২৬ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ৯:৪২

রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ, ফেরার আকুতি

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে উখিয়া-টেকনাফ। গত বছর ২৫শে আগস্ট তাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের দিনটি গণহত্যা দিবস হিসাবে পালন করে তারা। বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে হাজার হাজার আশ্রিত রোহিঙ্গা মিছিলের আগে সমাবেশ করেন। সেখানে তারা মিয়ানমার সরকারের বিচার, রাখাইনে ফেরার পরিবেশসহ বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেন। নাগরিকত্বসহ দাবি-দাওয়া মেনে স্বদেশে ফেরার আকুতি জানান। ওদিকে এক বছর হয়ে গেলেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া থেমে আছে।
টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকাল থেকে টেকনাফের রইক্ষ্যং পুটিবনিয়া, হ্নীলার আলীখালী, লেদা, নয়াপাড়া, শালবন, জাদিমোরা, দমদমিয়া ও বাহারছড়ার শামলাপুর বস্তিতে রোহিঙ্গারা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।
বিক্ষোভ মিছিলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নরনারী অংশগ্রহণ করেছেন।

রোহিঙ্গাদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে ১০০ নারীকে ধর্ষণ, ৩০০ গ্রাম নিশ্চিহ্ন, ৩৪ হাজার শিশু এতিম, ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আরাকান রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত ও ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যার বিবরণ তুলে ধরেন। তারা ।
পুটিবনিয়া এবং শালবনে রোহিঙ্গাদের বিশাল বিক্ষোভ মিছিল তাদের ক্যাম্প ও অভ্যন্তরীণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
নয়াপাড়া শালবন ক্যাম্পের প্রায় ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মিছিল সহকারে নয়াপাড়া রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পে গিয়ে সেখানকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিলিত হয়। মিছিলের আগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শালবন প্রধান মসজিদে এক সংক্ষিপ্ত প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে রোহিঙ্গা নেতা জাকারিয়া বক্তব্য রাখেন।

এসময় তিনি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতার নেত্রী সম্বোধন করে ধন্যবাদ জানান এবং এদেশের সেনা, বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও উখিয়া-টেকনাফের মানুষের প্রতি ধন্যবাদ জানান।
বক্তব্যে তিনি মিয়ানমার সরকারের বিচার, সেদেশে ফেরার পরিবেশসহ বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেন। এসময় নাগরিকত্বসহ দাবি-দাওয়া মেনে তারা স্বদেশে ফিরতে চাই বলেও বক্তব্য রাখেন।
এসময় উপস্থিত রোহিঙ্গারা হাত তুলে বিভিন্ন স্লোগানে পুরো ক্যাম্প মুখরিত করে তোলে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি অস্থায়ী শিবিরে জীবনযাপন করছে। গত বছর ২৫শে আগস্ট দেশটির রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসব শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলেও এভাবে অনিশ্চিত ভাসমান অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে চান না তারা।

মো. লালু নামে শালবন ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা জানান, ইতিমধ্যে ৩ বার রোহিঙ্গারা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বারবার দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু নতুন করে নির্যাতন শুরু করে। গেল আগস্টেও একইভাবে বর্বর নির্যাতন চালায়। এইবারও আমরা স্বদেশে ফিরতে চাই। তবে পূর্ণ নাগরিকত্ব দিতে হবে। আর রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

একই ক্যাম্পের যুবক মো. আলী জানান, আমাদের খুব বেশি নির্যাতন করেছে। নির্যাতন সইতে না পেরে আমরা পালিয়ে আসি। তবে দেশের জন্য আমাদের প্রাণ কাঁদে। আমরা দেশে ফিরতে চাই। তবে আমাদের নেতারা যে দাবি দিয়েছে তার সঙ্গে আমরা একমত। সেই দাবি মানতে হবে। টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রণজিৎ কুমার বড়ুয়া জানান, অনুমতি সাপেক্ষে রোহিঙ্গারা প্রতিবাদ সমাবেশ ও শোক পালন করছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, রোহিঙ্গা ঢলের একবছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল। গেল বছর ২৫শে আগস্ট এক সন্ধ্যায় মিয়ানমার সীমান্তে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। স্থানীয় বিজিবি কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, নাফ নদীর তীরে মানবতার আর্তনাদ! টেকনাফ থেকে উখিয়া, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তমরু সীমান্ত পর্যন্ত তখন নারী ও শিশুদের ঢল। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে নারী ও কিশোর-কিশোরীরা বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টায়। কয়েকজনকে আটকও করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে গোয়েন্দা তথ্য, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সূত্রে এটি স্পষ্ট হয় যে, রাখাইনে বাছ-বিচারহীনভাবে তাণ্ডব চালাচ্ছে বর্মী বাহিনী। রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, গণহত্যা তথা জাতিগতভাবে একটি জাতিকে নির্মূলে যা করা দরকার তাই করছে বর্মীরা। সীমান্তের নো-ম্যান্সল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া নারী ও শিশুদের বাংলাদেশের দিকে তাড়াতে তখন পাহাড়ে পাহাড়ে বর্মী সেনা এবং তাদের সহযোগী যুবকদের টহল জোরদারের খণ্ড চিত্রও ধরা পড়ে বাইনোকুলারে। পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠে বাংলাদেশে পাড়ি দিতে নাফ নদীতে কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনায়। মানবিক কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা যাওয়ার পর স্থানীয়রা প্রাণভয়ে সহায় সম্বল ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের রক্ষায় তৎপর হয়ে ওঠে।

সারা দেশ থেকেই তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হয়। ত্রাণ কার্যক্রমে সরকারের সক্রিয় সম্পৃক্ততায় এবং পরবর্তীতে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ায় এক ছাতার নিচে আসে ত্রাণ ও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ কার্যক্রম। সীমান্ত এবং হৃদয় খুলে দিয়ে গোটা দুনিয়ায় মানবতাবাদী জাতি হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীও প্রশংসিত হন আন্তর্জাতিকভাবে। বাংলাদেশ নতুন-পুরাতন মিলে এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়দাতা রাষ্ট্র। রোহিঙ্গাদের রিফিউজি বা শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে কি হবে না- তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিশ্ব সম্প্রদায়ের মূল্যায়নে বাংলাদেশ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট মোকাবিলা করছে। মিয়ানমারের তরফে এ সংকটকে পুঁজি করে নানা রকম উস্কানি ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ তাতে পা দেয়নি।

মানবিক সংকটটি মানবিকভাবে মোকাবিলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। অবশ্য এতে পাশে রয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়। ঢাকার তরফে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বৈশ্বিকভাবে চাপ বাড়ানোর চেষ্টাও রয়েছে। গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বৈশ্বিক প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু মিয়ানমার বরাবরই গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বাংলাদেশের উদ্যোগকেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ করার অপকৌশল নিয়েছে।

রোহিঙ্গারাও ফিরে যেতে চায় তাদের স্ব-ভূমে। তাদের ফিরার আকুতি আছে। বাংলাদেশও তা-ই চায়। দুনিয়াবাসীও সেটিই দেখতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য একবছরেও মিয়ানমারের তরফে প্রত্যাবাসন প্রস্তুতিতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই!
রোহিঙ্গা ঢলের এক বছর, ঘটনাপঞ্জি: রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের ওপর হামলা চালায়। সেই হামলায় মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের ১২ জন সদস্য নিহত হয়। মিয়ানমার সরকার দাবি করে যে, ভোররাতে একযোগে ২০টির বেশি পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়েছে। মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন অঞ্চলের ওই সব হামলাকে কেন্দ্র করে বর্মী সরকার গোটা রাজ্যজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। বর্মী সেনাবাহিনীর ওই অভিযানে স্থানীয় উগ্রপন্থি বৌদ্ধ যুবকরাও যুক্ত হয়। সেনাসদস্য এবং তাদের সহযোগী উগ্রপন্থিদের বর্বর আক্রমণে ২৫ শে আগস্ট ২০১৭ কয়েক হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফ সীমান্তে এসে আশ্রয় নেয়। তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে। ২৬শে আগস্ট রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের দূতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে উদ্বেগ জানানো হয়। একই দিন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঢোকার চেষ্টা করায় বেশকিছু রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি। সে সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার জন্য সীমান্তের অপরপাশে অপেক্ষা করতে থাকে। ৩১শে আগস্ট এক সপ্তাহ পূর্ণ হয়।

সে সময় এক রিপোর্টে দেখানো হয়- ৭ দিনে প্রায় ২৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের বরাতে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। ৩রা সেপ্টেম্বর মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি রাখাইনের পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। মিস লি মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি’র কঠোর সমালোচনা করেন। ৫ই সেপ্টেম্বর রাখাইন অঞ্চলের পরিস্থিতিকে বিকৃতভাবে তুলে ধরা হচ্ছে বলে মন্তব্য করে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয় মিয়ানমারে। দেশটির কার্যকর নেতা স্টেট কাউন্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সুচির সঙ্গে পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের কথা হয়। দুই নেতার টেলিফোনে আলোচনার পর মিস সুচি’র দপ্তর থেকে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। একই দিন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি ঢাকায় আসেন। তার আগে তিনি মিয়ানমার সফর করেন। ৬ই সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে চিঠি লিখেন মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাঁ। পরদিন (৭ই সেপ্টেম্বর) বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নর-নারীদের দেখতে বাংলাদেশে আসেন তুরস্কের ফার্স্টলেডি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তারা উভয়ে সরজমিন কক্সবাজারের উখিয়ায় গিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও মানবিক পরস্থিতি দেখেন। সেখানে ত্রাণ সহায়তাও পৌঁছে দেন।

১১ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়নকে জাতিগত নিধনের উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করে। পরদিন (১২ই সেপ্টেম্বর) রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরজমিন দেখতে কক্সবাজারের উখিয়ায় যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সরকারের সর্বাত্মক উদ্যোগের কথা জানান। মানবিক বিবেচনায় সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। সরকার প্রধানের পরিদর্শনের পরদিন (১৩ই সেপ্টেম্বর) মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে ঢাকায় কর্মরত প্রায় অর্ধশত বিদেশি কূটনীতিক ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা কক্সবাজার সফর করেন। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর বৈশ্বিক চাপ তৈরির যে চেষ্টা বাংলাদেশ শুরু করেছে তারই অংশ হিসেবে বিদেশি কূটনীতিকদের বিশাল এই দলটিকে কক্সবাজার নিয়ে যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সকালে একটি বিশেষ বিমানে করে তাদের নেয়া হয় কক্সবাজারে।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইওরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, ভারত, সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতসহ কক্সবাজার সফরকারী কূটনীতিকরা নো-ম্যান্সল্যান্ডসহ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের মুখেই তারা বর্বরতার লোমহর্ষক বর্ণনা শুনেন। সেই দিনে কূটনীতিকদের নিজের ওপর বয়ে যাওয়া নির্যাতনের চিহ্ন দেখিয়ে এক কিশোরের আকুতি ছিল এমন “দেখুন, হনডইল্লা জুলুম অইয়ে”। ২১শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা সংকটের বিস্তারিত তুলে ধরে এর সমাধানের জন্য পাঁচ দফা সুপারিশ উত্থাপন করেন। শেখ হাসিনার উত্থাপিত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল- রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা, মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা।

২৭শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম’র হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যায়। রোহিঙ্গা ঢলের শুরুর ৩৪ দিনে বাংলাদেশে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। ২৯শে সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। দীর্ঘ আট বছর পর এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং ফ্রান্সের উদ্যোগে ওই বৈঠক হয়। বৈঠকে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হেলি মিয়ানমারের কড়া সমালোচনা করেন। ৬ই অক্টোবর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা সংকটের অবসান চেয়ে একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি রাখাইনে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর ওপর নৃশংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধের জোরালো দাবি জানায় জাতিসংঘ তথা বিশ্ব সম্প্রদায়। বিবৃতিতে চীনেরও সম্মতি ছিল। এটি ছিল রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিবৃতি। মিয়ানমারের ওপর বৈশ্বিক চাপ বাড়ার প্রেক্ষাপটে ১৮ই অক্টোবর রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা ও মধ্যস্থতার প্রস্তাব নিয়ে ঢাকা আসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকা সফরে আসেন। ঢাকায় তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও সংলাপের মধ্য দিয়ে সংকট সমাধানের তাগিদ দেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

চীনের দেখানো সেই পথ ধরে প্রায় এক মাস আলোচনা চলার পর ২৩শে নভেম্বর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের পর যারা রাখাইনের বাসিন্দা বলে নিশ্চিত তথ্য প্রমাণ দেখাতে পারবে তাদের ফেরত নেয়া হবে। প্রত্যাবাসন বিষয়ক ওই চুক্তিতে বলা হয়- বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়া হবে। যেদিন থেকে তাদের যাওয়া শুরু হবে সেই থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি শেষ হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে ৩০০ করে সপ্তাহে ৫ দিনে ১৫০০ আর মাসে গড়ে ৬ হাজার রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন হলে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে অর্থাৎ ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরাতে সময় লাগবে কমপক্ষে ৯ বছর! তখন ঢাকার কর্মকর্তারা ব্যাখ্যা দেন শুরুতে ৩০০জন প্রতিদন এবং সপ্তাহে ১৫০০ টার্গেট ধরা হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হলে এটি নিশ্চিতভাবে বাড়বে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ২২শে জানুয়ারির সেই প্রত্যাবাসন শুরুর টার্গেট ধরা হলেও আজ অবধি ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও সেটি শুরু করা যায়নি। মিয়ানমারের ওপর বৈশ্বিক চাপ বাড়ার মুহূর্তে বেইজিংয়ের পরামর্শে দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তি সই নিয়ে যখন কূটনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঠিক সেই সময়েই মিয়ানমার ও বাংলাদশ সফর করেন রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। মিয়ানমার সফরের পর ৩০শে নভেম্বর তিন দিনের সফরে তিনি ঢাকায় পা রাখেন। ১লা ডিসেম্বর রাজধানীর কাকরাইলে বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের প্রধান গির্জায় এক অনুষ্ঠানের কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ক্যাম্প থেকে বাছাই করা রোহিঙ্গাদের একটি দলকে ঢাকায় আনা হয়।

অনুষ্ঠান মঞ্চেই তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখানে বক্তৃতায় পোপ ফ্রান্সিস রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ না করলেও কিংবা মিয়ানমার সফরে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণে বাধা থাকলেও তাদের সঙ্গে মতবিনিময় কালে তিনি প্রথমবারের মতো ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার পায় ১৬ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য ৮০৩২ রোহিঙ্গার একটি তালিকা বার্মার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হয়। ঢাকায় দু’দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এই তালিকা হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে সে তালিকা থেকে মাত্র ৩৭৪ জনকে নিতে রাজি হয় মিয়ানমার। ২৯ শে এপ্রিল রোহিঙ্গাদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে। বাংলাদেশ ছেড়ে যাবার আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দলটি আবারো বলেছে, রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধান হবে না।এ সফরের সময় রাশিয়ার প্রতিনিধি বলেছেন রোহিঙ্গা সংকটের কোনো জাদুকরী সমাধান নেই। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী এবং ১০টি অস্থায়ী সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা এ দলে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=132243