২১ আগস্ট ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:৫৫

রেলে দিনভর ভোগান্তি মহাসড়কে শেষবেলায়

সময়সূচি বিপর্যয়ে রেলে ক'দিন ধরে দুর্ভোগ চললেও, এবার সড়কপথে ঈদযাত্রা আগের বছরগুলোর তুলনায় স্বস্তির। গতকাল সোমবার ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার পর সড়কে ঢল নামে যাত্রীর। চিত্র বদলাতে থাকে মহাসড়কেও। স্থবির হয়ে পড়ে যানজটে। ছিল বাড়তি ভাড়ার ভোগান্তি। ঘাটে গাড়ির দীর্ঘ সারিতে ফেরি পারাপারে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সড়কে প্রাণ গেছে অন্তত ১৫ জনের। ভোগান্তি যতই হোক, ঈদ বলে কথা! দুর্ভোগ তুচ্ছ করে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা ছেড়েছেন লাখো মানুষ।

আগামীকাল পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। গতকাল ছিল ঈদের আগের শেষ কর্মদিবস। কিন্তু প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় থেকে সর্বত্র ছিল ছুটির আমেজ। রাজধানী ঢাকা ছিল ফাঁকা। দুপুরের আগেই অফিস-আদালত ফাঁকা করে বাড়ির পথ ধরেন সবাই। গতকাল ছুটি হয় গার্মেন্টস ও অন্যান্য কলকারাখানাও। ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে শ্রমিকের ঢল নামে বিকেলে। সড়ক স্থবির হয়ে পড়ে তাদের ভিড়ে।

শেষ বেলার ভোগান্তির জন্য সরকারের পরিকল্পনাকে দায়ী করেন জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য কলামিস্ট আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, 'পৃথিবীর সব দেশে উৎসবে দীর্ঘ ছুটি থাকে। চীনে পুরো এক মাস ছুটি থাকে। বাংলাদেশে ঈদের ছুটি মাত্র তিন দিন। সবাই একসঙ্গে শহর ছাড়েন। একসঙ্গে ফেরেন। এ কারণে এত দুর্ভোগ ও প্রাণহানি। অনাবশ্যক ছুটিগুলো কমিয়ে ঈদের ছুটি সাত দিন করা উচিত। তাহলে এ দুর্ভোগ হবে না।'

র্যা বের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বিকেলে তীব্র যানজট ছিল মাওয়া ও শিবালয় ফেরিঘাটে। মাওয়ার শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী ঘাটে ২১টি ফেরির ১৭টি চলেছে গতকাল। নাব্য সংকটে বাকিগুলো চলতে পারেনি। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ২০টি ফেরির বিকল একটি বাদে বাকিগুলো চলেছে। এই দুই ঘাট দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলাকে সড়কপথে যুক্ত করেছে ঢাকাকে।

দুই ঘাটেই গতকাল পদ্মা পারাপারে গাড়ির দীর্ঘ সারি ছিল। পাটুরিয়ায় বিকেলের পর ছিল প্রায় সাত কিলোমিটার। র্যা বের তথ্য অনুযায়ী, বিকেলে মাওয়া ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় ছিল দুই শতাধিক বাস। নদী পারাপারে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা বাড়তি সময় লেগেছে। এতে মহাদুর্ভোগ হয় যাত্রীদের।

ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা সড়কটি ১৬ জেলাকে সড়কপথে যুক্ত করেছে ঢাকার সঙ্গে। কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সোমবার সকাল থেকে যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল জয়দেবপুর-এলেঙ্গায়। কিন্তু বিকেলে সাভার ও আশুলিয়ার কারখানা ছুটির পর চিত্র বদলে যায়। যাত্রীর ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানজট বাড়তে থাকে সড়কে। সন্ধ্যার পর স্থবির হয়ে যায় মহাসড়ক। ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। যান সংকটে হাজার হাজার যাত্রীকে সড়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আইনে নিষিদ্ধ হলেও, বাসের ছাদে, কোরবানির পশুবাহী ফিরতি ট্রাকে, পিকআপে করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই গন্তব্যে রওনা হন।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, একই অবস্থা ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী-জয়দেবপুর অংশে। দিনের বেলায় গাড়ি ধীরে চললেও স্থবিরতা ছিল না। কিন্তু বিকেলের পর যানজট বাড়তে থাকে। রাতে পুরোপুরি স্থবির হয়ে যায়। মহাসড়কে চলার অনুমতি না থাকলেও পিকআপ, লেগুনা, ঢাকার লোকাল বাসে করে দূরপাল্লার পথে রওনা হন যাত্রীরা।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, যানজট নিরসনে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে মহাসড়কে। বাড়তি ভাড়ার অভিযোগের জবাবে তিনি জানান, এমন অভিযোগ পাননি।

তবে গতকাল মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখা যায় শেষ সময়ে বাসগুলো যে যেভাবে পেরেছে বাড়তি ভাড়া আদায় করেছে। ঢাকা-ময়মনসিংহের সরকার নির্ধারিত ভাড়া ২১৫ টাকা। শেষ সময়ে, 'আলম এশিয়া' 'শ্যামলী বাংলা', 'রাজীব পরিবহন'সহ বিভিন্ন বাসে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়।

দুর্ভোগ ছিল ঢাকাতেও। গাবতলী, কল্যাণপুর ঘুরে দেখা যায় এক থেকে আড়াই ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ছে বাস। বাসের কাউন্টার ব্যবস্থাপকরা বলছেন, ফেরার সময়ে মহাসড়কে যানজটের কারণে বাস ঢাকায় আসতে দেরি হচ্ছে, মূলত সে কারণে দেরি। উত্তরাঞ্চলের রুটে টাঙ্গাইলে যানজটের কারণে গাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রুটের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে জটের কারণে বিলম্ব হচ্ছে। গরুর হাটের কারণে গাবতলীতে ছিল যানজট। এ কারণে টার্মিনাল ছাড়তে দেরি হচ্ছে।

সকাল সাড়ে ৮টায় শ্যামলী পরিবহনের দিনাজপুরগামী বাস গাবতলী থেকে ছাড়ে বেলা সাড়ে ১১টায়। শ্যামলী পরিবহনে সাড়ে ৮টার রংপুরগামী বাস ছাড়ে ১১টায়। দেরির জন্য মহাসড়কের যানজটকে দায়ী করেন শ্যামলী পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক শাহজাহান সিরাজ।

একই অবস্থা ছিল দক্ষিণবঙ্গের বাসের। হানিফ এন্টারপ্রাইজের কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক একেএম রইসুল আলম সবুজ জানান, ফেরিঘাটে দেরি হচ্ছে। এ কারণে বাস ঢাকায় ফিরতে দেরি হচ্ছে। ঢাকা থেকে ছাড়তেও দুই ঘণ্টা পর্যন্ত দেরি হচ্ছে।

তারপরও খুশি সাধারণ মানুষ। হানিফ পরিবহনের ঠাকুরগাঁওয়ের যাত্রী শোয়েব রহমান বলেন, ঈদে বাড়ি যেতে হবে। এ সময়ে দুই-তিন ঘণ্টা দেরি হওয়া স্বাভাবিক। একই কথা অন্য যাত্রীদেরও। বাড়ি যেতে পারছেন, এতেই তারা খুশি।

আগের তিন দিনের মতো গতকালও উপচেপড়া ভিড় ছিল কমলাপুরে। অধিকাংশ ট্রেন নির্ধারিত সময়ে না ছাড়ায় যাত্রীদের মহাভোগান্তি হয়েছে। ভাদ্রের তালপাকা গরমে প্ল্যাটফর্মে পা ফেলার জায়গা ছিল না। মানুষের ভিড়ের সঙ্গে গরমে পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে।

সকাল ৯টার 'রংপুর এক্সপ্রেস' কমলাপুর ছাড়ে দুপুর ১২টায়। রোববার আট ঘণ্টা দেরি করা 'লালমনি এক্সপ্রেস' গতকালও পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। সকাল সোয়া ৯টার 'লালমনি ঈদ স্পেশাল' সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে বিকেল পৌনে ৩টায় ছাড়ে।

নীলফামারীগামী 'নীল সাগর এক্সপ্রেস' চার ঘণ্টা, রাজশাহীগামী 'ধূমকেতু এক্সপ্রেস' তিন ঘণ্টা, খুলনাগামী 'সুন্দরবন এক্সপ্রেস' দুই ঘণ্টা দেরিতে ঢাকা ছাড়ে। অন্যান্য ট্রেনও কমবেশি দেরি করে। কমলাপুরে 'নীল সাগর এক্সপ্রেসে'র যাত্রী আবু হেনা বলেন, সড়কে যানজটের ভয়ে ট্রেনে যাচ্ছেন। ট্রেনেও দুর্ভোগ। তারপর বাড়ি যেতে পারছেন, এটাই সান্ত্বনা।

গতকাল বিকেল থেকে ট্রেনে উপচেপড়া ভিড় ছিল। প্রতিটি ট্রেনের ভেতরে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না 'স্ট্যান্ডিং টিকিটের' যাত্রীতে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরাতেও ছিল বাড়তি যাত্রী। পুলিশ ও আনসারের বাধা উপেক্ষা করে ট্রেনের ছাদও ছিল যাত্রীতে বোঝাই।

কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী জানান, যাত্রীর অতিরিক্ত চাপের কারণে ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। এ কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে, ঢাকায় ফিরে আসতেও একই ঘটনা ঘটছে। সময়সূচিতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এতে।

http://samakal.com/bangladesh/article/18081160