১৯ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১০:৪৮

বাংলাদেশে আকাশচুম্বী নির্মাণ খরচ এবং দেশ-বিদেশের চিত্র

দুর্নীতি রাহুর মতো গ্রাস করেছে বাংলাদেশের সমগ্র অর্থনীতিকে। দেশে এমন কোনো সেক্টর নাই যেখানে দুর্নীতি দানবের মতো মুখ ব্যাদান করে না আছে। দুর্নীতি সম্পর্কে বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে অনেক কথাই হয়েছে। কিন্তু সেই দুর্নীতির অবসান তো দূরের কথা, তা বিন্দুমাত্রও নিয়ন্ত্রিত হয়নি। বাংলাদেশে দুর্নীতির কথা বিভিন্ন মহল থেকে অনেক বার বলা হলেও সেটি একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ, একাধিক দেশে দুর্নীতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইস্যু নয়, রীতি মতো নির্বাচনী ইস্যু হয়েছে।

মালয়েশিয়ায় দুর্নীতি
রাজনৈতিক ইস্যু
এই তো সেদিন মালয়েশিয়াতে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ছিলো প্রধান ইস্যু। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ২২ বছর ধরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ দিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু তার উত্তরসূরি নাজিব রাজাকের আমলে দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ গ্রহণ করলে বেশ কয়েক বছর পর নাজিব রাজাকের দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতিকে নির্বাচনী ইস্যু বানিয়ে রাজনীতির মাঠে নামেন মাহাথির মোহাম্মদ। রাজাক ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী শাসক। তাকে ক্ষমতা থেকে হটানোর স্বাভাবিক কোনো রাস্তা ছিলো না। তাই চলতি বছরের নির্বাচনে কারারুদ্ধ নেতা আনোয়ার ইবরাহিমের সাথে দুর্নীতি ইস্যু নিয়ে একটি সমঝোতা করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। নির্বাচনে নাজিব রাজাকের দল শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
ভারতে দুর্নীতির ইস্যু
মাতা ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীদের গুলীতে নিহত হলে একটি ক্লিন ইমেজ নিয়ে তার সন্তান রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৭ সালে বোফর্স কেলেঙ্কারি নামে একটি বিরাট দুর্নীতি সাথে জড়িয়ে পড়েন রাজীব গান্ধী। এটি ছিলো বিদেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত একটি চুক্তি। তখনও কিন্তু দুর্নীতি সম্পর্কে বিরোধী দল কংগ্রেস বা রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে তেমন বড় কোনো প্রচারণা ছিলো না। কিন্তু এই বোফর্স কেলেঙ্কারি কংগ্রেস তো বটেই সেই সাথে তরুণ প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং তার দলকে ডুবিয়ে দেয়। ১৯৮৯ সালে ভারতে দেশব্যাপি যে সাধারণ নির্বাচন হয় ঐ নির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রধান স্লোগান ছিলো দুর্নীতির। অলি গলি এবং রাজপথেও স্লোগান ওঠে, “অলি গলি মে শ্যোর হ্যায়/রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়”। এই এক স্লোগানই নির্বাচনে রাজীব গান্ধী তথা কংগ্রেসের কাল হয়ে দাঁড়ায়।
পাকিস্তানে নির্বাচন
এই যে সেদিন পাকিস্তানে নির্বাচন হয়ে গেল সেখানে বিজয়ী দল ইমরানের পিটিআই বা পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফের স্লোগান ছিলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ। নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ দুর্নীতির প্রশ্ন বানে জর্জরিত ছিলো। নওয়াজ শরীফের শাসনকালের বিরুদ্ধে র্দুীতিকেই প্রধান এজেন্ডা করে মাঠে নামেন ইমরান খান। নির্বাচনের আগে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে নওয়াজ শরীফের নাম ছিলো। সেই সূত্রে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হয় এবং অনুসন্ধানে রিপোর্টের আংশিক সত্যতা পাওয়া যায়। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরীফকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে নওয়াজ শরীফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান। সেই দুর্নীতির সূত্র ধরেই সদ্য সমাপ্ত পাকিস্তানের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অবশেষে এই অভিযোগেই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, তার ৪৪ বছর বয়ষ্কা কন্যা মরিয়ম নওয়াজ এবং তার স্বামী সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজরকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরা সকলেই এখন কারাগারে আছেন। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি।

বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগ
২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ দুই মেয়াদে প্রায় সাড়ে ৯ বছর দেশ শাসন করলো। এই সাড়ে ৯ বছরে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু কোনো অভিযোগই সরকার আমলে নেয়নি। সেই যুবক, ডেস্টিনি, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি ইত্যাদি হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু কোনোটারই কোনো বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি।
নির্মাণ কাজে পুকুর চুরি
বাংলাদেশে চুরি বা ডাকাতি হয়। এমনকি পুকুর চুরিও হয়। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী আমলে যে চুরি হয়েছে সেটাকে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন সাগর চুরি। নির্মাণ কাজে, বিশেষ করে সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণে বাংলাদেশে যা খরচ হয় পৃথিবীর কোনো দেশে এত খরচ হয় না। এসম্পর্কে ১৭ জুলাই ইংরেজি পত্রিকা ‘ডেইলি স্টারে’ একটি আতঙ্কজনক খবর বেরিয়েছে। খবরটির শিরোনাম “ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ নবযরহফ যরময পড়ংঃং রহ পড়হংঃৎঁপঃরড়হ ঢ়ৎড়লবপঃং” অর্থাৎ নির্মাণ প্রকল্প ব্যয় অত্যধিক হওয়ার পেছনের কারণ হলো দুর্নীতি। একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান পাওয়ার পয়েন্ট প্রজেকশনের মাধ্যমে ভয়াবহ দুর্নীতির কতিপয় তথ্য তুলে ধরে।

রেল পথ নির্মাণ : বাংলাদেশে
২৫০ কোটি বিদেশে ৩০ কোটি
পরিবেশিত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, সারা পৃথিবীতে প্রতি কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণে খরচ হয় ১২ কোটি থেকে ৩০ কোটি টাকা। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি কিলো মিটার রেল লাইন নির্মাণে খরচ হয় ২৫০ কোটি টাকা। পরিবেশিত তথ্য থেকে আরো দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সেতু, রাস্তা, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণে যে খরচ হয় সেটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে চার থেকে পাচ গুণ বেশি।
মানি লন্ডারিং : বছরে
৭৫ হাজার কোটি টাকা
২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি রিপোর্ট। মোটা দাগে বলা যায় যে, বছরে ১ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়। এব্যাপারে পাওয়ার পয়েন্ট প্রজেকশনে দেখা যায় যায় যে প্রতি বছরে বিদেশে অর্থ পাচার হয় ৭৫ হাজার কোটি টাকা।

পদ্মা সেতুর দুর্নীতি
নির্মীয়মান পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য হলো ৬.১৫ কিলোমিটার। ইতোমধ্যেই এই সেতু নির্মাণে খরচ বাড়তে বাড়তে ৪০ হাজার কোটিতে উন্নীত হয়েছে। পক্ষান্তরে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৯.১৫ কিলোমিটার ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণ করতে খরচ হয়েছে ১১ শত ৫০ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে যে, ভূপেন হাজারিকা সেতুর দৈর্ঘ্য পদ্মা সেতুর চেয়ে ৩ কিলোমিটার বেশি। তাহলে পদ্মা সেতুর প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ খরচ কত হাজার কোটি টাকা সেটি পাঠক অনুমান করুন। দেখা যাচ্ছে যে পদ্মা ব্রীজে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ খরচ ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অথচ ভারত, চীন, মালয়েশিয়া এবং ব্রুনেইয়ে এই খরচ ৫ শত থেকে ৭ শত কোটি টাকা। ভিয়েতনামে এই খরচ ২০৫ কোটি টাকা।
ফ্লাইওভার
বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণের খরচ ১৫০ কোটি টাকা থেকে ১৮০ কোটি টাকা। ভারতে এই খরচ ৪৮ কোটি টাকা থেকে ৮৮ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে চীন এবং মালয়েশিয়াতে এই খরচ ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকা।
রেল লাইন
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত প্রলম্বিত রেল লাইনে প্রতি কিলো মিটার নির্মাণ খরচ হলো ২৫০ কোটি টাকা, ঢাকা যশোর রেল লাইন খরচ প্রতি কিলোমিটার ২০৩ কোটি টাকা এবং দোহাজারি ঘুন্দুম প্রতি কিলোমিটার ১৩৯ কোটি টাকা। চীন ও ভারতে এই খরচ ১২ কোটি টাকা, পাকিস্তানে ১৫ কোটি এবং ইউরোপ বা আমেরিকাতে ৩০ কোটি টাকা।
ফোর লেন
প্রতি কিলোমিটার ফোর লেন নির্মাণের গড় ব্যয় ৫৯ কোটি টাকা। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ফোর লেনের খরচ কিলোমিটার প্রতি ৯৫ কোটি টাকা। ইউরোপে এই খরচ ২৮ কোটি, ভারতে ১০ কোটি এবং চীনে ১৩ কোটি।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূলধন ব্যয়
বাংলাদেশেল রূপপুর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হবে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রাশিয়া। ভারতে এটি ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতেও একই ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করেছে রাশিয়া।
এসব তথ্য পরিবেশন উপলক্ষ্যে প্রেস ক্লাবে যে সমাবেশ হয় সেই সমাবেশে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে বাংলাদেশে একটি সাধারণ চাকরি পাওয়ার জন্য প্রার্থীকে ঘুষ দিতে হয় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা।

এতক্ষণ ধরে বর্ণনা করা হলো কীভাবে কারসাজি করে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে এবং কার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করা হচ্ছে। এবার কিছু তথ্য দেব বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির। এর আগেও বলেছি এখনো বলছি যে, এই কলামে যতগুলো তথ্য দিয়েছি কোনোটাই আমাদের নিজস্ব তথ্য নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো নিয়ে আমরা গবেষণা করেছি, সংকলন করেছি এবং সংরক্ষণ করেছি। এখন ১০টি তথ্য দেব। এসব তথ্যও সেই একই প্রক্রিয়ায় আহরণ করা হয়েছে। বিগত ১০ বছরে এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে সব তথ্য এসেছে এবং রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের তরফ থেকে যেসব অভিযোগ উত্থিত হয়েছে সেগুলো থেকে এই ১০টি তথ্য দিচ্ছি। মাত্র এই দশটি তথ্যে সরকারের একজনের বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগ প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

এর পাশাপাশি যখন দুই কোটি টাকার যে টাকা কার্যত আত্মসাতই হয়নি, বরং সে টাকা ব্যাংকে সুদে-আসলে প্রায় তিনগুণ হয়েছে) দুর্নীতি মামলায় বেগম জিয়াকে ৫ বছরের জেল খাটতে হয় তখন বুক চাপড়িয়ে বলতে হয়, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।
Email: asifarsalan15@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/342434