৫ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, ৯:০৭

মরুকরণ রোধ ও এসডিজি অর্জনের চ্যালেঞ্জ

-অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান

উজান দেশে সম্প্রতি লাগাতার বৃষ্টিপাত, ভারী বর্ষণ, টানা বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে নালা-নর্দমা, খাল-বিল, নদ-নদী পানিতে ভরপুর হওয়ায় সে দেশের ছোট-বড় ব্যারেজগুলো একযোগে খুলে দিয়েছে এবং দিচ্ছে ভারত। যার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ভাটির দেশ-বাংলাদেশে বিগত বছরের ন্যায় এবারও নতুন করে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছে দেশের সংশ্লিষ্ট পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে মারাত্মক বন্যা শুরু হয়ে গেছে। পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জসহ অনেক জেলার নি¤œাঞ্চলের দিকে বন্যার পানি তীব্রবেগে ছুটে আসছে এবং নদ-নদীতে বন্যার পানি ভরাট হয়ে উপচে পড়ে বিস্তীর্ণ জনপদ পানিতে তলিয়ে গেছে। অপরদিকে উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগ ও পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের অধিকাংশ জেলায় সম্প্রতি ভারী বর্ষণ, ঢলের পানি ও উজানের বন্যার পানি প্রবলবেগে প্রবেশ করায় এক ভয়াবহ বন্যা কবলের শিকার হতে চলেছে বাংলাদেশের তিস্তা, যমুনা, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার, মাতামুহুরী, হালদা, সাঙ্গু, মুহুরী, ফেনী, সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, মহারশি, ঘাগট, সামেশ^রী, ভোগাই, মৃগী, সামিয়াজান ইত্যাদি নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, তিস্তা এবং জলঢাকার পানি টানার জন্য ভারত কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল খনন করবে। আরেকটি ১৫ কিলোমিটার খাল তিস্তার বাম পাশের্^র তীরবর্তী এলাকায় খনন করার পাশাপাশি জলপাইগুড়ি জেলার ধুপগুড়িতে আরও একটি খাল সংস্কার করা হবে মর্মে তথ্য দিয়েছে জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের উপস্থিতিতে সেচ বিভাগকে এইসব খাল খনননের জমির মালিকানা হস্তান্তর করেছে ভারত।

তিস্তা ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত অন্যতম একটি অভিন্ন নদী। শুষ্ক মৌসুমে পানি ভাগাভাগি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতার কারণে সেটি এক বছরেও আলোর মুখ দেখতে পারেনি। অভিন্ন নদী হিসেবে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি না করে উজানে তিস্তার পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এই তিস্তা নদীর পানি বন্টনের ইস্যুটি একটি অমীমাংসিত সমস্যা বিধায় বাংলাদেশের জনগণ এ বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধানের বিষয়ে মনেযোগী ও জানতে খুবই আগ্রহী।

বাংলাদেশের উজানে ভারত অসংখ্য বাঁধ, প্রকল্প ও ক্যানেল তৈরী করে পদ্মা নদীর পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে গঙ্গা-পদ্মার ফারাক্কা পয়েন্টের ভাটি অঞ্চলের বাংলাদেশ মরুকরণের দিকে ভয়াবহভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির হিস্যা আদায়ের জন্য ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় স্বাক্ষরিত চুক্তি রয়েছে, সে শর্তানুযায়ী গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পানি পাবার কথা বাংলাদেশ। ফারাক্কা পয়েন্টে ৭৫ হাজার কিউসেক বা তার বেশি পানি প্রবাহ থাকলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক পানি, আর বাকিটা পাবে বাংলাদেশ; সে শর্ত শর্তই থেকে যায়, পানির অধিকার পায় না বাংলাদেশ। শুধু ফারাক্কা নয় গঙ্গার উৎস থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত বহু বাঁধ আর কৃত্রিম খালের মাধ্যমে বহুদিন থেকেই গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে ভারত। কানপুরের গঙ্গা ব্যারাজ ও হরিদুয়ারে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারে নির্মিত কৃত্রিম খোলসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে ভারত। ভারতের এহেন কৌশলের গ্যারাকলে বাংলাদেশ অর্ধশত বছরের ব্যবধানে মরুকরণে পৌঁছে গেছে।

দেশের রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, ঢাকা ও খুলনা বিভাগসহ নদীমাতৃক অসংখ্য জেলায় বন্যা খরা, দাবদাহ, শীত, নদী ভাঙ্গন, ঝড়, জলোচ্ছাস, নদীর নাব্যতা সংকট চলমান ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপর্যুপরি বন্যার কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের ভোগান্তির অন্ত নেই। বিশেষ করে ১৯৭১, ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৮০, ৮৩,৮৪, ৮৭, ৮৮, ৯৮, ২০২০-২২, এবং সর্বশেষ ২০২৩ সালের ভয়াবহ বন্যায় দুর্যোগ-দুর্ভোগের কারণে দেশের নদীমাতৃক এলাকার লাখ লাখ মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতির শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সংঘটিত ৯টি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬১ জনের প্রাণনাশ হয়েছে। দেশের নদ-নদী কেন্দ্রিক জীবন-প্রকৃতি, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, বজ্রপাত ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে দেশের সংবাদপত্র প্রতিমাসে, প্রতিবছর যে পরিমাণ খবরা-খবর প্রকাশিত হয়, প্রবন্ধ- নিবন্ধ লিখতে যে পরিমাণ স্পেইস লাগে, পৃথিবীর আর কোন দেশে এ বিষয়ে এত লেখালেখি হয় কিনা আমার জানা নেই।

এমন কোন মাস নেই যে, নদীকেন্দ্রিক তৃণমূলের জনপদের মানুষের দুঃখ-দুর্যোগ-দুর্ভোগ নিয়ে লেখালেখি হয় না। কারণ নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ, নদী মরলে মরবে দেশ। ইতোমধ্যে ৫৩ বছরে নদী মাতৃক পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে না পারায় দেশের কৃষিজীবী ৫০% নদী ও সাগর উপকূলীয় মেহনতী ২০% মানুষ কর্মসংস্থানের উপযুক্ত ক্ষেত্র হারিয়ে বেকার ও দরিদ্রতার শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

বিশেষ করে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, ব্রম্মপুত্র, বড় আকারের নদ-নদীসহ অন্যান্য নদী উপকূলীয় ১৯ জেলায় নদী ভাঙ্গনে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। জেলাগুলো হলো- পঞ্চগড়, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, শেরপুর, ময়মনসিংহ, টাংগাইল, মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, সিলেট, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, চাঁদপুর, নাটোর, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালি, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, পাবনা ও রাজশাহী। এসব নদী এলাকার মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনুদানকৃত বা ঋণের কোটি কোটি টাকা কিভাবে ব্যয় করা হয়েছে বা হচ্ছে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।

২০১৭ সালে নৌপথে নাব্যতা বাড়াতে ২২ লাখ কোটি টাকার ১৫ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা শুরু করে সরকার। এর ফলাফল কতটুকু তা সাধারণ জনগণ না জানলেও সচেতন নাগরিকরা ঠিকই সবকিছু জানেন এবং হারে হারে অনুভব করেন। তারা এটাও জানেন বাংলাদেশে এত কিছুর পরও প্রতিবছর ২৫ হাজার বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে থাকে কোন কারণে।

এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়বে বলে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারী প্যানেলের আইপিসিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়। আর গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষয়-ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথমেই। অপর একটি প্রতিবেদনে জানা যায় দেশে বিগত ৪০ বছরে নদী উপকূলীয় এলাকায় নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর ফসলি জমি।

উপর্যুপরি বন্যা, নদী ভাঙ্গনে রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও টাংগাইল জেলাসহ দেশের ভাটি অঞ্চলের বিস্তীর্ণ নদী এলাকার হাজার হাজার বাড়িঘর, বসতভিটা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, নদীর ঘাট, রেলওয়ে স্টেশন, সরকারী-বেসরকারী অফিস-আদালত, হাসপাতাল, খেলার মাঠ ও আবাদী জমিসহ হাজার হাজার কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক, তিস্তা, যমুনা, ব্রক্ষপুত্র ও বাঙ্গালী নদীর গর্র্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী সিকস্তি প্রান্তিক জনপদের জীবন এখন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। এককালের গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ এখন শুধুই স্মৃতি।

নদী প্রবাহের মতোই চরবাসীদের জীবনযাত্রা। প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে জীবনাতিবাহিত করছে হাজার হাজার বছর যাবত নদী সিকস্তি চরবাসীরা। সর্বনাশা নদী ভাঙ্গনের ফলে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নেমে এসেছে নানা রকমের ছন্দপতন। দুর্যোগ-দুর্ভোগ তাদের নিত্যসঙ্গী। এসব এলাকায় এক সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাকা সড়ক, মটরযান, বিদ্যুৎ ছিল দু:স্বপ্ন। সোলা আর বাঁশের খুঁটিতে তৈরী করা হতো ঘরবাড়ি, এখন টিনের ঘর, সেমিপাকা টিনের বাড়িঘর চোখে পড়ার মতো। জ¦ালানি, সেচ ব্যবস্থাপনা, সার, কীটনাশক ও বীজ ছিল অপ্রতুল। যাতায়াত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই কষ্ট সাধ্য। মালামাল পরিবহনের মাধ্যম ছিল ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি, আর সহজ ও সস্তা পরিবহন ছিল লগি-বৈঠা, রশির গুণ আর পালতোলা নৌকা। গ্রাম থেকে কষ্টেসৃষ্টে শহর পৌঁছার দূরপাল্লার যাত্রায় একমাত্র পরিবহন ছিল রেল গাড়ি। কালের বিবর্তনে আজ সবক্ষেত্রে ঘটেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। কিন্তু কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আর কৃত্রিম বন্যার প্রভাব।

১৯৯৬-৯৭ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশের নদী অঞ্চলের আয়তন ৯,৪০৫ কিলোবাইট। বিগত ৪০ বছরে নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর ফসলী জমি। বাস্তুহারা হয়েছে ৪০ লাখ মানুষ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা। ফলে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে চরবাসীদেও জীবন প্রকৃতি। দেশের উত্তরাঞ্চলের নদী অববাহিকায় নৌ-ঘাট ছিল প্রায় তিন শতাধিক। পানির নাব্যতা কমে যাওয়ার দরুন শুকনো মৌসুমে এসব ঘাটের প্রায় অধিকাংশ বন্ধ হয়ে যায়।

ফলে প্রান্তিক মানুষের যাতায়াত ও যোগাযোগে ভোগান্তি বেড়ে যায়। সম্প্রতি সরকার এইসব নদীর নাব্যতাতা বাড়াতে বার বার বৈঠক করে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাজেট নির্ধারণ করে বলে জানা যায়। সাধারণ জনগণ মনে করেন, ‘সরকারী কা মাল -দরিয়ামে ঢাল’, এমন যাতে না হয় সে ব্যাপারে সদা সতর্ক না থাকলে রাষ্ট্রযন্ত্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা যেতে পারে বলেও মতামত ব্যক্ত করেছেন দেশের অভিজ্ঞ মহল ও সচেতন নাগরিকবৃন্দ।

বিগত ২০০ বছরে ভয়াবহ বন্যার কবলে ভারতের ভাটি অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা অপরিসীম। কারণ, প্রায় ১৫৪ টি আন্তর্জাতিক নদীর পানি ভাটি অঞ্চলের উপর দিয়ে যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত হয়ে আসছে। দেশ বিভাগের পর উজানের প্রায় সকল নদ-নদীর পানির চাবি-কাঠি ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সেই থেকে ভাটির দেশ বাংলাদেশ বছরে ৯ মাস থাকে মরুভূমি আর তিন মাস থাকে অতি বন্যায় সয়লাবে। এতে দেশের অগণিত সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সহ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীবনযাত্রা। যার সঠিক পরিসংখ্যান নিরূপণ করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।

সম্প্রতি ২০২৪ সালের জুন মাসব্যাপী দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী মাতৃক জেলা বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী ও চট্টগ্রামে নদী ও সাগর উপকূলীয় এলাকায় সরেজমিনে সফর করে দেশ ও দেশের নদী এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে নতুন নতুন বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। বিশেষ করে চলতি বছরের জুনের শেষের দিকে আমি তিস্তা নদীর উপর নির্মিত লালমনি-ডালিয়ার তিস্তা ব্যারেজ, পাটগ্রাম, বুড়িমারি সীমান্ত, আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম, জিরোপয়েন্ট, তিনবিঘা করিডোর, সানিয়াজান নদীর মোহনা, বড়খাতা, রংপুর কাউনিয়া তিস্তা নদীর রেল ও সড়ক ব্রিজ, কাউনিয়া, ডালিয়া ডিভিশন, দোয়ানী, গুড্ডিমারী ইত্যাদি স্থানে সরেজমিনে ঘুরে ঘুরে জীবন প্রকৃতির বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে অনেক কিছু জানতে পেরেছি।

এরপর থেকে নদীমাতৃক জনপদের মানুষের দুর্যোগ-দুর্ভোগের নানা বিষয়াদী নিয়ে আমার সাংবাদিতার হাতেখড়ি। সেখান থেকেই লেখালেখি শুরু করে আজ দেশের জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকায় সাংবাদিকতায় প্রবেশের সুযোগ হয়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তিনবার পদকে ভূষিত হওয়ার গৌরবও অর্জন করি। বিগত দিনে বাংলাদেশের ৫৬ টি জেলার নদী ও নদীপারের মানুষের জীবন প্রকৃতি, জীববৈচিত্র, পরিবেশ, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, যাতায়াত, যোগাযোগসহ নানামাত্রিক বিষয়াদি নিয়ে দেশের প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকে আমার লেখা অন্তত ১৭ টি গবেষণামূলক প্রবন্ধসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রায় ৬ শতাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ দেশের জাতীয় দৈনিকে উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। যে প্রবন্ধের পাঠকগণ আমাকে বাংলাদেশের নদী ও প্রকৃতির উপর একটি বই লিখার জন্য একান্তভাবে অনুরোধ জানিয়ে আসছেন অনেকদিন থেকেই। মহান আল্লাহতায়ালা তৌফিক দান করলে সময় ও সুযোগ হলে সম্মানিত পাঠকদের মনের বাসনা পূরণে মনোনিবেশ করার ইচ্ছা আছে আমার।

মূলত তিস্তার পানি উত্তরবঙ্গের তিন কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যাই নয়, বরং দেশের ভাটি অঞ্চল মরুকরণের সমূহ সম্ভাবনা। অথচ এটি এখন মুখ্য বিষয় না হয়ে গৌণ বিষয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ভারত চায় না চীন এ বাঁধের উছিলায় তাদের সীমান্তে ঘাঁটি তৈরী করুক। সে কারণে বাংলাদেশ যখনই তিস্তা নিয়ে চীনের সাথে সমঝোতায় পৌঁছাবার পর্যায়ে আসে তখনই ভারত নড়েচড়ে বসে। কারণ এই তিস্তা ব্যারেজটি ভারতের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ তৈরী করতে পারে। যে কারণে তিস্তায় চীন যুক্ত হোক তা ভারত কখনই বরদাশত করতে চাইবে না। সেই ২০১৬ সাল থেকে চীন তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সাথে কথা বলছে। সে বছর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশ সফরেও এসেছিলেন। সে সময় চীন-বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে একমত হয় ঢাকা ও বেইজিং।

এরপর ২০১৯ সালের মে মাসে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি ‘প্রিলিমিনারী ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল’ বা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাব (পিডিপিপি) প্রস্তুত করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আনুষ্ঠানিক শিরোনাম তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প (টিআরসিএমআরপি)। ২০১৯ সালের ৩ জুন পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত প্রস্তাবটি ২০২০ সালের ২৩ জুলাই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়েছিল তিস্তার বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ‘পাওয়ার চায়না’ নামক একটি চীনা সংস্থার প্রস্তাবিত টিআরসিএমআরপি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে যাওয়ার পর থেকেই মূলত: ভারত এ বিষয়ে জোরালো আপত্তি ও নানা হামকি ধমকি প্রদর্শন করতে থাকে।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের ৫৪ টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি নদীর ক্ষেত্রে ভারতের সাথে পূর্ণ চুক্তি রয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য নদ-নদী নিয়ে আলোচনা চলমান থাকলেও এখন পর্যন্ত কোন চুক্তি হয়নি বা হওয়ার সম্ভাবনাও দিন দিন কমে আসছে। তিস্তা নিয়ে ১৯৮৪ সালের আগ থেকে আলোচনা চলছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন অগ্রগতি হয়নি। ২০১১ সালে একটা চুক্তি হতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাও আর হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশের ভূখন্ডের ভেতর দিয়ে ভারতকে মালবাহী রেল যোগাযোগ ও যাতায়াতের অনুমতি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে ভারতের প্রবেশ এবং তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দাবি থেকে সরে আসার বিষয়গুলোকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করার অভিযোগ করেছে দেশের সর্ববৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ ডান-বাম ঘরনার ছোট বড় দলগুলো।
তিস্তা নদীর অববাহিকায় ভাটি অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে বাংলাদেশ এখন চীন ও ভারতের সাথে দর কষাকষি করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একান্ত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুদেশে স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়েছে ভারতে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত ১০ সমঝোতা স্মারক ও নথি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে ৫টি নতুন সমঝোতা স্মারক, ৩ সমঝোতা স্মারক নবায়ন এবং ভবিষ্যৎ কাজের ক্ষেত্র হিসেবে ২টি যৌথ কার্যক্রমের নথি সই করেছে দুই দেশ। তবে ভারত বরাবরের মতোই তিস্তা চুক্তি ও বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে এবার নদী ব্যবস্থাপনার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে।
এতে বাংলাদেশ মনে করছে তিস্তার পানি সমস্যার একটা বিহিত বা সমাধান হবে। কিন্তু স্থানীয় জনগণ, পানি ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় তিস্তা সমস্যা সমাধানে ভারতের নতুন এই প্রস্তাব ইতিবাচক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেছেন। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যখন সমঝোতার আলোচনা চলছে ঠিক সে সময়েই ভারত থেকে আসা তিস্তার পানির ঢলে বাংলাদেশে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের অবস্থা খুবই শোচনীয় পর্যায়ে চলছিল। অভিন্ন নদী হিসেবে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি না করে উজানে তিস্তার পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে ভারত। ফলে স্বাধীনতার আগ থেকে এই তিস্তা নদীর পানিচুক্তি আগের মতোই আবারো অমীমাংসিত অবস্থায় রয়ে গেল। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণ যে অধীর আগ্রহ নিয়ে কালক্ষেপণ করছিল, সে আশায় অনেকটা গুড়ে-বালিতে পরিণত হলো বলে অভিজ্ঞ মহল মন্তব্য করছেন। (চলবে)

https://www.dailysangram.info/post/560424