২৫ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ৩:৪৬

অপরাধীদের হাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র

সাত মাসে ৩ সহস্রাধিক অস্ত্র উদ্ধার, মামলা ১৩৬৭টি * আসছে ৩০টি রুট দিয়ে, দেশেও রয়েছে কারখানা

রাজধানীসহ সারা দেশে এখন অপরাধীদের হাতে হাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। শীর্ষ সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, জঙ্গি থেকে শুরু করে পাড়ার ছিঁচকে মস্তানরাও এসব ব্যবহার করছে। ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, সংঘাত-সংঘর্ষসহ বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনায় এসব অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখা যায়। র্যা ব-পুলিশের নিয়মিত অভিযানে মাঝে মধ্যেই তা উদ্ধার হয়। কিন্তু তবুও কমছে না অবৈধ অস্ত্র।
সূত্র জানায়, দেশের প্রায় ৩০টি রুট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে প্রবেশ করছে। বৈধ অস্ত্রের আড়ালেও আসছে অবৈধ অস্ত্র। এছাড়া দেশেও অস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ৩ সহস্রাধিক অস্ত্র উদ্ধার এবং এসব ঘটনায় ১৩৬৭টি মামলা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সুনির্দিষ্ট কোনো তালিকা নেই। অস্ত্রসহ কাউকে গ্রেফতারের পর চেষ্টা করা হয় তার কাছ থেকে অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে জানার। এছাড়া বিভিন্নভাবে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অবৈধ অস্ত্রধারী ও ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলে।
জানা গেছে, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৎপর হয়ে উঠছে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তার ফাঁক গলে সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে দেশে ঢুকছে অস্ত্র। চোরাচালানের মাধ্যমে এসব অস্ত্র দেশে আনা হচ্ছে। এরপর তা চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, জঙ্গি, রাজনৈতিক ক্যাডারসহ অন্য অপরাধীদের হাতে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি রোধ করতে অভিযানের পাশাপাশি সীমান্তে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টারের (বিডিপিসি) বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশে অবৈধ অস্ত্রের ১২৮টি সিন্ডিকেট রয়েছে। আর অবৈধ অস্ত্র মজুদ রয়েছে ৪ লাখের মতো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, জঙ্গি ও পেশাদার সন্ত্রাসীরা অস্ত্র মজুদ করছে। আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে অপরাধ তারাই করে। অভিযানে এরাই ধরা পড়ে।
পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, দেশে যে পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করে তার কেবল ১০ শতাংশ আটক করা সম্ভব হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে সমুদ্রপথে বিভিন্ন মালবাহী জাহাজের আড়ালে চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র চলে আসে। সীমান্তের দায়িত্বে থাকা বিজিবির পক্ষে সব সময় নজর রাখা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যক্তি দ্বন্দ্ব^সহ নানা কারণে গুলির ঘটনা ঘটে থাকে। এসব ঘটনায় অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেশি হয়। তবে নির্বাচনী বছর আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা একটু বেড়ে যায়।

র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যা বের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, অবৈধ অস্ত্রের সঙ্গে অবৈধ টাকার সম্পর্ক, মাদকের সম্পর্ক, গ্যাংকালচারের সম্পর্ক। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি, অন্যান্য বাহিনীও চেষ্টা করছে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের তৎপরতা কমিয়ে আনার জন্য।
পুলিশের এআইজি সহেলী ফেরদৌস যুগান্তরকে বলেন, অস্ত্র উদ্ধারে সারা দেশে পুলিশের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ এসব অস্ত্র উদ্ধার করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিট এ ব্যাপারে সব সময় তৎপর।

কিছু ঘটনা : খাগড়াছড়িতে ১৮ আগস্ট শনিবার সকাল ও দুপুরে দুই দফা অস্ত্রধারীদের হামলায় ইউপিডিএফের ৩ নেতাসহ ৭ জন নিহত হয়েছেন। এর আগে ১৪ জুলাই মহাখালীতে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবলীগ কর্মী কাজী রাশেদকে। এরপর ১৯ জুলাই বিকালে মামলার প্রধান আসামি বনানী থানা যুবলীগের আহ্বায়ক ইউসুফ সরদার ওরফে সুন্দরী সোহেলের কার্যালয় থেকে পুলিশ উদ্ধার করে দুটি বিদেশি পিস্তল, একটি বিদেশি রিভলবার, একটি শাটারগান ও ১২২ রাউন্ড গুলি। এর আগে ১৫ জুন জুমার নামাজের পর বাসায় ফেরার পথে গুলিতে নিহত হন বাড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলী। অস্ত্রধারী দুই সন্ত্রাসী তাকে গুলি করে হত্যা করে। অটোরিকশায় পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলশান লিংক রোডে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে বাধার মুখে ফাঁকা গুলি ছোড়ে অস্ত্রধারীরা। ১০ জুন দিনদুপুরে ডেমরার পূর্ব বক্সনগর এলাকায় ছিনতাইকারীর গুলিতে নিহত হন বিকাশের কর্মী রাশেদুল। ৩ মে উপজেলা সদরে নিজ কার্যালয়ের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন রূপম চাকমা নামে আরেকজন। পরের দিন ৪ মে সন্ত্রাসীরা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে চারজনকে। ৯ মে বাড্ডায় ডিশ ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক ওরফে ডিশ বাবুকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২৮ মে সন্ত্রাসীরা একটি বাড়িতে অবস্থানরত ইউপিডিএফ সদস্যদের ওপর অতর্কিত ব্রাশফায়ার করে। এতে ঘটনাস্থলেই স্মৃতি চাকমা, অতল চাকমা ও সঞ্জীব চাকমা নিহত হন। নিহতদের মধ্যে সঞ্জীব চাকমা গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সদস্য। এ ঘটনায় কানন চাকমা নামে আরও এক ইউপিডিএফ কর্মী আহত হয়েছেন। ২৯ মে পুরান ঢাকার বংশালের সিদ্দিক বাজার এলাকায় দুর্বৃত্তরা লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ উপজেলার ৭ নম্বর বকশিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে গুলি করে। ২২ এপ্রিল বেরাইদ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই কামরুজ্জামান দুখু এবং ১৮ ফেব্র“য়ারি মেরুল বাড্ডার মাছের আড়তে আবুল বাশার নামের এক সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৫ ফেব্র“য়ারি সকালে মহাখালীতে কলেরা হাসপাতালের পেছনে নাসির কাজী নামে ৪৫ বছর বয়সী এক ঠিকাদারকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

অস্ত্র উদ্ধার : ১১ জুন মহাখালীতে অভিযান চালিয়ে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজার ১৮৫ রাউন্ড গুলিসহ মোহাম্মদ আলী বাবুল নামের এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তিনি নেত্রকোনার ‘মেসার্স নেত্রকোনা আর্মস’-এর স্বত্বাধিকারী। তাকে গ্রেফতারের পর জানা গেছে, বৈধ অস্ত্রের দোকানের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র চলে গেছে সন্ত্রাসীদের হাতে। ১৫ মে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ডা. জাহিদুল আলম কাদির ও তার স্ত্রী মাসুমা আক্তারকে গাবতলী থেকে অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়। ময়মনসিংহে জাহিদুল আলম কাদিরের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় বেশ কিছু অস্ত্র-গুলি। জিজ্ঞাসাবাদে আরও কয়েকজন বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। অস্ত্র ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বাবুল, আগ্নেয়াস্ত্রের বৈধ ডিলারশিপ থাকলেও অধিক মুনাফার লোভে দীর্ঘদিন ধরে সে অবৈধ পন্থায় অস্ত্র কেনাবেচা করে আসছিল বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে।

এদিকে পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ৩ সহসরা হয়েছে ১৩৬৭টি। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে অস্ত্র মামলা হয়েছে ১৬০টি, ফেব্র“য়ারি মাসে ১৫৯টি, মার্চ মাসে ১৮০টি, এপ্রিল মাসে ১৯৪টি, মে মাসে ২৭৬টি, জুন মাসে ১৯৫টি এবং জুলাই মাসে ২০৩টি। ২০১৭ সালে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ৫ হাজার ৭৫৫টি। মামলা করা হয়েছে ২ হাজার ২০৮টি। ২০১৬ সালে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ৫ হাজার ৭০০টি। মামলা করা হয়েছে ৬২২টি। ২০১৫ সালে সারা দেশে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ৩ হাজার ১৫০টি। মামলা করা হয়েছে ২ হাজার ৮১টি। আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপির) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১টি। ফেব্র“য়ারি মাসে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ২০টি। ১৫টি মামলা হয়েছে, আর গ্রেফতার হয়েছে ২৫ জন। মার্চ মাসে ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ১৯টি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১৯ জনকে। এপ্রিল মাসে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ১৬টি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ২৩ জনকে। মে মাসে ১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত ১৮টি মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৬০ জন। জুন মাসে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে ১৫টি। এ সংক্রান্ত ২২টি মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৪৬ জন। এছাড়া ডিএমপিতে ২০১৭ সালে ১৭৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৫২ জনকে এবং বিভিন্ন থানায় মামলা করা হয়েছে ২৬৫টি।

অবৈধ অস্ত্রের রুট : জানা গেছে, দেশের অন্তত ৩০টি রুট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে আসছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সন্দ্ব^ীপ, সীতাকুণ্ড, রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবান, রাঙ্গামাটির সাজেক, খাগড়াছড়ির রামগড় ও সাবরুম, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, মংলা, উখিয়া, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, রাউজান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, হিলি ও সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই অবৈধ অস্ত্র আসছে। দেশেও নিজস্ব পদ্ধতিতে অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে। দেশীয় অস্ত্র ৩০ হাজার টাকায়ও পাওয়া যায়। এছাড়া ৫০ হাজার থেকে শুরু করে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় মিলছে অত্যাধুনিক বিদেশি অস্ত্র।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/83330