২৯ আগস্ট ২০১৮, বুধবার, ৯:০৫

ভুয়া রফতানি বিলে দেড় হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটাকে দুর্নীতি-জালিয়াতি বললেও কম বলা হবে, এটি স্রেফ ডাকাতি। জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে


ভুয়া রফতানি বিল জমা দিয়ে ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। ৫৮০টি রফতানি বিলের বিপরীতে এসব অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের ইমামগঞ্জ, স্থানীয় কার্যালয় ও মোহাম্মদপুর শাখা থেকে তুলে নেয়া হয়েছে এসব অর্থ। ক্রিসেন্ট গ্রুপের জালিয়াতির বিষয়ে জনতা ব্যাংকের তৈরি একটি তদন্ত প্রতিবেদন থেকে উদ্বেগজনক এমন তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি ব্যাংকের পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটাকে দুর্নীতি-জালিয়াতি বললেও কম বলা হবে, এটি সে ফ ডাকাতি। আর এর সঙ্গে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বড় অঙ্কের ভাগাভাগির যোগসাজশ যে রয়েছে, সেটি একেবারে নিশ্চিত। কেননা কোনো পাগলও এভাবে টাকা রিলিজ করবে না। রফতানি বিলের যাবতীয় বিষয় যাচাই না করে বিপুল অঙ্কের রফতানি বিল কিনে নেয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
এককথায়, জনগণের ট্যাক্সের টাকা একটি চক্র ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। কারণ প্রতিবছর এসব জালিয়াতির বিপরীতে ব্যাংকগুলোয় বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি গুনতে হয় সরকারকে। তাই সবার আগে উচিত হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রিসেন্ট গ্রুপের রফতানি বিলের বিপরীতে চট্টগ্রাম কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের রফতানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাদের রফতানির সব নথিপত্রই ভুয়া। প্রস্তুতকৃত রফতানি বিলের বিপরীতে ব্যাংক, কাস্টমস এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া সব তথ্যই জাল। জালজালিয়াতি করা তথ্য দিয়ে কাগজপত্র প্রস্তুত করে। কিন্তু কোনো যাচাই-বাছাই না করে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা গ্রাহককে ঋণ দিয়েছে।

কিন্তু রফতানি বিলগুলো ভুয়া হওয়ায় বিদেশ থেকে কোনো অর্থ আসছে না। ফলে বিলের বিপরীতে কোনো অর্থও আদায় হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের দেড় হাজার কোটি টাকার বিশাল ঋণ ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
সূত্র জানায়, ক্রিসেন্ট গ্রুপের জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হলে জনতা ব্যাংক তদন্ত কমিটি গঠন করে। গঠিত কমিটি এরই মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সরেজমিন তদন্ত সম্পন্ন করেছে। তদন্তে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রফতানির নথিপত্র পর্যালোচনা করা হয়। কমিটি এখন বিদেশের যেসব ব্যাংক থেকে আমদানির এলসি দেয়া হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এসব জালিয়াতি করা হয়। এর সঙ্গে শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করতে শাখার কর্মকর্তারা যেমন ক্রিসেন্ট গ্রুপকে সহায়তা করেছে, তেমনি এসব বিল কিনতেও শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ে সুপারিশ পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রিসেন্ট গ্রুপ চামড়াজাত বিভিন্ন পণ্য রফতানি করেছে হংকং ও থাইল্যান্ডে। কিছু রফতানি বিলের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আবার গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে আমদানির বিপরীতে দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর তথ্যও পাওয়া গেছে। হংকংয়ের সঙ্গে গ্রুপটির কিছু লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেলেও থাইল্যান্ডের সঙ্গে লেনদেনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
ক্রিসেন্ট গ্রুপের ৪টি প্রতিষ্ঠানের নামে চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, রূপালী কম্পোজিট লেদার এবং লেক্সকো লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে কিছু পণ্য রফতানি হলেও সেগুলোর বিপরীতে আমদানিও হয়েছে। এসব খাতে অর্থ পাচারের নজিরও রয়েছে।
সূত্র জানায়, ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করতে ক্রিসেন্ট গ্রুপ শুধু ব্যাংকের নথিপত্র জালিয়াতি করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের নথিপত্রও জালিয়াতি করে। এর মধ্যে শিপিং ভুয়া ব্যাক টু ব্যাক এলসি, শিপিং ডকুমেন্ট, কাস্টমস সনদও রয়েছে।
এদিকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের পক্ষ থেকে জনতা ব্যাংকে দেয়া এক চিঠিতে বলা হয়েছে, হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের ফলে কারখানায় চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে তারা ক্রেতার আদেশ অনুযায়ী পণ্য রফতানি করতে পারেনি।

ফলে আগে করা রফতানির মূল্যও ক্রেতারা ঠিকমতো পাঠাচ্ছে না। এতে ক্রেতাদের কাছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি ব্যাংকের রফতানি বিল বিদেশে আটকে রয়েছে। এগুলো ফিরিয়ে আনতে কোম্পানির পক্ষ থেকে ক্রেতাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রিসেন্ট গ্রুপ হংকং ও থাইল্যান্ডের ৯টি প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য রফতানি করেছে। এগুলোর কোনোটির মালিক বাংলাদেশিরাও রয়েছেন। অর্থাৎ ক্রেতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। ফলে পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করে দেশ থেকে টাকা পাচারের পথ তৈরি করা হয়েছে।
ওই সময়ে জনতা ব্যাংক থেকে ক্রিসেন্ট লেদারকে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেয়া হয়। এর মধ্যে নগদ ঋণ দেয়া হয়েছে ২ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। রফতানি বিল বিক্রি করার নামে হাতিয়ে নিয়েছে ১ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য খাতে আরও ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে, যা পরোক্ষ ঋণ নামে পরিচিত।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/84477