বর্জ্য ফেলা এবং দখলের কারণে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদী খালে পরিণত হয়েছে :নাসিম সিকদার
২৮ আগস্ট ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:১৯

দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে বুড়িগঙ্গা

দখল ও দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে বুড়িগঙ্গা। যারা উপকার নিচ্ছে তারাই বুড়িগঙ্গার ক্ষতি করে চলে যাচ্ছে। এক দিকে ভূমিদস্যুরা একের পর এক দখল করে নিচ্ছে বুড়িগঙ্গার তীর; অপর দিকে কলকারখানা, গৃহস্থালি ও মনুষ্যবর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে ঢাকার প্রাণখ্যাত এই নদীর পানি ও পরিবেশ। কখনো কখনো রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভূমিদস্যুদের চোখ বুড়িগঙ্গার দুই তীরের ৩৪ কিলোমিটারে। প্রকাশ্যে চলছে নদী ভরাট। আবার কেউ কেউ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে নিচ্ছে। ভরাটকৃত স্থানেই নির্মাণ করা হচ্ছে বাণিজ্যিক স্থাপনা ও পাকা ভবন। গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্প-কারখানাসহ নানা ধরনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর। এ জন্য উপড়ে ফেলা হয়েছে বুড়িগঙ্গার সীমানা পিলার। নদীর আদি চ্যানেলটির প্রায় পুরোটাই দখলে নিয়েছে দস্যুরা। এসব অবৈধ দখলদারকে সহযোগিতা করছে স্থানীয় কিছু অসাধু রাজনৈতিক নেতা ও বিআইডব্লিউটির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।
সরেজমিন দেখা গেছে, লালবাগের বাগচাঁদখা, লালবাগ, দাপা-ইদ্রাকপুর, ধর্মগঞ্জের আলিরটেক বক্তাবলি, সূত্রাপুর বেড়িবাঁধ, শহর ঢাকা, শ্যামপুর, কদমতলী, মুন্সিখোলা, কেরানীগঞ্জের জিনজিরা (তেলঘাট থেকে জিনজিরা ফেরিঘাট) লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচর, লালকুটি, শ্যামবাজার, আগানগর মিরেরবাগ, নাইয়াটোলা, ধলেশ্বর ও হাছনাবাদসহ বুড়িগঙ্গার দুই তীরে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাড়িঘর। এখনো কোনো কোনো এলাকায় বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে নদী। কোনো কোনো স্থানে নদীর সীমানা পিলার উপড়ে ফেলে দিন দিন নতুন জায়গা দখল করে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে ভূমিদস্যুরা।

দেখা যায়, নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা বাড়িগুলোর পয়ঃনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তারা সরাসরি বুড়িগঙ্গার সাথে লাইন করে দিয়েছে। সেখান থেকে প্রতিদিন মনুষ্যবর্জ্য এসে মিশছে বুড়িগঙ্গায়। দুই পাড়ে হাজার হাজার কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। ওইসব কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য এসে পড়ছে বুড়িগঙ্গার। ঘর গৃহস্থালির যেসব বর্জ্য তা-ও সরাসরি নদীর পানিতে ফেলা হচ্ছে। এর মধ্যে প্লাস্টিকের বোতল ও প্লাস্টিকসামগ্রী রয়েছে। বুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে কিছুক্ষণ চললেই দেখা যাবে শত শত পানির খালি বোতল ভাসছে। আশপাশের বাড়িঘরের বাসিন্দা ও নৌযাত্রীরা এসব বোতল ছুড়ে ফেলছে বুড়িগঙ্গায়।

স্থানীয় লোকজন যে যার বাড়ির সামনে দিয়ে নদীর দিকে আগাচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তাদের যে পোর্ট লিমিট আছে নদীর সীমানার পরেও ১৫০ ফুট, সে জায়গাটায় কোনো কিছু নির্মাণ করতে হলে বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি নিতে হয়। যদি কেউ এই ধরনের ব্যবসায় করে আমরা তাদের উচ্ছেদের মাধ্যমে উঠিয়ে দেই। পরে যদি কেউ না শুনে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
লালবাগ থানা এলাকার ইসলামবাগে বুড়িগঙ্গার জায়গায় তৈরি গ্যারেজে ব্যাটারিচালিত প্রায় ৩০০ রিকশা রাখা হচ্ছে। বিদ্যুৎ লাইন থেকে অবৈধ বিকল্প (বাইপাস) সংযোগ নিয়ে এসব রিকশার ব্যাটারিতে চার্জ দেয়া হয়। বুড়িগঙ্গার সীমানায় বসানো হয়েছে এই গ্যারেজ।

সোয়ারীঘাট থেকে কামরাঙ্গীরচর ব্রিজ হয়ে হাজারীবাগ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলটি নিঃস্ব হয়ে গেছে। বর্তমানে চ্যানেলটি খুঁজে পাওয়া দুরূহ। স্থানীয় সূত্র জানায়, চল্লিশের দশক থেকে এই এলাকায় বুড়িগঙ্গা দখল শুরু হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা শুষ্ক মওসুমে নদীতে ধান চাষ করে তাদের প্রাথমিক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এ সময় সিএস রেকর্ডে পরিবর্তনকাল এনে বিভিন্ন দাগের দখলদার হিসেবে তাদের নাম বসিয়ে দেয়া হয়। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন (দক্ষিণ) থেকে নবাবগঞ্জ হাজারীবাগ, গাবতলী, মিরপুর হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করায় বাঁধটির ভেতরে বুড়িগঙ্গার বিশাল এলাকা পড়ে যায়। জালিয়াতেরা বাঁধের ভেতরেপড়া নদীর জমি পুরোটা গ্রাস করে। স্থানীয়রা বলেছেন, কয়েক বছর আগেও আদি চ্যানেলের ১০ একর সম্পত্তির মতো সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন রয়েছে দু-তিন বিঘা। বাকি সব ভূমি দখলদারেরা নিজের নামে নিয়ে নিয়েছে। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা বলেছেন, আদি চ্যানেলটির মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসন, তাই দেখভালের দায়িত্বও তাদের।

মাঝেমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযান চালায়। কিন্তু উচ্ছেদের কিছু দিনের মধ্যে আবার দখলে নিয়ে নেয় ওইসব দস্যু। নির্মাণ করা হয়েছে কাঁচা-পাকা বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। এসব স্থাপনায় গড়ে তোলা হচ্ছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। সংসদ সদস্য থেকে অনেক প্রভাবশালী আবার এসব স্থাপনায় করছে ফল, সবজির আড়ত, হোটেল, চায়ের দোকান, ইট, বালু, সিমেন্ট ও মাটির রমরমা ব্যবসায়।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/344108