১৮ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ১২:২৮

দেশের আর্থিক কেলেংকারির খবর জনগণকে জানাতে চায় না সরকার

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে দেশে একের পর এক ভয়াবহ আর্থিক কেলেংকারির ঘটনা ঘটেই চলেছে। দেশের আর্থিক কেলেংকারির খবর জনগণকে না জানাতে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সব ব্যাংকে আর্থিক অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। আবার অর্থ লোপাট ও চুরির ঘটনা ঘটার পর তা ধামাচাপা দেয়ারও চেষ্টা চলে। কিন্তু মিডিয়ার কল্যাণে অনেক ন্যক্কারজনক ঘটনাই প্রকাশ পেয়ে যায়। কেন মিডিয়ায় আসলো আর কেনইবা দেশের জনগণ সরকারের এ দুর্নীতির খবর জেনে গেলো। এটাই তাদের মাথাব্যাথার বড় কারণ। দেশের ব্যাংকের অনিয়মের খরব মিডিয়ায় না আসতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়িয়েছে সরকার।

জানা যায়, রিজার্ভ চুরির মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল সরকার। বাংলাদেশ সরকার ও ব্যাংক এ সংক্রান্ত সকল তথ্য গোপন রাখে। কিন্তু ফিলিপাইনের মিডিয়ার কল্যাণে তা ফাঁস হয়ে যায়। আর তখনই বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে চুরির ঘটনা। নিজ দেশে ঘটে যাওয়া এতো বড় দূর্ঘটনার খবর জানতে হয় অন্য দেশের মিডিয়া থেকে। বাংলাদেশের রিজার্ভের টাকা ফিলিপাইনে পাচার হয়ে গেলে সে দেশের সংবাদ মাধ্যম তা প্রকাশ করে। সেই সংবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা।
রাষ্ট্রের বেহাল দশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জায়গা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকেও অর্থ চুরি হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি সময়ে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন (৮ কোটি ১০ লাখ) ডলার বাংলাদেশি টাকায় ৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতার কারণে অল্পের জন্য রক্ষা পায় আরও প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রিজার্ভ চুরির এই ঘটনাটি ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঘটলেও তা বাংলাদেশের মানুষ এক মাস পর ৫ মার্চ জানতে পারে।
হলমার্ক দুর্নীতি ছিল ব্যাংকিং জগতের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এ ঘটনা অর্থনীতিবিদদের মতো গোটা দেশের মানুষকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছিল। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে ২০১০-১২ সময়ের মধ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয় তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপই হাতিয়ে নেয় আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। এতো বড় ঘটনা ঘটলে তা দুই বছর পর্যন্ত জানতে পারেনি কেউ। অবশেষে মিডিয়ার কল্যাণে ২০১০ সালের ঘটনা প্রকাশ পায় ২০১২ সালে।
হলমার্কের রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৩ সালে প্রকাশ পায় বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারীর ঘটনা। টেরি টাওয়েলস রপ্তানির ভুয়া তথ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী।

এক সময়ের আদর্শ ব্যাংক বলে খ্যাত রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক এখন দেউলিয়ার পথে। ব্যাংকটি থেকে গত ৮ বছরে বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানির নামে আট হাজার কোটিরও বেশি টাকা পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে ব্যাংকটিকে বাঁচাতে বার বার জনগণের করের টাকা দেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত জুন মাসে ব্যাংকটিকে মূলধন ঘাটতি পূরণে একহাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। আর গত ৪ বছরে বেসিক ব্যাংকের লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, ব্যাংকটির ৬৮টি শাখার মধ্যে ২১টিই লোকসান গুনছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর আমলের চার বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকা বের করে নেয়া হয়। ২০১৪ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে আরো প্রায় চার হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে তৎকালীন চেয়ারম্যান, এমডি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে এই ব্যাংকটিতে নানা ধরনের অনিয়মের কারণে সব সূচকের অবনতি হয়েছে।

বেসিক ব্যাংকে বিপর্যয়ের শুরু হয় ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর সময়ে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ওই সময়েই ঘটে বড় অংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ ব্যাংকে লুটপাট শুরু হয়। আর এ ঘটনা প্রকাশ পায় ২০১৪ সালে এসে।

জনতা ব্যাংকের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করেছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। আর এ ঘটনায় যোগসাজশের জন্য ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুস সালামকে দায়ী করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। শুধু তাই নয়, সাবেক এই এমডির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে জনতা ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদ। জনতা ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে সাবেক এমডি আবদুস সালাম ও তিনজন ডিএমডির বিরুদ্ধে চরম দায়িত্বহীনতার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং রীতিনীতি লঙ্ঘন করে পর্ষদকে এড়িয়ে এই তিন কর্মকর্তা ক্রিসেন্ট গ্রুপকে বেআইনিভাবে ঋণ সুবিধা দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্রিসেন্ট গ্রুপ ২০১৩ সাল থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া শুরু করে। ২০১৪ সালে এসে ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে গ্রাহককে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়া হয়। ঘটনা ২০১৩ সালে শুরু হলেও তা গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে এসে তা প্রকাশ পায়।

সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক অনুসন্ধানের তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা ভল্টের সোনা নিয়ে অভিযোগ সামনে আসে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের ৯৬৩ কেজি সোনা পরীক্ষা করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনিয়ম ধরা পড়েছে। ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের সোনার চাকতি ও আংটি জমা দেয়ার সময় যা ৮০ শতাংশ বিশুদ্ধ সোনা হিসেবে গ্রহণ করে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, দুই বছর পর তা পরীক্ষা করে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ সোনা পাওয়া গেছে। আর ২২ ক্যারেটের সোনা হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে থাকা সোনার হেরফেরের ঘটনাও ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলে। অবশেষে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনা ঘটেছে আরও দু’বছর আগে। ঘটনার দুই বছর সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এনবিআর-এর চিঠি চালাচালি হয়ে আসছে। দীর্ঘ দুই বছর পর তা মিডিয়ার চোখে ধরা পড়লো। আর এতেই বের হয়ে এসেছে সরকারের থলের বিড়াল।
একের পর এক দূর্নীতির খবর প্রকাশ পাওয়ায় জনগণের রোষাণলে পড়েছে সরকার। আর এর সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ক্ষোভ ঝাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনায় অনিয়মের খবর প্রকাশ হওয়ায় দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এই খবরটি গণমাধ্যমে কেন গেল- সংসদীয় কমিটি সেই প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সাবধান হতে বলেছে।
বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনা তথ্য গণমাধ্যমে এল কেন-এতে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবধান হওয়া উচিত।

http://www.dailysangram.com/post/342238