ড. মাহবুব উল্লাহ।
১৯ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:৫৩

ঈদ, নগরায়ণ ও বিবিধ ভাবনা

ড. মাহবুব উল্লাহ্

নগরায়ণ সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। যে দেশ যত উন্নত হয়, সে দেশের জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ নগরে বাস করে। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে শহরে বাস করা মানুষের অংশ ৮৫-৯৫ ভাগ।
যেসব কারণে নগরায়ণের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তার মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর উৎপাদিকা শক্তি, অতি অল্প পরিসরে বৃহৎ মূল্য সংযোজন এবং তথ্যের সহজ প্রবাহ। এ বৈশিষ্ট্যগুলো নগর বা শহরকে দেয় অর্থনৈতিক নিবিড়তা। যেসব দেশ উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে গেছে, সেসব দেশের শহর বা নগরবাসী জানে না, গ্রামেও তাদের একটি ঠিকানা আছে।

জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ গ্রামে বাস করে এবং বিশাল বিশাল খামারে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন করে। এসব দেশের কৃষিতে জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়োজিত থাকলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, শাক-সবজি, ফল-ফলাদি, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য এবং মাছ-মাংসের জোগান দেয় তারা।
এটা সম্ভব এ কারণে যে, ওইসব দেশে কৃষি মূলত বৃহদায়তন খামারনির্ভর। আমি একজন কানাডিয়ান খামারির কথা জানি, যার খামারটি ৮০০ হেক্টরের। এ খামারি কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি করার পর খামারির জীবন বেছে নিয়েছে।

সে একাই ট্রাক্টর দিয়ে বিশাল এ খামারের চাষের কাজ সম্পন্ন করে। ফসল তোলার জন্য সে ব্যবহার করে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। তাকে খামারের কাজে সহায়তা করে তার পরিবারের ২-৩ জন সদস্য। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এ মানুষটিকে বাংলাদেশের কৃষকের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।
সে খামারবাড়িতে বসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে এবং তার বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে। তার দৃষ্টি পুরো বিশ্বে প্রসারিত। কৃষক সমাজ সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক এবং অর্থনীতিবিদরা যে বর্ণনা দেন তার সঙ্গে কানাডার এ খামারির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বছরের একটা সময়ে সে পর্যটক হিসেবে অন্য কোনো দেশে ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়ে।
অনুন্নত বিশ্বের কৃষকদের সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানীরা বলেন, তারা কুসংস্কারের নিমজ্জিত, অপরিচিতদের ব্যাপারে সন্ধিগ্ধ এবং মুনাফার লক্ষ্যে বরং নিজের ভরণপোষণের সামগ্রী উৎপাদনই তার লক্ষ্য এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে তার যোগাযোগ খুবই সামান্য।

তার বেঁচে থাকাকে তুলনা করা হয় জলরাশিতে কোনোরকমে নাকটা পানির ওপরে রেখে টিকে থাকার সঙ্গে। বাংলাদেশে এখন পুরোপুরি সনাতনী কৃষক খুঁজে পাওয়া যাবে না। নগর জীবনের সঙ্গেও এদের গভীর সম্পর্ক আছে। এদের পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য শহর-নগরে গিয়ে আয় রোজগারের চেষ্টা করে।
অতীতের মতো এরা এখন আর তেমন কুসংস্কারে নিমজ্জিত নয়। রোগ-বালাইতে ঝাড়-ফুঁক, তাবিজের বদলে আধুনিক চিকিৎসার সুযোগে আগ্রহী। তবুও মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে জিন-ভূত তাড়ানোর কাহিনীও আমরা পড়ে থাকি। বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে কেউ না কেউ দূরদেশে কর্মসংস্থানের জন্য বহু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ছুটে যায়।
জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশে জমির পরিমাণ খুবই সীমিত। এ দেশে মাথাপিছু জমির পরিমাণ চার বা পাঁচ শতকের বেশি নয়। প্রতিবছর বিশালসংখ্যক মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়লেও ইউরোপ বা আমেরিকার মতো বৃহদায়তন খামারের উদ্ভব লক্ষ করা যায় না।

নিকট ভবিষ্যতেও এ ধরনের পুঁজিবাদী খামার গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। নানা আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতার ফলে বৃহদায়তন পুঁজিবাদী খামারের উদ্ভবও সম্ভব হচ্ছে না। তবে দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বড় পুঁজির মালিকরা ছলে-বলে-কৌশলে বৃহৎ ভূমিখণ্ড আয়ত্ত করার চেষ্টা করছে এবং তাকে কেন্দ্র করে বৃহৎ খামারসুলভ উৎপাদন ব্যবস্থা শুধু মুনাফার লোভে গড়ে তুলছে।
তবে সাধারণ কৃষকরাও এখন বাজারমুখী। তাদের আয়ত্তে যে সামান্য পরিমাণ জমি থাকে তাতে তারা উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করার এবং মাছ, মুরগি ও পশুর খামার গড়ে তোলারও চেষ্টা করে।
নিবিড় চাষের মাধ্যমে সামান্য জমি থেকে অধিক ফসল উৎপাদনেও এরা নিয়োজিত হয়। ফলে শস্যের উৎপাদন বাড়ছে এবং তার পাশাপাশি মাছ-মুরগি এবং গবাদি পশু পালনেরও আয়োজন চলছে। এটা কৃষির এক ধরনের রূপান্তর বটে।

তবে এটা ঘটছে নিছক বেঁচে থাকার তাগিদে। বাংলাদেশে কৃষি ও কৃষিবহির্ভূত কাজকর্মের মধ্য দিয়ে পারিবারিক প্রয়োজন মেটানোর একটি প্রাণান্তকর প্রয়াসও লক্ষ করা যায়।
একদিকে গ্রামীণ জীবনেও কৃষির সঙ্গে কৃষিবহির্ভূত খাতের সমন্বয় ঘটছে, আবার অন্যদিকে শহর ও নগর থেকে আয়-রোজগারেরও উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার প্রতি আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। এ দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব বেশি কেন্দ্রিকায়িত।
রাজধানী ঢাকা এখন প্রায় ২ কোটি মানুষের আবাস এবং রুটি-রুজিরও কেন্দ্রস্থল। এ শহরে বিচিত্র কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রাম থেকে আসা লাখ লাখ মানুষ।
ঈদের মতো উৎসবের সময় আসলে রাজধানী ঢাকা অনেকটাই জনশূন্য হয়ে পড়ে। চিরচেনা ঢাকার যানজট প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। অন্তত সপ্তাহখানেকের মতো এরকম দৃশ্য আমরা ঢাকায় দেখতে পাই। টেলিভিশনের ভাষ্যকাররা একে বলেন, নাড়ির টানে মানুষের ঘরে ফেরা।

এখনও এ দেশে ঘরে ফেরা বলতে বোঝানো হয় গ্রামমুখী যাত্রা। হাজার হাজার মানুষ ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করার জন্য ঈদের দু-তিন সপ্তাহ আগে থেকেই কমলাপুর রেলস্টেশনে ভিড় করেন। এরা সারা রাত জেগে টিকিটের প্রত্যাশায় লাইন ধরেন। তারপরও প্রত্যাশিত টিকিটটি পাওয়া যায় না।
ট্রেনের টিকিটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভিআইপি ও রেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা হয়। বাকি টিকিটের জন্য লাখ লাখ মানুষ একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এরকম অবস্থায় ডিজিটাল টিকিট পেতে গিয়ে যখন সার্ভার বিভ্রাট তৈরি হয় তখন ভোগান্তি বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট না পেয়ে কালোবাজারিদের কাছ থেকে দ্বিগুণ বা তিন গুণ দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হয়। এমন প্রাণান্তকর প্রয়াসের পরও বহু লোককে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হয়। রেল বিভাগের দাবি ঈদযাত্রার জন্য অতিরিক্ত বগি এবং বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়।
তারপরও যেসব যাত্রী ট্রেনে বাড়ি যেতে চান তাদের অনেকেই যেতে পারেন না। অনেকে ট্রেনের ছাদে উঠেও বিপজ্জনক ঝুঁকির মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। ঈদের সময়ের ট্রেনগুলোর ছবি অনেকটা মৌমাছির চাকের মতো। আসলে এ চাক মৌমাছিরূপী মানুষেরই চাক।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে রেল যোগাযোগ উন্নয়নের জন্য তেমন কোনো প্রয়াস লক্ষ করা যায়নি। রেল লাইনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। নেই সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ। ইঞ্জিনের ঘাটতি, বগির ঘাটতি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আমাদের রেল ব্যবস্থা।

রেলের দুটি বড় ওয়ার্কশপ পাহাড়তলি ও সৈয়দপুর ওয়ার্কশপের জন্য কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয় করার পরও এগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও কারিগরের অভাব রয়েছে। প্রায়ই টেনের বগি বা ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হওয়ার খবরও পাওয়া যায়।
এর ফলে সাধারণ সময়েও যাত্রীদের দারুণ ভোগান্তি হয়। ঈদের সময় যদি কোনো ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে হতাহতের সংখ্যা সাধারণ সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
ট্রেনের পরে আসে সড়কপথে বাসে করে বাড়ি ফেরার চেষ্টা। সড়ক-মহাসড়কে বাস দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরে ১৮-২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে অথবা আহত হয়। এ ছাড়াও রয়েছে যানজট ও খানাখন্দের ভোগান্তি।

মাত্র ক’দিন আগে কিশোররা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এ দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা কতটা ত্র“টিপূর্ণ। ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালক, পরিশ্রান্ত ও ক্লান্ত চালকদের দিয়ে গাড়ি চালান এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি আমাদের সড়ক যোগাযোগের বড় সমস্যা। এ সমস্যা একদিনে তৈরি হয়নি।
বছরের পর বছর ধরে স্বার্থান্বেষী মহল এবং দুর্নীতিপরায়ণ সড়ক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অশুভ আঁতাতের ফলে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ মৃতু্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
কিশোরদের আন্দোলনের দুই সপ্তাহের মাথায় ঈদ চলে আসায় অনেক ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামতে পারবে না। ফলে বাসে যে পরিমাণ মানুষ গ্রামে ফিরতে চায় তারাও বাসের টিকিট পাবেন কিনা সন্দেহ। ফলে তাদের ট্রাক বা অন্য কোনো ধরনের যানের ওপর নির্ভর করতে হবে।
এ ছাড়া সড়কের যানবাহন দেখভালের জন্য যে সংস্থা রয়েছে তার কর্মক্ষমতাও সীমিত। এ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে চালকের লাইসেন্স ও ফিটনেস ইস্যু করা হলে সেটাও কোনোক্রমে ঝুঁকি থেকে মুক্তি দেবে না। মূল সমস্যা হল আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের প্রচণ্ড ঘাটতি।
নৌপথেও হাজার হাজার গ্রামমুখী মানুষ ঈদের সময় যাতায়াত করবে। তারাও বিপদমুক্ত নন। সড়কপথের ঘাটতির চাপ নৌপথের ওপরও পড়বে। ঈদের মতো উৎসবের সময় নাড়ির টানে গ্রামমুখী হওয়ার ঝুঁকি, ক্লেশ ও ঝামেলা কিছুটা হলেও হ্রাস করা সম্ভব যদি ঈদের ছুটিটা উৎসবের আগে ও পরে আরও বাড়িয়ে দেয়া যায়। সে ক্ষেত্রে লোকজন কিছুটা স্বস্তির সঙ্গে আপনজনদের মধ্যে ঈদের আনন্দ ভোগ করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।

ঢাকা এখন পৃথিবীর আবাসযোগ্য দ্বিতীয় নিকৃষ্ট শহর। তবুও জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেই হোক, অথবা শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজনেই হোক মানুষ উত্তরোত্তর ঢাকার দিকেই ছুটছে। এটা হল কেন্দ্রিকতার বিষময় ফল। এর একমাত্র সমাধান হল মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে কেন্দ্রিকতাকে বর্জন করা প্রশাসন।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ যাবতীয় সেবার কাম্য মাত্রায় বিকেন্দ্রীকরণ। অন্যদিকে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও জনমানুষকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে বিদ্যমান জনদুর্ভোগের আশু অবসানের কোনো সম্ভাবনাই নেই। অন্যদিকে ঢাকার জীবনেও দিনে দিনে দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকা এখন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। আমি যতটুকু বুঝতে পারি তার ভিত্তিতে বলা যায়, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে পুরো বাংলাদেশটাই শহররূপী হয়ে পড়বে। এটি হবে পৃথিবীর বৃহত্তম নগররাষ্ট্র। এখন যেভাবে শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য ও দূরত্ব হ্রাস পাচ্ছে সেভাবেই চলতে থাকলে পুরো বাংলাদেশটাই হয়ে উঠবে একটি অকার্যকর, বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যময় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের উন্নয়ন শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিংবা মাথাপিছু আয়বর্ধন নয়। এ প্রক্রিয়াকে যদি একটি সুশৃঙ্খল ও জনবান্ধব নগরায়ণের পথে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে না নেয়া হয়, তাহলে সমগ্র দেশটি অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে।
এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন হবে বাংলাদেশের নিজস্ব আর্থসামাজিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি অনুধাবন করা এবং সীমিত ভূখণ্ডের মধ্যে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য যাতায়াত ও যোগাযোগ অবকাঠামো, আবাসন, সুপেয় পানির সরবরাহ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাসহ অন্যান্য সেবার দক্ষ ও টেকসই উন্নয়ন। এই উন্নয়ন অবশ্যই হবে পরিবেশবান্ধব। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যার জন্য আমরা দায়ী নই।

সুতরাং এরকম একটি জনবহুল এবং ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন কৃষি, শিল্প, জ্বালানি ও সেবা খাতের ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন। এ উন্নয়নের পথরেখা অঙ্কন করতে গিয়ে এ দেশের কৃষি ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলোকেও বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। এসব কিছু করার জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল বিনিয়োগ।
এর সঙ্গে ভাবতে হবে কীভাবে আমরা বিনিয়োগের জন্য অর্থ সংকুলান করব। প্রয়োজন হবে ব্যাপক জনসচেতনতার। আরও প্রয়োজন হবে দক্ষ পরিকল্পনাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, চিকিৎসকসহ সব ধরনের গুণমানসম্পন্ন মানবসম্পদ। একটি দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এ বিশাল কর্মকাণ্ড সম্ভব হবে না।
কথায় বলে Ignorance is bliss অর্থাৎ অজ্ঞতার মধ্যেই শান্তি থাকে। এর পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব অনুসারে বলা হয়, It is individually irrational to be well informed. অর্থাৎ ব্যক্তি পর্যায়ে অতিরিক্ত তথ্য বা জ্ঞানার্জনের খরচ যদি তা থেকে প্রাপ্ত সুবিধা থেকে বেশি হয়, তাহলে মানুষ সেরকম অতিরিক্ত তথ্য বা জ্ঞান অর্জন করতে চায় না।

এরকম অবস্থা আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও লক্ষ করেছি। সেখানে একজন সাধারণ মানুষও গর্বের সঙ্গে বলে আটলান্টিকের ওপারে কী ঘটছে তা জানার প্রয়োজন নেই। কারণ সেই দেশটি নিজের দিক থেকে এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ যে ও দেশের নাগরিকদের বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ে না।
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যে অবস্থার মধ্যে রয়েছি, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের অতিরিক্ত তথ্য ও জ্ঞানের জন্য অনেক বেশি সচেষ্ট হতে হবে। বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের চ্যালেঞ্জটি তথ্য ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে সভ্য ও উন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশি। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নির্মাণের এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে।
আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিকদের তথ্য ও জ্ঞানের ভাণ্ডার অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। এটাই হল সমস্যাসংকুল দেশটির উন্নয়নের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/82111