২০ আগস্ট ২০১৮, সোমবার, ১০:৫৯

বেতন-বোনাস নিয়ে পোশাক শিল্প খাত থমথমে

বাড়তি উত্তেজনা ছড়াচ্ছে ন্যূনতম মজুরি ইস্যু

ন্যূনতম মজুরি প্রশ্নে এমনিতেই তৈরী পোশাক শিল্প খাতের শ্রমিকদের মনে অসন্তোষ বিরাজ করছিল। মালিকপক্ষ কোনোভাবেই ছয় হাজার ৩৬০ টাকার বেশি ন্যূনতম মজুরি মেনে নিতে নারাজ। অপর পক্ষে শ্রমিকদের দাবি বর্তমান দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় কমপক্ষে ১২ হাজার ২০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে ন্যূনতম মজুরি। দুই পক্ষের এমন দূরতম অবস্থানে দূরত্ব বাড়ছে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কেও। এরই মধ্যে এসে গেছে পবিত্র ঈদুল আজহা। গতকাল পর্যন্ত বেশির ভাগ কারখানায় বোনাস দেয়া হয়নি। জুলাই মাসের বেতন পাননি অর্ধেকের বেশি শ্রমিক। বেতন-বোনাস দাবিতে প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় প্রতিদিন কয়েকটি করে মানববন্ধন করছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। সবমিলিয়ে ঈদের আগের কয়েকটি দিন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে দেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাতের জন্য।

ঈদের আগে শ্রমিক অসন্তোষ এড়াতে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মালিকদের দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী ঈদ-বোনাস প্রদানের তারিখ গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় ঈদের আগে চলতি আগস্ট মাসের মজুরির একটি অংশ পরিশোধ করার জন্য। কিন্তু অনেক কারখানা এখন পর্যন্ত জুলাই মাসের মজুরিই পরিশোধ করেনি। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করলেও মালিকপক্ষ কেবল চেষ্টায় সীমাবদ্ধ বলে শ্রমিকদের অভিযোগ। কিছু কারখানায় বেতন বকেয়া থাকলেও বিজিএমইএ নেতারা আশা করছেন, শেষ পর্যন্ত সব শ্রমিকই কমবেশি বোনাস পাবেন।
এ দিকে ঈদের আগে তৈরী পোশাক শিল্পখাতে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানা গেছে। বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমিক অঞ্চলগুলোয় চলমান বিক্ষোভ যেকোনো সময় ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকার এবং পোশাক শিল্পমালিকদের এমন আগাম তথ্যই দিয়েছে। পূর্ভাবাস আমলে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে বিশেষ সক্রিয় করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি। পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া একটি গোয়েন্দা সংস্থার সম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছরের মতো এবারো ঈদের আগে রাজধানীর আশপাশেসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে। সমস্যা হতে পারে এ রকম প্রায় দেড় হাজার কারখানার তালিকাও তৈরি করেছে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি। সতর্কতা হিসেবে তৈরী পোশাক কারখানা অধ্যুষিত ঢাকার আশুলিয়া, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে শ্রমিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
জানা যায়, ঘন ঘন চাকরি বদলের প্রবণতা থেকে শ্রমিকদের বিরত রাখতে বেশির ভাগ তৈরী পোশাক কারখানায় এক মাসের বেতন দেয়া হয় পরের মাসের ১০ তারিখে। কোনো কোনো কোরখানায় এ তারিখ ১২ থেকে ১৫ পর্যন্ত গড়ায়। এ বছর মাসের মাঝামাঝিতে ঈদ হওয়ায় একই সময়ে ঈদ বোনাস পরিশোধের চাপও পড়েছে মালিকপক্ষের ওপর। একই সময়ে বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে যেসব কারখানা উৎপাদনে নেই তাদের জন্য এবারের ঈদ এসেছে অনেক জটিলতা নিয়ে।

সূত্র মতে, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর নিয়মিত উৎপাদনে না থাকাসহ অন্যান্য কারণে ৫৫০ কারখানার সদস্যপদ বাতিল করেছে বিজিএমইএ। আয়-ব্যয়ের সাথে তাল মেলাতে না পারায় ৩০০ কারখানা মালিক পক্ষ নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছে। নিয়মিত উৎপাদনে না থাকার কারণে ১৮০ কারখানার সদস্যপদ বাতিল করেছে উদ্যোক্তাদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএ। মালিকেরা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছেন বিকেএমইএভুক্ত ২০০ কারখানা। সংস্কার কার্যক্রমে অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় এ পর্যন্ত ২৩২ কারখানা নিজেদের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। এসব কারখানার সাথে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন ক্রেতারা। এ কারখানাগুলো দুই জোটের কোনো ক্রেতারই রফতানি আদেশ পাচ্ছে না। কার্যত এসব কারখানা এখন বন্ধ।
অসন্তোষ বিরাজ করছে ন্যূনতম মজুরি নিয়েও। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনোরূপ মিছিল-মিটিং-ভাঙচুর করা ছাড়াই তৈরী পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের লক্ষ্যে বোর্ড গঠন করে সরকার। শুধু তা-ই নয়, তৈরী পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ উল্টো সরকারকে অনুরোধ করেছিল এ বোর্ড গঠন করার জন্য। কারণ বিদ্যমান পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি এতটাই কম যে, শ্রমিকদের আন্দোলন ছাড়াই ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ জানুয়ারি গঠন করা এ বোর্ডের প্রধান নিযুক্ত করা হয় সৈয়দ আমিনুল ইসলামকে। কিন্তু বোর্ড গঠনের পরই দেখা দেয় বিপত্তি। শ্রমিকেরা ১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দাবি তুললেও মালিকপক্ষ রয়েছেন এর অর্ধেকে।
জানা যায়, দেশের রফতানি আয়ে ৮২ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী তৈরী পোশাক শিল্প খাতের জন্য প্রথম ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৫ সালে। সরকার, মালিক এবং শ্রমিকপক্ষ মিলে তখন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫৪২ টাকা। তিন হাজার ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০১৩ সালে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। মাঝে দুই বোর্ড সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করেছিল ৯০০ এবং ১৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা। প্রতিবারই মজুরি বোর্ড গঠনের পর মালিক এবং শ্রমিক পক্ষের বাগি¦তণ্ডা হয়েছে, পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। তবে প্রতিবারই মালিকপক্ষ জয়ী হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির সভাপতির মো: সিদ্দিকুর রহমান বর্তমানে অসুস্থ হয়ে বিদেশে চিকিৎসাধীন। মজুরি প্রসঙ্গে গত সপ্তাহে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেছিলেন, মজুরি পুণঃনির্ধারণের প্রস্তাব আমরাই দিয়েছি। আমরা চাই আমাদের শ্রমিক ভাই-বোনেরা ভালো থাকুক। তারা ভালো থাকলে আমাদের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আমাদের সামর্থ্যও দেখতে হবে। তিনি বলেন, মজুরি ঠিক করতে হবে কারখানার সক্ষমতা অনুযায়ী। ধরুন আপনি একটা মজুরি ঠিক করলেন কিন্তু দিতে পারলেন না। অতিরিক্ত চাপে পড়ে কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। তখন তো মালিকের পাশাপাশি শ্রমিকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার মতে, মজুরি বাড়াতে হবে, পাশাপাশি শিল্পও টিকিয়ে রাখতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/342751