রাজধানীতে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করছেন ব্যবসায়ীরা :নয়া দিগন্ত
২৫ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ৩:৩৩

চামড়ার অস্বাভাবিক দরপতন

৩০ বছরের সর্বনিম্ন দামে বিক্রি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস এবারের ঈদে ভাইরাল হয়েছে। তাতে বলা হয়, ‘৩০০ টাকার জুতার দাম হয়েছে ৩০০০ টাকা। আর ৩০০০ টাকার চামড়ার দাম দাঁড়িয়েছে ৩০০ টাকায়।’ সত্যিই তাই। খুব কমসংখ্যক কোরবানিদাতাই এবার পশুর চামড়া ৩০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পেরেছেন। আর যেসব ফড়িয়া ব্যবসায়ী একটু বাড়তি দামে চামড়া কিনেছেন তারা পড়েছেন মহা বিপাকে। পোস্তার আড়তে এবার চামড়ার দাম ছিল গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। ঈদের আগে সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকায় ৪৫ থেকে ৫০ টাকা বর্গফুট দরে চামড়া কেনার ঘোষণা দেয়া হলেও গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বেশি দাম পাননি কেউই। চামড়ার মূল্যে এই ধস সারা দেশের মানুষের ঈদ আনন্দকে ক্ষোভের রূপ দেয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি জেনারেল মোজাম্মেল হক চৌধুরী তার ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট দিয়েছেন। লিখেছেন, ৮২ হাজার টাকা দামের মহিষের চামড়া ৬০ টাকায় বিক্রি না করে মাটিতে পুঁতে রাখলাম। ভালো করলাম না মন্দ করলাম।’ কাছাকাছি একটি পোস্ট দিয়েছেন ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল ইসলাম সুমন। তিনি লিখেছেন, গরিবের চামড়া যারা হরিলুট করছেন তাদের বিরুদ্ধে কিছুই করার ক্ষমতা আমার নেই। প্রতিবাদস্বরূপ আমার কোরবানির পশুর চামড়াটি মাটিতে পুঁতে ফেললাম। আর গরিব-মিসকিনদের আমার পকেট থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে দিলাম।
চামড়ার দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজধানীর একটি কওমি মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা সোলায়মান হোসেন গতকাল শুক্রবার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের মাদরাসাগুলো চলে মূলত বিত্তবানদের দান-খয়রাতে। কোরবানির ঈদে পাওয়া চামড়া বিক্রির টাকায় আমাদেরকে বছরের অন্তত অর্ধেক সময় চলতে হয়। তিনি বলেন, আমার মাদরাসায় গত পাঁচ বছর আগে যে সংখ্যক চামড়া আসতো এবার এসেছে তার দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু দাম পেয়েছি চার ভাগের এক ভাগ। হেফাজতের ঘটনার পর থেকে সরকার পরিকল্পিতভাবে কওমি মাদরাসা বন্ধ করার কাজ হাতে নিয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, হাতে মারার সুযোগ না পেয়ে তারা আমাদেরকে ভাতে মারার উদ্যোগ নিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে গরিব মানুষগুলোর ভাগ্যে আরো করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

চামড়ার এমন নি¤œদরের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, চামড়ার দাম এত কম আগে কখনো হয়নি। আমার জানা মতে গত তিন দশকের মধ্যে এবারই চামড়ার দাম সবচেয়ে কম। এর প্রধান কারণ ব্যবসায়িক মন্দা। তিনি বলেন, আমাদের প্রধান বাজার হলো চীন। অথচ তিন মাস ধরে চীনে চামড়া রফতানি হচ্ছে না। দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে চীন আমাদের চামড়া নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আগের অর্ডার তো নিচ্ছেই না, নতুন কোনো অর্ডারও দিচ্ছে না। প্যাকিং করা প্রায় ১০০ কনটেইনার চামড়া চীন এখনো নিচ্ছে না বলে জানান তিনি।
ট্যানারি ব্যবসায়ীদের দাবি, সাভারের চামড়া শিল্পনগরী দীর্ঘ দেড় যুগেও পুরোপুরি চালু না হওয়ায় বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সেখানে উৎপাদনের উপযোগী পরিবেশ এখনো হয়নি। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) এখনো প্রস্তুত হয়নি। এ ছাড়া দীর্ঘদিন লোকসান গুনতে গুনতে ব্যবসায়ীরা দেনায় জর্জরিত। ব্যাংকঋণ আটকে আছে নানা শর্তের বেড়াজালে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে একসময় ২২টি ট্যানারি থাকলেও ২১টিই একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে চালু আছে মাত্র একটি, যার প্রক্রিয়াকরণ সমতা ওই অঞ্চলে সংগৃহীত মোট চামড়ার ২০ শতাংশেরও কম। হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো পুরোপুরি বন্ধ। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে বর্তমানে ট্যানারি আছে ১৫৫টি। এর মধ্যে উৎপাদনে সম ১১৫টি।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী চামড়া এখনো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত। কিন্তু এ অবস্থা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কারণ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি থেকে আয় দিন দিন কমছে। চামড়াকে সরকার ২০১৭ সালের ‘বর্ষ-পণ্য’ ঘোষণা করে। কিন্তু ওই বছরের রফতানি পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি থেকে আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার, যা ল্যমাত্রার তুলনায় ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ উৎস থেকে আয় হয়েছে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

জানা যায়, পাঁচ বছর আগেও ট্যানারি মালিকেরা ঢাকায় প্রতি বর্গফুট চামড়ার ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছিলেন ৯০ টাকা। এ সময়ের মধ্যে অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হলেও অর্ধেকে নেমে এসেছে চামড়ার দাম। গরিব মিসকিনের হক চামড়ার মূল্যের এই নি¤œমুখী প্রবণতা অব্যাহত ছিল গত কয়েক বছর ধরেই। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার এবং ট্যানারি মালিকরা এবার ঢাকায় প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছেন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বাস্তবে চামড়া বিক্রি হয়েছে আরো কম দামে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সরকারের সহযোগিতায় পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে গরিব-মিসকিনদের ঠকাতে একাট্টা হয়েছে স্বার্থবাদী সব পক্ষ।

জানা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যৌক্তিক দর নির্ধারণের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন এবার প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে পাঁচ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। অথচ সরকার উল্টো ৫ টাকা করে কমিয়ে দিয়েছে। এ বছর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে ঢাকা শহরে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত বকরির চামড়ার দাম নির্ধারিত হয় ১৩ থেকে ১৫ টাকা। বাস্তবে নির্ধারিত দামের অর্ধেকও পাননি চামড়ার প্রকৃত হকদাররা।

এ দিকে চামড়ার দাম কম দিয়ে গরিবদের ঠকানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ। তিনি বলেন, চামড়ার দাম তো আমরা নির্ধারণ করি না। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার নিজেই দাম নির্ধারণ করে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে চামড়ার দাম অর্ধেকে নেমে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, গত বছর কেনা চামড়ার ৪০ শতাংশ এখনো মজুদ আছে। যার গুণগত মান অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক আমাদের যে ঋণ দিয়েছে তাও অনিশ্চিত। কারণ, গত বছর পাওয়া ঋণ আমরা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। যেসব ট্যানারি মালিক কম দামে হলেও চামড়া কিনেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনায় এবার কোরবানির পশুর কাঁচাচামড়া পানির দামে বিক্রি হয়েছে। ঈদ ও তার পরের দিন সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে চামড়া কেনা-বেচা হয়েছে। কম দামে চামড়া কিনতে পেরে ব্যবসায়ীরা খুশি হলেও বিক্রেতা, বিশেষ করে মাদরাসাগুলো এবং ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়েছেন।

গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার নগরীর শেখপাড়া চামড়াপট্টিতে গিয়ে দেখা যায় সাইজভেদে প্রতিটি চামড়া ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর কোরবানির পর যে দামে ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছিল এবার গরুর চামড়া সেই দামে বিক্রি হচ্ছে। দান হিসেবে গ্রহণ করে চামড়া বিক্রি করতে হতাশ হয়ে পড়েন মাদরাসাগুলোর কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, মাদরাসা ও এতিমখানার ছাত্র-শিক্ষকেরা কোরবানির ঈদে সাধারণত ছুটি না নিয়ে চামড়া সংগ্রহ করেন। এবার চামড়ার দাম যা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে চামড়া সংগ্রহের যাতায়াত ব্যয় উঠানোও কঠিন হচ্ছে। চামড়া বেশি পেলেও দাম না পাওয়ায় এবার মাদরাসা এবং এতিমখানা চালাতে হিমশিম খেতে হবে।

শেখপাড়া চামড়াপট্টির ব্যবসায়ীরা জানান, দাম কম হওয়ায় এবার বেশি চামড়া কেনা গেছে। এবারে তারা ভালো লাভ করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। বিপরীত দিকে মওসুমি ব্যবসায়ীরা জানান, তারা এবার বিপদে পড়েছেন। চামড়ার দাম যে এতো কমে যাবে তা ধারণায় ছিল না। আবার চামড়ার দাম কম হওয়ায় বেশ মোটা অঙ্কের চামড়া ভারতে পাচার হওয়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেন ব্যবসায়ীরা।
তবে কোরবানির চামড়া পাচার রোধ করতে খুলনা র্যা ব-৬ চেষ্টা করছে বলে র্যা ব সূত্রে জানা গেছে। খুলনা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম শফিউল্লাহ জানান, কোরবানির পশুর চামড়া ভারতে পাচাররোধে কড়া নজরদারি করা হচ্ছে। জেলা পুলিশ ১২টি চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছে।
বগুড়া অফিস জানায়, বগুড়ায় সরকার দলীয় সিন্ডিকেটের কারণে পানির দামে চামড়া বিক্রি করেছেন কোরবানিদাতারা। কম দামের কারণে কেউ কেউ সরাসরি মাদরাসা ও এতিমখানায় দান করেছেন। আবার চামড়া কিনে ব্যাপক লোকসানের শিকার হয়েছেন মওসুমি ব্যবসায়ীরা। এ জন্য সরকার দলীয় সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন তারা।

বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ইদের দিন সকাল থেকেই চামড়ার দাম কম ছিল। মওসুমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পাড়া-মহল্লা থেকে প্রকারভেদে গরুর চামড়া ৩০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা দরে কিনেছেন। এ ছাড়া ছাগলের চামড়া প্রতি পিস বিক্রি হয়েছে ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা। তবে
গ্রামে-গঞ্জে চামড়ার দাম কিছুটা বেশি ছিল।
এ ব্যাপারে চামড়া ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারদলীয় কোনো সিন্ডিকেট নেই। ব্যবসায়ীরা নিজস্ব উদ্যোগে চামড়া কিনেছেন। ট্যানারি মালিকদের কাছে কোটি কোটি টাকা আটকে থাকার কারণেই মূল সঙ্কট।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/343296