

১০. এজেন্টদের বের করে দেয়া : ভোট গণনা অবশ্যই প্রার্থী বা তার প্রতিনিধির সামনে হওয়ার বিধান আছে। কিন্তু কারচুপি করার সুবিধার জন্য এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়- যাতে প্রার্থী বা তার প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত হতে বা থাকতে না পারে। প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টদেরকে বুথ থেকে বের করে দেয়া অতি সাধারণ ঘটনা। এর ফলে বিশেষ প্রার্থীর লোকেরা ইচ্ছেমত ভোট কাস্ট ও গণনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
১১. ডামি এজেন্ট ও ভোটার : ভোটে কারচুপি করার লক্ষ্যে বিশেষ দল বা পক্ষের ‘ডামি’ এজেন্ট ও ভোটার ব্যবহার করার অভিযোগও পাওয়া যায়। বুথে হয়তো দেখা যাবে সব প্রার্থীরই এজেন্ট রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে বেশির ভাগই বিশেষ একটি পক্ষের লোক। এরা ভুয়া পরিচয় নিয়ে পোলিং এজেন্ট সেজে ভোট পাহারা দেয়। আবার, বিরোধী পক্ষের ভোটারদের কেন্দ্রে আসতেই দেয়া হয়নি। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পর্যবেক্ষক, দেশী-বিদেশী সাংবাদিকসহ গণমাধ্যমের লোকজন আসলে তাদের দেখে ‘নিজেদের’ লোকজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এবং ভোটার উপস্থিতির পরিমাণ জানান দেয়া হয়।
১২. ভোটকেন্দ্রে শক্তিমত্তা প্রদর্শন : ভোটের দিন ‘প্রতাপশালী’ প্রার্থীর ক্যাডাররা কেন্দ্রের আশেপাশে সদর্পে মিছিল করে স্লোগান দেয়, অহেতুক ‘হুই’ তোলে। এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের ‘শক্তিমত্তা’ প্রদর্শণ করে। এতে একদিকে সাধারণ ভোটাররা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়, অন্যদিকে নির্বাচনকর্মীরা আতঙ্কিত হয়। এই অবৈধ কর্মকা- ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের প্রায়ই অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা যায়।

১৩. অন্ধকার ও সংকীর্ণ পরিসর : কারচুপি করার লক্ষ্য নিয়ে কোন কোন স্থানে ভোট কেন্দ্র রাখা হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন ও সংকীর্ণ পরিসর। ভোট গণনাকালে পর্যাপ্ত আলো-বাতির ব্যবস্থা থাকে না। ভোট গণনায় অহেতুক সময় ক্ষেপণ করা হয়, ফলাফল প্রকাশে দেখা যায় ধীরগতি।
১৪. একজনের ১০ আঙ্গুলের টিপ : ভোট দিতে গিয়ে ব্যালট পেপার গ্রহণ করার জন্য একেকজন হাতের ১০টি আঙ্গুলের টিপ দিয়ে একসঙ্গে ১০টি ব্যালট পেপার সংগ্রহ করতে পারে। ভোট গ্রহণকারী ব্যক্তি বিশেষ কোন প্রার্থীর পক্ষের লোক হলে তিনি এতে সহায়তা দিয়ে থাকেন।
১৫. সাংবাদিক-পর্যবেক্ষদের বাধা প্রদান : নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিচয়পত্র প্রদানেও নানা কারসাজির আশ্রয় নেয়া হয়। সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়। জাল ভোটের দৃশ্য ধারণ করলে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়া হয়। ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি-ভিডিও নষ্ট করে ফেলা হয়।
১৬. ব্যালট বা-িলে কারচুপি : ভোট গণনার জন্য প্রতীকে দেয়া সিল অনুযায়ী ব্যালট পৃথক পৃথকভাবে সাজানো হয়। এটি কোন বিধান নয়- প্রথা। এভাবে ১০০টি করে বান্ডিল করা হয়। এক্ষেত্রে কারচুপি করার মনোবৃত্তি থাকলে (প্রিজাইডিং/পোলিং অফিসারের জ্ঞাতসারে) এক পছন্দের প্রতীকের বান্ডিলের ভেতর বিপক্ষীয় প্রার্থীর ব্যালট ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এতে কাঙ্খিত প্রার্থীর ব্যালটের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বিপক্ষীয় প্রার্থীর ব্যালটের সংখ্যা কমে যায়। বিশেষ বিশেষ কেন্দ্র বেছে নিয়ে এটা করা হয়। এসময় প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টরা যাতে বিষয়টি ধরতে না পারে অথবা বুঝলেও ফাঁস না করে দেয়- কারচুপিকারিরা তার ‘যথাযথ’ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রয়োজনে এসব এজেন্টকে কক্ষ থেকে বের করে দেয়া হয়।
১৭. ব্যালট বাক্স ছিনতাই : যে কেন্দ্রে কোন প্রার্থীর বেশী ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেখানে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচন বাঞ্চাল করে দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই এই ঘটনা এক ‘ঐতিহাসিক’ প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে।
১৮. ব্যালট পেপার ছিনতাই : অবৈধভাবে কেন্দ্র দখল করে কেন্দ্রে উপস্থিত ভোটারের কাছ থেকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সেগুলো নিজের পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে সিল মারা হয়। এটি বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
১৯. স্বাক্ষর ছাড়াই রেজাল্ট শিট : ভোটের রেজাল্ট শিট চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রে উপস্থিত প্রার্থী অথবা তার প্রতিনিধি তথা প্রার্থীর এজেন্টদের স্বাক্ষর গ্রহণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু কারচুপি করার লক্ষ্যে এমন স্বাক্ষর গ্রহণ ছাড়াই রেজাল্ট শিট চূড়ান্ত করা হয়। এর ফলে ভোটের সংখ্যা পরিবর্তন করে একজনের পরিবর্তে আরেকজনকে বিজয়ী করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

২০. ভোট দেয়া হয়ে গেছে : সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশের পর হাতে কালি লাগিয়ে দিয়ে বলা হয় তাদের ‘ভোট দেয়া হয়ে গেছে’। ফলে ভোট না দিয়েই ওই ভোটারদের কেন্দ্র থেকে ফিরে আসতে হয়। বিগত সময়ে দলের একেকজন কর্মী ১শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ পর্যন্ত ভোট দেবার ‘গৌরব’ অর্জনের রেকর্ড গড়তে সক্ষম হয়। কোন কোন স্থানে পুরো একটি পরিবারের ভোট অন্যরা দিয়ে দেয়।
২১. পুরো বই মেরে দেয়া : ভোট শুরুর প্রাক্কালে ব্যালট বই নিয়ে বিশেষ প্রার্থীর প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কোন কোন স্থানে পুরো বইটাই একটি প্রতীকের সিলে ভরা থাকে। ফলে অনেক ভোটারকেই ব্যালট না পেয়ে ফিরে যেতে হয়। ভোটগ্রহণকারী ব্যক্তিরা স্বেচ্ছায় কিংবা ভীতির মুখে পড়ে একাজে সহযোগিতা করে থাকেন।
২২. ভীতি ও চাপের মধ্যে রাখা : বিভিন্নভাবে নির্বাচনী কর্মকর্তা-কর্মীসহ অন্যান্যদেরকে ভীতি ও চাপের মধ্যে রাখা হয়। চাকুরিতে সমস্যা সৃষ্টি করা, পারিবারের ক্ষতি করার হুমকি প্রদান, জানমালের ক্ষতির হুমকি প্রদানও চলে কোন কোন ক্ষেত্রে।
২৩. শতকরা হার বেশি দেখানো : পূর্বেই ছক কষে দেয়া হয় কোথায় কী মাত্রায় কারচুপি করা হবে। দায়িত্বশীল অফিসারকে ব্যবহার করে কাস্টিং ভোটের শতকরা হার বৃদ্ধি করে পছন্দের প্রার্থীর হিসাবে বেশি ভোট দেখিয়ে বিজয়ী করার ব্যবস্থাও করা হয়। এজন্য ‘সাজানো’ রেজাল্ট দ্রুত ঘোষণা করে দেয়ার আয়োজন করা হয়।

২৪. অসহায় পোলিং এজেন্ট : ভোটকেন্দ্রে বিশেষ পক্ষ কোন কোন ক্ষেত্রে এতোটাই প্রতাপ বিস্তার করে যে সেখানে পোলিং এজেন্টদের কোন আপত্তিই আমলে নেয়া হয় না। কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা ‘প্রতিপক্ষে’র পোলিং এজেন্টদের সাক্ষরও গ্রহণ করেন না। কোন কোন কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের ফলাফল সিটও সরবরাহ করা হয় না। কোন পোলিং এজেন্ট কথা বললে তাদেরকে প্রশাসনের ভয় দেখানো হয়। ফলে তারা একপ্রকার অসহায় অবস্থায় পতিত হয়।
২৫. শেষ সময়ে চাপ সৃষ্টি : ভোট গ্রহণের সময় শেষ হওয়ার পরেও বিশেষ প্রার্থীর চাপে কেন্দ্রে ভোটারের নামে দলীয় লোক ঢুকিয়ে ব্যালট গ্রহণ ও সিল মারার মহড়া চলে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা দৃঢ়তা প্রদর্শন করলেই তবে এই চাপ মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।
অভিজ্ঞদের বক্তব্য : ভোটগ্রহণকে কেন্দ্র করে আইন-বিধান যথেষ্ট থাকলেও বিশেষ পক্ষের প্রভাব-প্রতাপ এবং চাপ-হুমকির কাছে এসব আইন-বিধান অকেজো হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী এক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনে কারচুপির প্রধান অস্ত্র ‘জোর খাটানো’। কেন্দ্রের বাইরে এবং ভেতরে এই অবৈধ কর্মকা- বন্ধ এবং জোর-জবরদস্তি ঠেকানো গেলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব। পুলিশের একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, সবপর্যায়ের নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং কেন্দ্রসংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপরেই প্রধানত নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণ নির্ভর করে। তারা বিশেষ কোন ‘পক্ষ’ নিয়ে নিলে আর কোনভাবেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব হয় না- উল্লেখ করে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানান। এসব অপকৌশল থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে মুক্ত করার এবং এর প্রতিকারের দায়িত্ব সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ সেই অপকৌশলের দিনে আর ফিরে যেতে চায় না দেশবাসী। তছনছ হয়ে পড়া নির্বাচন ব্যবস্থার নিরাময়ই ইসি’র কাছে জাতির একমাত্র প্রত্যাশা।

http://www.dailysangram.com/post/343556