১৭ আগস্ট ২০১৮, শুক্রবার, ৭:৩৫

পুঁজির অভাবে বিপাকে লক্ষাধিক চামড়া ব্যবসায়ী

# চামড়া দেয়ার শর্তে গরু আসছে ভারত থেকে
# সংকট কাটাতে ব্যাংক ঋণ চায় আড়ৎদাররা
এইচ এম আকতার: কারখানা স্থনান্তরের অজুহাতে গত তিন বছর ধরেই কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের বকেয়া পরিশোধ করছেন ট্যানারি মালিকরা। পুঁজির অভাবে বিপাকে পড়েছেন সারা দেশে লক্ষাধিক চামড়া ব্যবসায়ী। তাদের দাবি, চলতি বছরসহ গত ৩ বছর ধরে জমতে থাকা তাদের পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর ব্যাংক ঋণ নিয়ে কারখানা উন্নয়নের কাজ করলেও কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করছে না ট্যানারি মালিকরা। সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রতিবেশি রাষ্ট্র থেকে গরু আনা হয় চামড়া দেয়ার শর্তে। চামড়া পাচার করতেও অগ্রিম টাকা আনেন সীমান্তের কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা।

ব্যাংক থেকে চামড়া ব্যবসায়ীদের ঋণ গ্রহণেরও সুযোগ নেই জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এবারে চামড়ার যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। তাদেও অভিযোগ সারা দেশে থেকে আমরা প্রাথমিকভাবে চামড়া ক্রয় করে থাকি এবং এ টাকা ঈদের দিনেই পরিশোধ করতে হয়। এক দিনে এত টাকা পরিশোধ করা অনেক কঠিন ব্যাপার। তারা বলেন ২০/২৫ হাজার কোটি টাকার বাজার ব্যাংক ঋণ ছাড়া পরিশোধ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আর এ কারণেই প্রতি বছরই ভারতে চামড়া পাচার হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার যদি সরাসরি চামড়ার আড়ৎদারদের ব্যাংক ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে তাহলে চামড়ার এত দুরদিন আসতো না। এ শিল্প এখন টিকিয়ে রাখা হয়েছে বাকির ওপর। কিন্তু আমাদের পক্ষে আর বাকি দেয়া সম্ভব নয়। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সরকার যদি চামড়ার আড়ৎদারদের ব্যাংক ঋণ না দেয় তাহলে চামড়া চলে যাবে প্রতিবেশি দেশে। সরকার সীমান্তে যতই কড়া নজরদারি বসাক না কেন। তা চলে যেতে বাধ্য।

তাদের অভিযোগ সরকার ঋণ দিলেও তার কোন মনিটরিং নেই। তারা চামড়া না কিনে ঋণের টাকায় কারখানা নির্মাণ করছে। তারা বিদেশী রফতানি অর্ডার পেলেই কেবল চামড়া ক্রয় করে থাকেন। তা না হলে বছরের পর বছর ওয়েট-ব্লু চামড়া আমাদের গোডাউনে পড়ে থাকে।
সূত্র আরও জানায়, সারা দেশ থেকে আমরা চামড়া ক্রয় করলেও সরকার দাম নির্ধারণ করে থাকেন ট্যানারি মালিকদের নিয়ে। যারা ট্যানারিকে ধ্বংস করছেন তাদের সাথে সরকারের সম্পর্ক। তাহলে এ শিল্প কিভাবে টিকে থাকবে। এ শিল্পের সাথে যাদের সম্পর্ক রয়েছে তাদের সবার সাথে বসেই দাম নির্ধারণ করা দরকার।
সরকারের পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় বলছেন এ বছর কুরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ১৬ লাখ। দেশিয় পশুতেই কুরবানি করা সম্ভব হবে। কিন্তু তার পরেও ভারত থেকে অবৈধ পথে প্রতি দিনই কুরবানিযোগ্য গরু আসছে। এসব গরুর কারণে আমাদের খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে করে তারা সারা বছর পশু পালনে আগ্রহ হারায়। সীমান্ত সরকার কঠোর নজরদারি কথা বললেও গরু আসা কিংবা চামড়া পাচার কোনটাই রোধ করতে পারছেনা।

চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির তথ্য মতে, দেশের উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহত্তম চামড়ার বাজার দিনাজপুরের রামনগর। এ বাজারে শুধুমাত্র কোরবানীর সময়েই দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার ৩৫ থেকে ৪০ হাজার পিস গরু ও ২৫ থেকে ৩০ হাজার পিস ছাগলের চামড়া বেচাকেনা হয়। সারা বছরে এ সংখ্যা যাথাক্রমে ৭০-৭৫ হাজার পিস ও ৪০-৫০ হাজার পিস। জেলার প্রায় ২ শতাধিক ব্যবসায়ী কাঁচা চামড়া ক্রয় করে এ বাজারেই প্রক্রিয়াজাতকরণ করেন নাটোর ও ঢাকার ট্যানারি মালিকদের সরবরাহ করার জন্য।

চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের বলেছেন, দেশের চামড়া ব্যবসার যে দুর্গতি তার প্রধান কারণ আর্ন্তজাতিকভাবে চামড়া বিক্রি না হওয়া। তাছাড়া শুল্ক ও লবণসহ প্রয়োজনীয় রাসায়নিকের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াতেও এই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা নতুন করে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এই পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের জন্য শোচনীয়। ট্যানারি মালিকরা পাওনা টাকা পরিশোধ করলে চামড়ার ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, নয় তো অনেকের মতো বর্তমানে টিকে থাকা ব্যবসায়ীরাও পেশা বদলাতে বাধ্য হবেন।

সমিতির সভাপতি জুলফিকার আলী স্বপনের ভাষ্য, ৩ বছর ধরে পাওনা জমেছে ১৫০ কোটি টাকা। এতে করে অনেকেই চামড়ার ব্যবসা বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এবারে সঠিক হারে চামড়ার মূল্য নির্ধারিত হয়নি দাবি করে তিনি বলেছেন, বিদেশে চমড়া রফতানি করা হয় নগদ অর্থে। অথচ ট্যানারি মালিকরা দিনাজপুরের ব্যবসায়ীদের বকেয়া ১৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করছেন না। ঋণসহ সরকারি সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধে গাফিলাতি করছেন। চামড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে ট্যানারি মালিক ও সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করবেন তারও কোনও সুযোগ নেই বলে জানান জুলফিকার আলী স্বপন।
চামড়া ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম জানান, এবারে ঢাকার বাইরে লবনযুক্ত চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা প্রতি বর্গফুট। এই মুল্যহারে চামড়া দিতে হলে তাদেরকে চামড়া ক্রয় করতে হবে ২৫ থেকে ৩০ টাকা প্রতি বর্গফুট হিসেবে। কিন্তু এই মূল্যহারে চামড়া পাওয়া সম্ভব নয়। বেশি দামে চামড়া কিনলে লোকসানে পড়তে হবে। তাই চামড়ার বাজার দর নিয়ে শঙ্কা বিরাজ করছে তাদের মধ্যে।

দিনাজপুর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতার আজীজ জানান, ৩ বছরের পাওনা টাকা পরিশোধ করছেন না ট্যানারি মালিকরা, এতে ধস নেমেছে চামড়া ব্যবসায়। বিষয়টি নিয়ে ট্যানারি মালিক ও সরকারের কোনও ভ্রƒক্ষেপ নেই। এবারে চামড়ার যে মূল্য বেঁধে দেয়া হয়েছে তা গত বছরের তুলনায় প্রতি বর্গফুটে ২০ টাকা কম। এই মূল্যে চামড়া কেনা কঠিন হয়ে যাবে। যদি চামড়ার মূল্য পুননির্ধারণ করা না হয় তাহলে ব্যবসায়ীরা সমস্যাতেই থাকবেন। চামড়া ব্যবসায়ীরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত উপনীত হয়েছেন দাবি করে তিনি আরও বলেছেন, চামড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এখনই জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

দিনাজপুরের মত প্রতি জেলার চামড়ার আড়ৎদাররা গত তিন বছরের বকেয়া পাচ্ছে না। এতে করে এ শিল্পের ব্যবসায়ীরা পুঁজি সংকটে রয়েছে। এ অবস্থা কাটাতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এ ঈদে তারা ব্যাংক ঋণ না পেলে যদি বড় ধরনের সংকট দেখা দেয়া এর জন্য দায়ী সরকার এবং ট্যানারি মালিকরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে চামড়ার এত দুরাবস্থা কখনও দেখা যায়নি। এবছর গরুর চামড়াই বিক্রি হবে ৫০০-৭০০ টাকা। আর ছাগলের চামড়া কিনার কোন প্রশ্নই উঠে না। কারণ যারা এ চামড়া ক্রয় করবে তারাই বিপাকে পড়বে।

চামড়া প্রক্রিয়াকরণে এখন সক্ষম সাভারের ট্যানারি শিল্প। বিসিকের এমন রিপোর্টে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের ঘোষণা দেয় সরকার। ২০০৩ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০০৬ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত ১৪ বছরের কাজ শেষ হয়নি। পুরো কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগবে কয়েক বছর। অথচ মিথ্যা রিপোর্টের ওপর আদালতের রায়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এর আগে রায় না মানার কারণে আদালত জরিমানাও করে ট্যানারি মালিকদের। এখন দেখা যাচ্ছে কাজ শেষ হয়নি এক তৃতীয়াংশও। এতে করে কোটি কোটি টাকার রফতানি অর্ডার হারালো ট্যানারি মালিকরা। রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে ১২ শতাংশ। বেকার হলো কয়েক লাখ প্রমিক। কিন্তু কার স্বার্থে এ শিল্প ধ্বংস করা হলো তা এখনও অজানা।

সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্প নগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় সেখানে শুরু করা যাচ্ছে না কাজ। এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও মিলছেনা গ্যাসের সংযোগ। তাহলে এখন বিসিকের বিরুদ্ধে কি রায় দেবে? চামড়া শিল্পের এ ক্ষতিপূরণ কিভাবে হবে। এ ক্ষতির দায়ভার কে নেবে? লাখ শ্রমিকের পরিবার কে চালাবে? কি হবে দেশের হাজার হাজার এতিম খানাগুলোর। বাজেটের অভাবে অনেকেই এতিমখানা পরিচালনা করতে পারছে না। কুরবানির বাকি মাত্র ১০ দিন। দেশে
সাভারের ট্যানারি মালিকরা বলছেন, শিল্পনগরীতে বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫৪টির মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ট্যানারি এখন চালু হয়েছে। তবে অধিকাংশ ট্যানারি শুধু চামড়া কাঁচা প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপের ওয়েট ব্লু উৎপাদন কাজ শুরু করতে পেরেছে। কিন্তু প্রক্রিয়ায় মধ্যবর্তী ধাপ- ক্রাশড লেদার ও পণ্য তৈরির উপযোগী ফিনিশড লেদারের তৈরি করার সুবিধা নেই সে সবের বেশিরভাগ ট্যানারিতে। হাতেগোনা কয়েকটি ট্যানারি সম্পূর্ণ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম। এ কারণে কোরবানির পশুর চামড়া কেনার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ থাকবে না অধিকাংশ ট্যানারি মালিকের।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, ক্রাশড ও ফিনিশিংয়ের কাজ করছে গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তদের মধ্যে ৫০ ট্যানারি। এতে মধ্যে মাত্র এসব ট্যানারিতে মাত্র ১০ ট্যানারি ফিনিশড লেদার তৈরি করতে পারবে। তারা প্রায় ৩০ লাখ চামড়া ফিনিশড করতে সক্ষম। বাকিগুলো শুধু প্রাইমারি কাজ করতে পারে। এ হিসেবে বাকি প্রায় ৮৫ লাখ চামড়ারর ভবিষৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত। এতে করে চামড়া ব্যবসায়ী এবং গরিব হকদাররা ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হবেন। যারা গ্যাস সংযোগের অভাবে এসব প্রক্রিয়া চালু করতে পারেনি, তারা চরম প্রতিযোগিতায় পড়বে। অনেকে লোকসানের ভয়ে কোরবানির চামড়ায় আগ্রহ দেখাবে না। এমনটা হতেই পারে। এ ছাড়া অনেক ট্যানারি মালিক অবকাঠামোর কাজের জন্য পুঁজি সংকটে ভুগছে। তারাও চামড়া কিনতে পারবে না।
বকেয়া টাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, কারখানা নিমানে অেেক টাকা ব্যয় করছে। আর এ কারণে টাকা কয়েক বছওে বকেয়া পড়েওছে। এতে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা পরিশোধের চেষ্টা করছি।

এব্যাপারে ঢাকা জেলা চামড়া আড়ৎদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, সরকার যেভাবে চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে তাতে কওে গরীব অসহায় আর এতিমরা বঞ্চিত হবেন। আমরা এখনও গত দুই বছরের বকেয়া পাইনি। প্রায় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা এখনও বাকি রয়েছে। তাহলে আমরা কিভাবে এ বছর চামড়া ক্রয় করবো। এ বছর কোনভাবেই ছাগলের ছামড়া ক্রয় করা যাবে না। কারন ছাগলের চামড়ার দাম ধরা হয়েছে ১৫-১৭ টাকা বর্গফুট। আর লবনযুক্ত করলে এতে ব্যয় হবে ৩৫ টাকা। সরকারি হিসেবে বিক্রি করলে প্রতি বর্গফুটে লোকসান হবে ২০ টাকা। এ বছর ছাগলের চামড়া হবে কুকুরের খাবার

http://www.dailysangram.com/post/342155