২৬ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ৯:৫১

নানামুখী ষড়যন্ত্রে পাট শিল্পের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে ট্যানারি

দেশী-বিদেশী নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার চামড়া শিল্প। আর এ ষড়যন্ত্রকারীদের মদদে প্রভাবশালী সংঘবদ্ধ চক্রের কারণে কুরবানির পশুর চামড়ার দরে এবার ধস নেমেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের লাখ লাখ কুরবানিদাতার পাশাপাশি হাজারো চামড়া সংগ্রহকারী। তারা এ জন্য আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের দোষ দিচ্ছে। কাঁচা চামড়ার বাজারে এমন ধসে পাচারের আশঙ্কা খোদ ট্যানারি এসোসিয়েশনের। চামড়া শিল্পও পাট শিল্পের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কাছে হেরেই পাট শিল্পের ঐতিহ্য হারায় বাংলাদেশ। লোকসানের মুখে একে একে সব সরকারি পাট কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বৈদেশিক মুদ্রা হারায় বাংলাদেশ। এখনও এই প্রতিকূল পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ।
এখন আবার নতুন করে বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে চামড়া শিল্প নিয়ে এই চক্র মেতে উঠেছে। তারই অংশ হিসেবে তারা গত কয়েক বছর ধরে চামড়া শিল্পে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। গত পাঁচ বছরেই চামড়ার দাম কমেছে অর্ধেক। অথচ চামড়া এবং চামড়াজাত সকল পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। তাহলে দাম কমছে কেন।
প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ট্যানারি মালিকরা কেন চামড়া কিনছে না। কেন তারা আড়তদারদের বকেয়া পরিশোধ করছে না। আর সরকার কেন জোর করে প্রস্তুত নয় এমন স্থানে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করলো। এসব প্রশ্নের জবাব কে দেবে।

ট্যানারি শিল্প প্রস্তুত বিসিকের এমন রিপোর্টের ভিত্তিতে তখন আদালত রায় দিলো কারখানা স্থানান্তর না হলে প্রতি দিন ১ লাখ টাকা জরিমান দিতে হবে। বাধ্য হয়ে তারা সাভারে কারখানা স্থানান্তর করলো। কিন্তু সেখানে তারা এখনও কারখানা চালু করতে পারেনি। আর কারখানা স্থানান্তরের আজুহাতে গত কয়েক বছর ধরে তারা চামড়া কিনতে পারছে না। এতে করে চামড়ার দাম কমে যাচ্ছে। প্রতিবেশি দেশে চামড়া পাচার হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দাম কমিয়ে কোনভাবে পাচার ঠেকানো যাবে না। যেখানেই দাম পাওয়া যাবে সেখানে চামড়া চলে যাবে। এতে আমাদের কিছুই করার নেই। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, সারা বিশ্বে কোথায় স্বর্ণ আমদানি হয় না। যেখানে দাম বেশি সেখানে স্বর্ণ পাচার হয়ে যাচ্ছে। তা কিভাবে কেউ জানে না। আর এই পাচার কোন দেশের সরকার ঠেকাতেও পারছে না।
সরকার দাম কমিয়ে চাইলেই সীমান্তে পাচার ঠেকাতে পারবে না। লবণযুক্ত চামড়া দুই- তিন মাস পরেও পাচার করা যাবে। এতে চামড়ার কোন মানের ক্ষতি হবে না। সরকার ২০/৩০ দিন সীমান্ত পাহারা দিয়ে কি হবে। কোন লাভ হবে না।

শুক্রবার ও শনিবার রাজধানীর চামড়ার বাজার পোস্তা ও লালবাগের চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া যায় প্রায় পানির দরে চামড়া বেচাকেনার তথ্য। সবারই অভিযোগ, এমনকি সরকারি দরও অনুসরণ করেনি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। ক্ষতির জন্য মাঠপর্যায়ের ক্ষুদ্র ক্রেতারা দূষছে আড়তদারদের, আর আড়তদাররা বলছে তাদের হাত-পা বাঁধা ট্যানারি মালিকদের কাছে। বিশেষজ্ঞরাও এই পরিস্থিতির জন্য ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে পোস্তায় চামড়া বিক্রি করতে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রফিজ উদ্দিন বলেন, ট্যানারি মালিক ও কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে গত ৩০ বছরের মধ্যে এবারই তিনি সর্বনিম্ন মূল্যে কাঁচা চামড়া বিক্রি করেছেন। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তারা যে দামে চামড়া কিনেছেন, আড়তদারদের কাছে এর চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে।
প্রতিবছর কুরবানির সময় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চামড়া কিনে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন শান্তিনগরের বাসিন্দা মোহাম্মদ হেলাল মিয়া। তিনি বলেন, একেকটা গরুর চামড়া কিনছি ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়। আড়তদাররা সেই চামড়ার দাম ৫০০ টাকার বেশি দিতে চায় না। কী করব, ঠিক বুঝতে পরছি না। লালবাগে কথা হয় মওসুমি চামড়া ব্যবসায়ী মিরপুরের বাসিন্দা মো. মোর্শেদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে ১০০টির মতো চামড়া কিনেছি। যে দামে কিনছি, তার অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
পোস্তগোলার আড়তদার মো. সোলায়মান বলেন, চামড়া সংগ্রহকারীরা বাড়তি দাম চাইলে তা দেয়া সম্ভব না। ট্যানারির মালিকরা কত দিয়ে চামড়া কিনবে তা আগেই জানিয়েছে। এবারে কেনা আর বেচায় পার্থক্য এত কম যে কোনো লাভ থাকছে না।

পোস্তার কাঁচা চামড়ার আড়তদার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া টাকা আটকে থাকায় আমরা এবার সরকারি দামে চামড়া কিনতে পারিনি। এ ছাড়া ট্যানারি মালিকরা আমাদের টাকা না দিয়ে সরাসরি নিজেদের মানুষ দিয়ে চামড়া সংগ্রহ করছে। এতেও বাজারে এমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি জানান, পোস্তার বাজারের খুচরা ক্রেতাদের প্রায় ১৫০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা আছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। ১০-১২ বছর ধরে তারা এ টাকা আটকে রেখেছে। এর ফলে তিন থেকে সাড়ে তিন শ আড়তদার এবং এর সঙ্গে কয়েক হাজার ব্যবসায়ী এবার সংকটে পড়েছে। মাঠপর্যায়ে চামড়ার দর সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রতি পিস মাঝারি চামড়া কিনেছে ৫০০ টাকায় (২০-২২ বর্গফুট)। সর্বোচ্চ বড় চামড়া কিনেছে এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকায়।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশন সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, টাকার অভাবে এবার চামড়ার বাজারে এমন ধস নেমেছে। কয়েক বছর ধরে ট্যানারি মালিকরা আড়তদারদের তিন থেকে সাড়ে তিনশ’[ কোটি টাকা আটকে ফেলেছে।
সিন্ডিকেট করার অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, চামড়ার দরপতনে সরাসরি ট্যানারি মালিকদের কিছুুই করার থাকে না। তিনি বলেন, প্রথমে পাড়া-মহল্লায় কিছু মওসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনে ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে। ফড়িয়ারা বিক্রি করে আড়তদারদের কাছে। কিন্তু ফড়িয়ারা ঠিক নিয়মে চামড়া সংরক্ষণ না করে নিজেরা কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।

তিনি দাবি করেন, সরকারি দাম অনুসারে আমরা চামড়া কিনি এবং অনেক সময় একটু বেশি দাম দিয়েও কিনে থাকি। আড়তদারদের টাকা আটকে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টাকা বকেয়া রাখা ব্যবসায় নতুন কিছু নয়। এ ছাড়া সাভারের ট্যানারি পল্লীতে ১৫০ ট্যানারির মধ্যে মাত্র ৫০টি কারখানা উৎপাদনে যেতে পেরেছে। যেসব ট্যানারি উৎপাদনে যেতে পারেনি, ওই সব ট্যানারি ব্যাংকঋণও পায়নি। এবার মাত্র ৪২টি প্রতিষ্ঠান ঋণ পেয়েছে। ফলে বাজারে নগদ টাকার একটি সংকট ছিল। আড়তদার ছাড়াও সরাসরি চামড়া কিনছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবছরই কিছু কিছু এতিমখানা থেকে চামড়া কিনি। এরা সারা বছরই আমাদের কাছ থেকে টাকা নেয়। বছর শেষে কিছু চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এটা খুব বেশি নয়। মাত্র ২-৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড এক্সপোর্টার এসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের প্রধান ক্রেতাদের অন্যতম চীন। এবারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। চীন কম দামে পণ্য কেনার আলটিমেটাম দিয়েছে। তাই কোনোভাবেই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কাঁচা চামড়া কেনা সম্ভব নয়। এ ছাড়া নতুন ট্যানারি নির্মাণ করায় পুঁজির সংকটে আছে ট্যানারি মালিকরা। এবারে ৪২টি ট্যানারি কাঁচা চামড়া কিনতে ৬০১ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ পেয়েছে। বাকিরা কী করবে?
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রতিবছরই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কুরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কমে কিনতে চেষ্টা করে। অর্থসংকট থাকে তাদের বড় ইস্যু। অথচ সরকার প্রতিবছর ব্যবসায়ীদের ঈদুল আযহায় গড়ে ৫০০ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ দেয়। সাভারে কারখানা নির্মাণেও আর্থিক সহযোগিতা করেছে। তাই অজুহাতগুলো সম্পূর্ণ সঠিক নয়। শিল্প খাতের এ বিশ্লেষক বলেন, কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রিতে একটি চেন আছে। ট্যানারির মালিকরা দাম কম দিলে অন্যরাও কম দিতে বাধ্য হয়। তবে ট্যানারি মালিকরা বিশ্ববাজারে ভালো দামে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করলেও আড়তদার, চামড়া সংগ্রহকারী, যিনি পশু কুরবানি করছেন তাদের সে সুযোগ থাকে না। কুরবানির পশুর দাম কমালে তাদের লাভও কমে যায়।

এদিকে কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)। এতে করে চামড়া পাচারের আশঙ্কা বাড়বে। এ অবস্থায় আগামী একমাস সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটির নেতারা। গতকাল শনিবার নগরীর ধানমন্ডিতে বিটিএ অফিসে চামড়ার চলমান সংকট নিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিটিএ’র সভাপতি শাহিন আহমেদ এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
শাহিন বলেন, চামড়া শিল্পে ক্রান্তিকাল চলছে। বেশিরভাগ ট্যানারি উৎপাদনে নেই। গত বছরের ৪০-৪৫ শতাংশ চামড়া এখনও অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। চামড়া শিল্পের এমন দশার নেপথ্যে রয়েছে সরকারি সহায়তা না থাকা আর পুঁজি সংকট।
বিটিএ সভাপতি আরও বলেন, সাভারে পরিকল্পিত ট্যানারি শিল্প গড়ে না উঠার দায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক)। ভুল তথ্য দিয়ে ট্যানারি মালিকদের সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছিলো। বার বার সময় বাড়িয়েও এ পরিকল্পিত শিল্প নগরীর কাজ শেষ না হওয়ার দায় বিসিকের।
আগামী বছরের জুনেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের কাজ শেষ হবে না বলে শঙ্কা ট্যানারি এসোসিয়েশনের। কাঁচা চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করে বিক্রি করতে আসায় দাম পাচ্ছেন না মওসুমী ব্যবসায়ীরা।

http://www.dailysangram.com/post/342904