৩০ আগস্ট ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৬

৩ গুণ ব্যয়ে রেলের ডুয়েলগেজ রূপান্তর

কিলোমিটারে খরচ ৬৭ কোটি টাকা

বাংলাদেশে সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও চীনের চেয়ে বাংলাদেশে এই নির্মাণ খরচ অনেক বেশি। এমনকি দেশের মধ্যেই এক প্রকল্প থেকে অন্য প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ও বেশি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত রেলপথটি মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজ করা হবে। এ কাজে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়ছে ৬৭ কোটি টাকার বেশি। এতে যে ব্যয় ধরা হচ্ছে তা অন্য যেকোনো রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয়ের তিন গুণেরও বেশি। দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত ৫৭ কিলোমিটার লাইনকে ডুয়েলগেজ চলমান প্রকল্পেই প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বলে প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে।

প্রকল্প প্রস্তাবনার তথ্য থেকে জানা গেছে, সর্বাধিক ব্যয়ের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে চীনের অর্থায়নে জিটুজি পদ্ধতিতে আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত রেলপথ ডুয়েলগেজ রূপান্তর প্রকল্পে। এ কাজ করতে ১৬ হাজার ১০৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। চীন থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রেতা ঋণে (পিবিসি) বাংলাদেশ সরকার মোট ১০ হাজার ৬৫৪ কোটি ৩৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা নেবে। চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (সিআরবিজি) রেলপথটি নির্মাণ করার কথা। পিবিসির নিয়মানুযায়ী নির্মাণকাজের ৮৫ শতাংশ অর্থায়ন বৈদেশিক ঋণ এবং ১৫ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের অনুদান হতে হবে। আর সেই নিয়মানুযায়ীই রেলওয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করেছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ সূত্র থেকে জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন দেশের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বমানের রেলপথে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৩১ কোটি টাকা। আর দণি এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বৈদ্যুতিক সিঙ্গেল ট্র্যাকের লাইন, সিগন্যালিং ও অন্যান্য অবকাঠামোসহ কিলোমিটারপ্রতি রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ২৩ থেকে সর্বোচ্চ ৩১ কোটি টাকা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রেলপথ নিয়ে শতাধিক প্রকল্প রয়েছে। এতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়বে ১২ থেকে ১৭ কোটি টাকা। আর চীনে সিঙ্গেল লাইনের সাধারণ রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। পাকিস্তানে রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি গড় ব্যয় হয় ১৫ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পে ঠিকাদার নিযুক্ত করে দিয়েছে চীন। তাই সর্বনিম্ন দরপ্রস্তাব গ্রহণের সুযোগ থাকছে না। জিটুজি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নে খরচ বেশি পড়াই স্বাভাবিক। আর ঠিকাদারের দেয়া প্রস্তাবে দীর্ঘ দিন নেগোসিয়েশন করে দর কিছু কমানো হয়েছে। অবশ্য এর একটি সুফল হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে নানা উছিলায় খরচ বাড়ানোর সুযোগ থাকে না। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে এ প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যাপারে সম্মতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সূত্র আরো জানিয়েছে, আখাউড়া-সিলেট রেলপথের মধ্যে আখাউড়া-কুলাউড়া পর্যন্ত অংশটি ১৮৯৮ সালে নির্মাণ করে ব্রিটিশ সরকার। পরে কুলাউড়া-সিলেট পথটি তৈরি হয় ১৯১৫ সালে। আখাউড়া-কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনটি ট্রান্স-এশিয়ান রেলরুটের একটি। আখাউড়া-সিলেট ডুয়েলগেজ করা গেলে ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-সিলেট উভয় সেকশনে ভ্রমণের সময় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা কমতে পারে। এ প্রকল্পের আওতায় ২৩৯.১৪ কিলোমিটার রেলপথ মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজ করা হবে। এর মধ্যে মেইনলাইন ১৭৬.৬০ কিলোমিটার ও লুপ লাইন ৪৮.৪০ কিলোমিটার। ৪৯টি মেজর ব্রিজ, ২৩৭টি মাইনর ব্রিজ নির্মাণ, ১২ হাজার ৭৫০ বর্গমিটার স্টেশন ভবন, ১৬ হাজার ৬৯০ বর্গমিটার ডরমেটরি নির্মাণ। ২০০.৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ২২টি স্টেশনের সিগন্যালিং কাজ করা হবে।
জানা গেছে, কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথে ব্যয় হচ্ছে কিলোমিটারপ্রতি ১০ কোটি টাকা। ৫৪৪ কোটি ৮৬ লাখ ৭৭ লাখ টাকা খরচে নির্মাণ করা হবে ভারতীয় ঋণের এ প্রকল্পটি। এ রকম পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথটি ডুয়েলগেজে রূপান্তরে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হচ্ছে ১১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আর দোহাজারী-কক্সবাজার সম্পূর্ণ নতুন রেলপথ করা হচ্ছে এডিবির অর্থায়নে। এখানে রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হচ্ছে ৪৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এসব বিবেচনায় আখাউড়া-সিলেট রেলপথে অস্বাভাবিক ব্যয় হচ্ছে বলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে উল্লেখ করা হয়।

অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনকুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরীর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের প্রকল্প নেয়ার আগে সঠিকভাবে সমীক্ষা করা হয়েছে কি না সেটি নিয়ে প্রশ্ন থাকে। সমীক্ষার মাধ্যমেই আমরা আমাদের প্রয়োজনটা নিরূপণ করতে পারি। তিনি বলেন, সঠিকভাবে চাহিদাটা নিরূপণ করে প্রকল্প প্রণয়ন করা না হলে ব্যয় বাড়বে। এতে দেশের সম্পদেরও অপচয় হয়। তিনি এলওসির ঋণে প্রকল্পের ব্যাপারে বলেন, ওই সব ঋণের ক্ষেত্রে অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে। তাদের কাছে থেকে কারিগরি জ্ঞান নিতে হচ্ছে। ইচ্ছা করলেই পছন্দ মতো কিছু করা যাবে না। সেখানে নেগোসিয়েশন ক্ষমতা কম থাকে। তাদের দেয়া শর্ত মেনেই ঋণ নিতে হয়। তবে আমাদের নেগোসিয়েশন করার দক্ষতা যদি বাড়াতে পারি তাহলে সেখানেও অনেক শর্তকে আমরা পরিবর্তন করে চুক্তি করতে পারি।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো উইং বলছে, এ প্রকল্পের ব্যয় বাস্তবায়নাধীন অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে বেশি। তাই ব্যয়গুলো খাতভিত্তিক পর্যালোচনা করা দরকার। স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে টেনের উচ্চতার তারতম্য বেশি হওয়ায় যাত্রীদের ট্রেনে ওঠানামাতে সমস্যায় পড়তে হয়। বিষয়টি নজরে আনা দরকার। এ ছাড়া শাহজীবাজার থেকে শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার স্থানে রেললাইন অত্যন্ত আঁকাবাঁকা। এগুলোকে সরলীকরণ করতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/344596