২৫ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ৪:০৭

নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাওয়া আত্মবিনাশী পদক্ষেপ

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী ; আমার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করি যে, মুসলিমদের অনেকেই জানেন না, আলহামদুলিল্লাহ, সুবহান আল্লাহ, আল্লাহু আকবর, জাযাক আল্লাহ, বারাক আল্লাহ, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ইত্যাদি শব্দবন্ধ কোথায় এবং কখন বলতে হয়। এমন হওয়া মুসলিমদের জন্য লজ্জার এবং দুর্ভাগ্যের। এ স্ট্যাটাস পড়ে গোরা ঘোষ নামক কোলকাতার এক বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘এগুলো বলা বা মেনে চলা কি বাঙালির জন্য জরুরি?’

আমি ওর প্রশ্নের জবাবে বলি, নিশ্চয়ই। মুসলিমদের জন্য এগুলো অবশ্যই জরুরি। কারণ এগুলো হচ্ছে দু’আ। এসব মুসলিম সংস্কৃতির অনিবার্য অনুষঙ্গ। তবে আপনারা তো চানই যে, মুসলিমরা নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তথা তাহজিব তামুদ্দুন ভুলে যাক এবং ভারতীয় সংস্কৃতির অনিবার্য অনুষঙ্গ পুজোপার্বণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ুক। গোরা ঘোষ উষ্মা প্রকাশ করে আবার বলেন, আমি নাকি ভাষার মধ্যে ধর্ম টেনে এনেছি। 
আমি এরপর গোরা ঘোষকে বলতে বাধ্য হই যে, ধর্ম অবশ্যই ভাষা ও সংস্কৃতির অঙ্গ। মানুষের ভাষা, কথাবার্তা, চালচলন, আচার, আচরণ ইত্যাদিতে ধর্মবোধ ও বিশ্বাসের প্রভাব বা ছাপ থাকবেই। থাকতেই হবে। এছাড়া কোনও জাতি বা সম্প্রদায় টিকে থাকতে পারে না। কোনও সমৃদ্ধ সভ্যতাও গড়ে ওঠে না।
একজন মুসলিমের সঙ্গে কোথাও দেখা বা ফোনে কথা হলে প্রথম জন সালাম দেন। বলেন, আসসালামু আলাইকুম। অর্থাৎ আপনার বা আপনাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। জবাবে অন্যজন বলে ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এবং আপনার বা আপনাদের ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক। মুসলিমদের এই সালামবিনিময় সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে যে কতটা অবদান রাখতে সক্ষম তা অনেকের মাথায়ই আসে না। এতো সুন্দর ও অর্থবহ সম্ভাষণপদ্ধতি আর কোনও সমাজে খুঁজে পাওয়া সত্যই বিরল।

এ পোস্ট যখন লিখছিলাম, তখন আমার মরহুম বন্ধু কাজী রফিউদ্দিনের গুণবতী কন্যা লিখি কাজী একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানান যে, এক ভদ্রলোক কুরবানির গরু কিনতে হাটে যাচ্ছেন আর বলছেন, আজ তিনি সবচেয়ে বড় গরুটাই কিনবেন। সঙ্গে থাকা সহকারী বলছেন, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। তখন ভদ্রলোক বলেন, পকেটে টাকা আছে, অসুবিধে নেই। বড় গরুটাই কিনবো আজ।
হাটে গরু কিনে যখন দাম পরিশোধ করতে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখেন টাকা নেই। মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার করে বলছেন, ইন শায়া আল্লাহ আমার পকেট মাইর গেছে। বিপদে পড়লে বা কোনও ক্ষতির মুখোমুখি হলে মুসলিমদের বলতে হয় ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কিন্তু কুরবানির গরুকেনার টাকা হারিয়ে ভদ্রলোক বলছেন, ইন শায়া আল্লাহ। বুঝেছেন ব্যাপার কী? তার মানে হচ্ছে ‘ইন্না লিল্লাহ’ কিংবা ‘ইন শায়া আল্লাহ’ এই শব্দবন্ধের অর্থ ওই লোকের জানা নেই। অন্যকে বলতে শুনেছেন, তাই তিনিও বলছেন। মানে ভদ্রলোক একজন আস্ত ‘শোনাউল্লাহ’। যা শোনেন তাই বলেন। কোন কথা কোথায় এবং কখন বলতে হয় তা তিনি জানেন না। অর্থও বোঝেন না। আমাদের বেশিরভাগ মুসলিম এখন এমনই শোনাউল্লাহ। এই শোনাউল্লাহরা যেখানে বলতে হবে সুবহান আল্লাহ অথবা আল্লাহু আকবর, সেখানে বলে আমিন। যেখানে বলতে হবে ইন্না লিল্লাহ, সেখানে বলে আলহামদুলিল্লাহ অথবা আমিন। কবরস্থানে অথবা কোনও গাছের গোড়ায় ফুলের স্তুপ দেখলে বলা উচিত আস্তাগফিরুল্লাহ অথবা নাউজুবিল্লাহ। কারণ এমন কর্মকা- কেবল মুশরিকরা করতে পারে। তাই এসব থেকে মুসলিমদের তওবা করে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত। অথচ তারা এসব দেখে বলে আমিন। এখন বলুন আমাদের মূর্খতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!
কয়েক দিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে দু’জন মুসলিম সাংবাদিক যেখানে বলতে হবে আল্লাহ, সেখানে দিব্যি বারবার বলে গেলেন সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ আর সৃষ্টিকর্তা কি এক বা সমার্থক? সৃষ্টিকর্তাতো মানুষও হতে পারে। যেমন: বরাহসময় নামে আমি একটা কবিতার বই লেখেছি। নিশ্চয় আমি এ বইয়ের সৃষ্টিকর্তা। তাহলে আমি সৃষ্টিকর্তা আর আল্লাহ কি এক? নিশ্চয়ই না। আসলে এই তথাকথিত শিক্ষিত জন বা সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা আল্লাহর মাঝে সাম্প্রদায়িকতার দুর্গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন। তাই তারা আল্লাহ অফ করে সৃষ্টিকর্তা, প্রভু অন করেছেন। কোলকাতার গোরা ঘোষ প্রভুরা তাদের এমনটাই শেখাচ্ছেন। বোঝাচ্ছেন। আত্মস্থ করাচ্ছেন।

মুসলিমরা আযান হলে মসজিদে যায় সালাত আদায়ের জন্য। শুক্রবার জুমার সালাত পড়ে। রমযানে সিয়াম পালন করে। ঈদে আনন্দ উৎসব করে। ঈদুল আযহায় সামর্থ্যবানরা পশু কুরবানি দেয়। এগুলো যেমন দীনের অনিবার্য অংশ, তেমনই সংস্কৃতিরও। মুসলিমদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচরণ, এমনকি পানাহার পদ্ধতিও স্বতন্ত্র। মুসলিমরা শরিয়া মোতাবেক হালাল খাবার খাবে। হালাল উপায়ে খাবে। খাবার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলে খাবে। খাওয়া শেষ হলে বলবে আলহামদুলিল্লাহ। এগুলো মুসলিমদের নিজস্ব কালচার বা সংস্কৃতি। অন্যরা এসব বলে না। বলবার নির্দেশনা নেই। বাধ্যকতাও নেই। খাওদাও ফুর্তি করো। কিন্তু মুসলিমরা খাবার সময়ও হিসেব করে খাবে। অপচয় করতে পারবে না। খাবার নষ্ট করতে পারবে না। এগুলো যেমন শরিয়তের হুকুম, তেমনই সামাজিকতা এবং কালচারও।
বলতে দ্বিধা নেই, কোনও কোনও মুসলিম নিজেদের প্রগতিশীল প্রতিপন্ন করতে আল্লাহ ও রাসুল (স) শব্দ মুখে নেয় না। বলে সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহর নাম মুখ থেকে ফস করে বেরিয়ে গেলে কেউ যদি শুনে ফেলে এবং কুপমু-ক বা সাম্প্রদায়িক ভেবে বসেন, এমন হীনমন্যতায় ভোগে।
অন্যদিকে না জেনে, না বুঝে কিছু শব্দমালা যেখানেসেখানে বলে বা প্রয়োগ করে যেগুলো শুধু অর্থহীনই নয়, বিভ্রান্তিকর এবং ওল্টাপাল্টাও।

যেমন : একজন কোনও মুসলিমের মৃত্যুসংবাদ দিল। এ খবর শুনে বলতে হয়, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এর অর্থ: নিশ্চয়ই সবকিছু আল্লাহর জন্য এবং সবাইকে তার কাছে ফিরে যেতে হবে। এটা হচ্ছে দু’আ। কারুর মৃত্যুসংবাদ বা কোনও খারাপ খবর শুনে যদি কেউ বলে আল্লাহুমা আমিন অথবা আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে কেমন হবে? আল্লাহুমা আমিন এর অর্থ হচ্ছে হে আল্লাহ, কবুল করুন এবং আলহামদুলিল্লাহ এর অর্থ হচ্ছে সমস্ত তারিফ বা কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্য। কারুর মৃত্যুসংবাদ শুনে ইন্নালিল্লাহর স্থলে কেউ যদি বলে আমিন অথবা আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে বোঝাবে এই মৃত্যুসংবাদটি তার কাম্য বা কাক্সিক্ষত ছিল। এমন কি হয়? হয় না। হতে পারে না। কারুর মৃত্যুসংবাদ বা কোনও দুঃসংবাদ শুনে কোনও মুসলিম আমিন বা আলহামদুলিল্লাহ বলবে এমন কালচার মুসলিমসমাজের বিপরীত। হ্যাঁ, কেউ যদি মৃত লোকটির জন্য কবরের আজাব বা মরহুমের পারলৌকিক কল্যাণের জন্য দু’আ করেন, তখন আবার আমিন বলা যেতে পারে। আসলে এগুলো সবই মুসলিম কালচারের অনিবার্য অনুষঙ্গ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা নিজেরা যেমন আমাদের তাহজিব তামুদ্দুন সম্পর্কে উদাসীন, তেমনই এসব থেকে সরিয়ে নিয়ে আমাদের ভিন্ন এক সংস্কৃতির নিগড়ে আবদ্ধ করতে গোরা ঘোষরা নিরন্তর প্রয়াস চালাচ্ছেন। আমরা কেউ কেউ ওদের সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে নিজেদের পা জড়িয়ে দিয়ে ওয়েলকাম করছি। দুশ্চিন্তা এখানেই।

http://www.dailysangram.com/post/342788