৩০ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৩২

পুলিশের সোর্সই ‘গুম’

হদিস নেই ইশরাক, মারুফ ও হাসিনের

রাজধানী থেকে পুলিশের এক সোর্স নিখোঁজ হওয়ার পরে চার মাস পেরিয়ে গেলেও তার কোন সন্ধ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তির পরিবার মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও পুলিশ তার বিষয়ে কোন খোঁজ দিতে পারেনি। নিখোঁজ হওয়া এই যুবকের নাম রিফাত আহমেদ হৃদয় (২১)। তিনি মোহাম্মদপুরের হুমায়ন রোডের ৬/২৪ নম্বর বাসায় বাবা, মা ও স্ত্রীসহ ভাড়া থাকতেন। পরিবারের অভিযোগ, হৃদয় পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতো। দুই মাস আগেও পুরান ঢাকায় পুলিশের একটি অভিযানে হৃদয়কে দেখা গেলেও রহস্যজনকভাবে পুলিশ তাকে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করছে।

স্বজনরা অভিযোগে জানায়, হৃদয় শেরেবাংলা নগর ও মোহাম্মদপুর থানা এলাকার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আর মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পুলিশকে জানাতো। গত ৫ মে’র পর থেকে তিনি আর বাসায় ফেরেননি। ওইদিন সন্ধ্যার পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পায় তার স্ত্রী গোলাপ শাহ। বাসায় না ফেরায় একদিন পর স্ত্রী মোহাম্মদপুর ও শেরেবাংলানগর থানায় খোঁজ নেন। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় গিয়েও তিনি তার স্বামীর খোঁজ পাননি। পরে রিফাতের সনজু নামে এক বন্ধু তার স্ত্রীকে জানায় যে, ৫ মে সন্ধ্যার দিকে শ্যামলী শিশু মেলার সামনে একটি দোকানে হৃদয় আর তিনি এক সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন। এ সময় তাদের সামনে একটি গাড়ি থেকে তার ভেতর থেকে ৩/৪ জন সাদা পোষাকের ব্যক্তি নেমে এসে রিফাতের সঙ্গে কথা বলে। তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক ছিল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ওই লোকগুলো হৃদয়কে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তিনি ঘটনা দেখে সেখান থেকে পালিয়ে যান। বিষয়টি জানার পর স্ত্রী গোলাপ শাহ ২৮ মে মোহাম্মদপুর থানায় একটি নিখোঁজের জিডি করেন।
জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই সজীব গতকাল বলেন, হৃদয় একজন ছিনতাইকারী ও পকেটমার। সে শ্যামলী শিশু মেলা বাস স্টপেজে মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ টান দিয়ে পালিয়ে যেত। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় তিনটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। ওই গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এক মাস আগেও হুমায়ন রোডের বিহারী কলোনীতে তাকে দেখা গিয়েছিল বলে এলাকাবাসী পুলিশের কাছে জানিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, হৃদয়ের দাদা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। মোহাম্মদপুরের হুমায়ন রোডের ৬/২৪ নম্বর ঠিকানায় হৃদয়ের দাদা তোজাম্মেল হোসেন সপরিবারে থাকেন। রিফাতের বাবা নূর আলম সিদ্দিকী একজন সরকারী কর্মচারী। রিফাত পরিবারের অমতে বিহারী কলোনীর গোলাপ শাহ নামে এক মেয়েকে বিয়ে করার পর সেখান থেকে বের করে দেয়। এরপর রিফাত তার স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকা শুরু করেন। পুলিশের ধারণা, রিফাতকে কেউ তুলে নিয়ে যায়নি। রিফাত তার স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে থাকতে এই আত্মগোপনের নাটক করেছেন। এছাড়া সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা থেকে যেন বঞ্চিত না হন-এ জন্য রিফাতের স্ত্রী থানায় একটি জিডি করেছেন বলে এসআই জানান।

রিফাতের স্ত্রী গোলাপ শাহ বলেন, তার স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার পরে পুলিশের কাছে বহুবার গিয়ে কাকুতি মিনতি করলেও পুলিশ তার কোন খোঁজ দিচ্ছে না। হৃদয় নিখোঁজের দুই মাস পর পুরান ঢাকায় পুলিশের একটি অভিযানে তাকে দেখা গেছে এমন একটি তথ্য পাওয়ার পরে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে তার স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু পুলিশ বলছে, তার স্বামীকে পাওয়া যায়নি। স্ত্রী বলেন, আমি ধারণা করছি- ‘পুলিশই হয়তো আমার স্বামীকে গুম করেছে।’
গতকাল রিফাতের দাদা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তোজাম্মেল হোসেন বলেন, রিফাতকে আমরা এখনও খুঁজে পাইনি। আগে আমারই কাছে থাকত সে। কিন্তু বিহারী কলোনীর এক মেয়েকে বিয়ে করে রিফাত পৃথক হয়ে যায়। তবে তার বিরুদ্ধে অনেক অপকর্মের অভিযোগ আমরা শুনেছি। সেসব অপকর্ম ঢাকতে রিফাত আত্মগোপন করেছেন কিনা- তা তিনি নিশ্চিত নন তিনি।

তিন জন এখনও ফেরেননি : এদিকে, গত ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির স্টার কাবারের সামনে থেকে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ (২০) নিখোঁজ হন। ছুটিতে ঢাকায় বেড়াতে এসে ওই শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছিলেন। এ ঘটনায় নিখোঁজ ছাত্রের বাবা তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী জামালউদ্দিন আহমেদ ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি করেন। নিখোঁজের এক বছর পেরিয়ে গেলেও তার কোন সন্ধ্যান দিতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। ওই বছরের ৪ ডিসেম্বর বিকালে ধানমন্ডির ৯/এ নম্বর সড়কের ৮৯ নম্বর বাসা থেকে ভিয়েতনামের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে বের হন। ওই দিন বেলজিয়াম থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল তার মেয়ে সামিহা জামানের। সামিহা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে বাবার ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোনটি বন্ধ পাওয়ায় পর তিনি একটি ট্যাক্সিতে করে বাসায় ফেরেন। তখন থেকে মারুফ জামানের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরদিন সামিহা ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি করেন। এ ব্যাপারে ধানমন্ডি থানার ওসি আব্দুল লতিফ বলেন, ইশরাক ও মারুফ জামান নিখোঁজের ঘটনায় দায়ের করা দুইটি জিডি তদন্ত করা হচ্ছে। তবে তাদের এখনও কোন সন্ধান পাইনি।
গত ৮ আগস্ট রাত ১০ টা ২০ মিনিটের দিকে মিরপুর ডিওএইচএস এলাকার ১১ নম্বর রোডের ৭৯২ নম্বর বাড়ির সামনে থেকে র্যা ব-৭ এর সাবেক অধিনায়ক লে.কর্নেল (চাকরিচ্যুত) হাসিনুর রহমানকে মাইক্রোবাসে করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিওএইচএস এলাকার ৪ নম্বর এভিনিউয়ের ১০ নম্বর রোডের ৬৫৯ নম্বর বাড়িতে হাসিনুর রহমান সপরিবারে থাকতেন। এ ঘটনার পর তার স্ত্রী শামীমা আক্তার পল্লবী থানায় একটি জিডি করেন। গতকাল পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, নিখোঁজের ঘটনায় দায়ের করা জিডি তদন্ত করা হচ্ছে। আমরা এখন পর্যন্ত তার কোন সন্ধান পাইনি।

https://www.dailyinqilab.com/article/150232