২৭ আগস্ট ২০১৮, সোমবার, ৯:৫৯

এবারও চামড়া নিয়ে ছিনিমিনি

আশিকুল হামিদ : পবিত্র ঈদ-উল আযহার পরপর একটি সংবাদ শিরোনাম দেখে স্তম্ভিত হতে হলোÑ ‘পাটের পর এবার চামড়া’! চামড়ার কথাটা রিপোর্টে এমনভাবেই বলা হয়েছে, যেন ‘এবার’ই প্রথম চামড়া নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে! যেন অতীতে আর কখনো চামড়া নিয়ে মানুষকে তথা কুরবানিদাতা ও ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের বিপদে পড়তে হয়নি! অথচ ‘এবার’ শুধু নয়, প্রতি বছরই কুরবানির পশুর চামড়া নিয়ে যথেচ্ছভাবে ‘বাণিজ্য’ করার কারবার চালানো হচ্ছে। এই কর্মকান্ডে কথিত সিন্ডিকেটের আড়ালে জড়িত থাকছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন।

উদাহরণ দেয়ার জন্য গত বছর, ২০১৭ সালের কথা স্মরণ করা যায়। গতবারের ঈদুল আযহায় ধারণার চাইতে অনেক বেশি পশু কুরবানি দেয়া হলেও সে তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ চামড়া ট্যানারি মালিক এবং চামড়া ব্যবসায়ীদের হাতে যেতে পারেনি। এর কারণ জানাতে গিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছিলেন, বিপুল পরিমাণ চামড়া চোরাচালানের অবৈধ পথে ভারতে পাচার হয়ে গেছে। পাচারের কার্যক্রম চলেছে বেশ কিছুদিন ধরেই। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্ক্রিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছিল, সরকারের বেঁধে দেয়া স্বল্প হারের মূল্যের কারণেই চামড়া ভারতে পাচার হয়ে গেছে। একই কারণে ঈদের বেশ কিছুদিন পর পর্যন্তও পাচারের কার্যক্রম চালিয়েছিল ব্যবসায়ী নামের টাউট লোকজন। ব্যবসায়ীদের উদ্ধৃতি দিয়ে সংগ্রামসহ বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে চামড়ার মূল্য বেশিÑ এমনকি দ্বিগুণেরও অনেক বেশি হওয়ার কারণে মৌসুমী ও প্রান্তিক তথা ক্ষুদে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ট্যানারির এজেন্টরা গত বছর ভারতে চামড়া পাচারের জন্যই বেশি তৎপর থেকেছে।

প্রকাশিত সকল পরিসংখ্যানেই জানানো হয়েছিল, গত বছর ঈদের প্রাক্কালে সরকার ঢাকার জন্য প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরের জন্য প্রতি বর্গফুটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। অন্যদিকে ভারতে তখন প্রতি বর্গফুট অতি নি¤œমানের চামড়ার মূল্যও ছিল ৯০ টাকা, যা বাংলাদেশে নির্ধারিত মূল্যের দ্বিগুণ। আর এই চামড়া মোটামোটি মানসম্পন্ন হলে তার প্রতি বর্গফুটের মূল্য ভারতে আরো বেশি টাকা দেয়া হয়েছে। খাসি ও বকরির ক্ষেত্রেও সরকার অনেক কম মূল্য নির্ধারণ করেছিল। খাসির চামড়ার জন্য প্রতি বর্গফুটে ২০ থেকে ২২ টাকা এবং বকরির চামড়ার জন্য প্রতি বর্গফুটে ১৫ থেকে ১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে ভারতে খাসি ও বকরির চামড়াও সরকার নির্ধারিত এই দরের চাইতে অনেক বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। মূলত সে কারণেই গরু-মহিষ থেকে শুরু করে খাসি, ভেড়া ও বকরি পর্যন্ত কোনো পশুর চামড়াই বাংলাদেশের ট্যানারি মালিক ও চামড়ার প্রকৃত ব্যবসায়ী তথা প্রান্তিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছায়নি। সবই পাচার হয়ে গিয়েছিল ভারতে।

জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই ধারণা করা হয়েছিল, সরকার সম্ভবত ২০১৮ সালে এসে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করবে এবং এমনভাবেই চামড়ার দাম নির্ধারণ করবে, যার ফলে দেশের চামড়া দেশের ভেতরেই থাকবে। অন্তত দামের কারণে ভারতে পাচার হয়ে যাবে না। অন্যদিকে অবস্থা কিন্তু ‘যাহা ৫২ তাহা ৫৩-ই’ থেকেছে। বাড়ানো দূরে থাকুক, এ বছর ঈদুল আযহার প্রাক্কালে সরকার বরং চামড়ার দাম অনেক কম নির্ধারণ করেছিল। প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, ২০১২ সালেও যেখানে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ছিল ৯৫ থেকে ১০০ টাকা, এবার সেখানে নির্ধারণ করা হয়েছিল মাত্র ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে বাড়ানোর পরিবর্তে সরকার নিজেই দাম কমিয়েছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। খাসি ও বকরির চামড়ার ক্ষেত্রে সরকার প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছিল মাত্র ১৫ টাকা। এই দামের ব্যাপারেও কথা রয়েছে। সরকার রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের জন্য যে দাম নির্ধারণ করেছিল, দেশের অন্য সব স্থানের জন্য করেছিল তার চাইতেও অনেক কম।

ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ঢাকায় প্রথম দু’দিন পর্যন্ত চামড়া বিক্রি করা সম্ভব হয়নি বললেই চলে। পাড়া-মহল্লার গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা একদিকে নিজেরাই জোর করে চামড়া নিয়ে গেছে, অন্যদিকে ক্ষুদে ও মওসুমী ব্যবসায়ীরাও চামড়া কিনতে উদ্যোগী হয়নি বরং পাশ কাটিয়ে চলেছে। এমন অবস্থায় গরুর চামড়া গড়ে চার থেকে পাঁচশ’ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। মফস্বলের কোথাও দুই থেকে তিনশ’ টাকার বেশি টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। খাসি ও বকরির চামড়ার দাম ছিল আরো কমÑ ৫০/৬০ টাকার বেশি দাম পাননি কুরবানিদাতারা। রাজধানীর অনেক এলাকায় রাগে-দুঃখে বহু মানুষ খাসি ও বকরির চামড়া রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন। এ ধরনের অনেক খবরই বিভিন্ন দৈনিকে ও অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে একই সিন্ডিকেটের অপতৎপরতার কথা, যার পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার বিশেষ কিছু লোকজনের সমর্থন ও যোগসাজশ। এই সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ কুরবানিদাতারা তো বটেই, এমনকি প্রতিষ্ঠিত অনেক মাদরাসার পক্ষেও সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। চামড়া কিনতে পারেননি বড় বড় ট্যানারির মালিকরাও। নগদ টাকার অভাবকেও বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্ক্রিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা অভিযোগ করেছেন, এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে ঈদের অনেক আগে থেকেই তারা আশংকা প্রকাশ করে আসছিলেন। তারা সেই সাথে দাবি জানিয়েছিলেন, যাতে ট্যানারির মালিকরা প্রান্তিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করে দেন। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়েছে, ট্যানারি মালিকদের কাছে তাদের কোটি কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অন্যদিকে রাজধানীর হাজারিবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর করার খরচ এবং ব্যাংক ও সরকারের কাছ থেকে ঋণ ও নগদ অর্থে সহযোগিতা না পাওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ট্যানারি মালিকরা অগ্রিম দেয়া দূরে থাকুক, বকেয়া টাকারও প্রায় কিছুই পরিশোধ করেননি। এর ফলে দেশের প্রান্তিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরাও মওসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কিনতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর পাশাপাশি ছিল সরকারের নির্ধারণ করে দেয়া মূল্য, যা ভারতের বাজার দরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। একই কারণে একদিকে বিপুল পরিমাণ চামড়া ভারতে পাচার হয়ে গেছে ও যাচ্ছে, অন্যদিকে লালবাগের পোস্তাসহ দেশের কাঁচা চামড়ার বাজারে চামড়া আসেনি বললেই চলে।

পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ থাকে গরুর চামড়া। খাসি ও ছাগলের চামড়া থাকে ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ। বাকি চামড়া আসে ভেড়া ও মহিষের। এসব চামড়ার বেশির ভাগই পাওয়া যায় ঈদুল আযহার সময়। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটেছে। চামড়া শুধু কমই আসেনি, ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিগত একশ বছরের মধ্যে এ বছরই সবচেয়ে কম চামড়া পেয়েছেন তারা। অবস্থায় পরিবর্তন না ঘটানো গেলে দেশকে চামড়ার প্রচন্ড সংকটে পড়তে হবে, যার ফলে দেশের ট্যানারি শিল্পের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হবে বলে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন। এক সংবাদ সম্মেলনে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এর নেতারা ট্যানারি মালিকদের যথেষ্ট পরিমাণে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, অতীতে ঈদুল আযহার প্রাক্কালে বিভিন্ন ব্যাংক ট্যানারি মালিকদের চার থেকে পাঁচশ’ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিত। এক বছর আগেও দুইশ থেকে আড়াইশ’ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া গিয়েছিল। এই ঋণের অর্থ দিয়েই তারা প্রান্তিক ও মৌসুমী ব্যবসায়ীসহ আড়তদারদের চামড়ার জন্য অগ্রিম টাকা দিতেন। কিন্তু এ বছর কোনো ঋণই পাননি ট্যানারি মালিকরা। একই কারণে তাদের পক্ষেও কাউকে অগ্রিম টাকা দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে প্রান্তিক ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া ভারতে পাচার করেছে। এখনো তারা ভারতের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের পক্ষ থেকে চোরাচালান প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া হলেও চামড়া চোরাচালান পরিস্থিতি এরই মধ্যে অত্যন্ত বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে চোরাচালানের যেসব কারণের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর প্রতিটিকেই সঠিক এবং যুক্তিসঙ্গত মনে করা হচ্ছে। মূল্য নির্ধারণের আগে সরকারের উচিত ছিল এই সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রাখা যে, লাভজনক মূল্য না দেয়া হলে চামড়া ভারতে চোরাচালান হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বিষয়টিকে পাশ কাটানোর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ভারতের স্বার্থেই সুকৌশলে ভূমিকা পাল করেছেন। একই কারণে প্রায় সব চামড়াই ভারতে পাচার হয়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে। ট্যানারি মালিকরা বলেছেন এবং দেশপ্রেমিক পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন, এখনো চোরাচালান প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট সময় রয়েছে। সরকারের উচিত বিভিন্ন ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া, তারা যাতে ট্যানারির মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দেয়ার দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। চোরাচালান প্রতিহত করার জন্য র্যা ব ও পুলিশসহ আইন-শৃংখলা বাহিনীগুলোকেও তৎপর করে তোলা দরকার। একথা বুঝতে হবে যে, চোরাচালান প্রতিহত না করা গেলে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। বন্ধ হয়ে যাবে সকল কারখানা। সুতরাং চোরাচালানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার সময় নষ্ট না করে। কুরবানিদাতা এবং ক্ষুদে ও মওসুমী ব্যবসায়ীদের জন্য চামড়ার ন্যায্য তথা লাভজনক মূল্যও নিশ্চিত করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/343036