অস্থায়ী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে রোহিঙ্গারা। ছবি: সংগৃহীত
২৫ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ৩:২৩

‘রোহিঙ্গাদের জীবন ভোগান্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বেড়াজালে’

চলমান রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে ২৫ আগস্ট। রোহিঙ্গাদের নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক মানবিক চিকিৎসা সংস্থা মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স বা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (এমএসএফ)। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের আইনি মর্যাদা (লিগ্যাল স্ট্যাটাস) দিতে অস্বীকৃতি, অপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তৈরি ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন ইত্যাদির কারণে এখনো তাদের জীবন ভোগান্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বেড়াজালে আটকে রয়েছে।
এমএসএফের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত ‘শুদ্ধি অভিযান’-এর কারণে যে ভয়াবহতা ও ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়, এতে প্রায় ৭ লাখ ৬ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এই শরণার্থীরা পূর্ববর্তী সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ২ লাখ শরণার্থীর সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ৯ লাখ ১৯ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমএসএফ জানিয়েছে, গত ১২ মাসে সংস্থাটির ১৯টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা মোবাইল ক্লিনিকে ৬ লাখ ৫৬ হাজার ২০০-এর বেশি মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অর্ধেকের বেশি রোগী সহিংসতাজনিত আঘাতের চিকিৎসা নিলেও, ক্যাম্পের ঘনবসতি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে তারা পরবর্তী সময় অসুস্থ হয়।

চিকিৎসাধীন এক নারী ও শিশু রোহিঙ্গা। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে এমএসএফের হেড অব মিশন পাভলো কলোভস বলেন, এখনো ক্যাম্পের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি হচ্ছে ডায়রিয়া। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন, তা এখনো অনুপস্থিত। এর ফলে মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে।

পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, শরণার্থীদের জন্য অসামান্য উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়ে সীমানা খুলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ১২ মাস পরও রোহিঙ্গাদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এই অঞ্চলের দেশগুলো রোহিঙ্গাদের কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক আইনি মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।
পাভলো কলোভস বলেন, ‘আমরা এমন এক অবস্থার মধ্যে আছি যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঠিক এই নামে চিহ্নিত করাও কঠিন। শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের যে আইনি অধিকার আছে, তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানো অথবা তাদের কোনো আইনি মর্যাদা না দেওয়ার মাধ্যমে এই ইস্যুতে কাজ করে যাওয়া বিভিন্ন দেশ ও অন্যান্য সংস্থা রোহিঙ্গাদের খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে রেখেছে।’

সংস্থাটি বলছে, নিপীড়নই রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণ। মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে না পারার মাধ্যমে দাতা সংস্থাগুলো ও অন্যান্য সরকার তাদের প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে জাতিসংঘের অধীনে চলমান মানবিক কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় অর্থের মাত্র ৩১.৭ শতাংশ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের বাজেটের মাত্র ১৬.৯ শতাংশ নিশ্চিত করা গেছে। সুতরাং অতি প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবার অনেক বড় ঘাটতি রয়ে গেছে।
এমএসএফের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। ফলে তারা খুব কমই টিকা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাই প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গারা দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত চলে যাবে, এ রকম ধারণা থেকে দীর্ঘমেয়াদি ও উল্লেখ্যযোগ্য ত্রাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ফলে অনেক মানবিক সাহায্য বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে তৈরি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অস্থায়ী ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা যেভাবে জীবন যাপন করছে, তা আন্তর্জাতিক মানবিক মানের অনেক নিচে। শরণার্থীরা এখনো প্লাস্টিক ও বাঁশ দিয়ে তৈরি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছে, যেখানে তাদের প্রাথমিকভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

অস্থায়ী শিবিরে রোহিঙ্গাদের বসবাস। ছবি: সংগৃহীত
সংস্থাটি বলছে, মৌসুমি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষার জন্য কোনো শক্ত অবকাঠামো নেই। এটি তাদের নিরাপত্তা ও আত্মসম্মানের ওপর বড় প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যে পরিমাণ সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে এবং এর ফলে যে মানসিক আঘাত তারা পেয়েছে, সেই তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং যৌন সহিংসতার আঘাতের চিকিৎসাসেবা অপ্রতুল। এ অবস্থা আরও জটিল হয়েছে তাদের কোনো আইনি মর্যাদা (লিগ্যাল স্ট্যাটাস) না থাকার কারণে। ফলে তারা কোনো বিচার ব্যবস্থার শরণাপন্ন হতে পারে না এবং তাদের জন্য কোনো আইনও নেই। তার ওপর অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের ভেতরে থাকতে বাধ্য হয়, যেখানে বেশির ভাগ শরণার্থীর যথাযথ পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা/ল্যাট্রিন, শিক্ষা ব্যবস্থা, জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই।

পাভলো কলোভস বলেন, এই দীর্ঘায়িত শরণার্থী সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান বের করা প্রয়োজন। বাস্তবতা হচ্ছে, দশকের পর দশক ধরে এই রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে ও অন্যত্র অবস্থান করছে। যদি কখনো সম্ভব হয়, তাদের মিয়ানমার ফেরত যেতে আরও অনেক বছর সময় লাগবে। রোহিঙ্গাদের এই দুর্ভোগের পরিমাণ ও মাত্রা স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে একটি বড় প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর যে নিপীড়ন চলছে, তা বন্ধের জন্য মিয়ানমার সরকারে ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে

https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1554866