১৩ আগস্ট ২০১৮, সোমবার, ১০:১৭

দাম কমায় এতিম-গরীবের প্রাপ্তি কমছে ৪ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা

হাজারিবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থনান্তরে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা এখন আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ বছর প্রতি বর্গফুট চামড়ায় দাম কমেছে ১০ টাকা। এক বছরে এতিম-গরীবের প্রাপ্তি কমছে ১৫৯ কোটি টাকা। আর ৬ বছরে প্রাপ্তি কমছে ৪ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। সংকটে পড়ছে দেশের এতিমখানাগুলো। রফতানি খাত হিসেবে পিছিয়ে পড়ছে দেশে চামড়া শিল্প। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, খাসির চামড়া এখন কুকুরে খাবে।
সূত্র জানায়, এ বছর প্রতি বর্গফুট ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে শহরে ১৫-১৭ টাকা। আর গ্রামে ১২-১৪ টাকা। একটি ছাগলের চামড়ার পরিমাণ মাত্র ৩ বর্গফুট। এ হিসেবে দাম দাঁড়ায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। কিন্তু বাস্তবে তা বিক্রি হয়ে থাকে ২০-২২ টাকায়। কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছাগলের চামড়া প্রতি বর্গফুট সংরক্ষণে ব্যয় হয় ১৩ টাকা। আর সে হিসেবে ৩ ফুটের একটি ছাগলের চামড়া সংরক্ষণে ব্যয় হবে ৩৯ টাকা। তার সাথে রয়েছে পরিবহণ খরচ আরও ৫ টাকা। এতে একটি ছাগলের চামড়ার দাম পড়ে ৯০ টাকা। অথচ লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ১৫-১৭ টাকা। তারা বলছেন, ৯০ টাকার চামড়া কিভাবে ৪০-৪৫ টাকা বিক্রি করা সম্ভব। এতে করে প্রতিটি চামড়ায় ক্ষতি হবে ৪৫ টাকা। অর্থাৎ যদি ছাগলের চামড়া ফ্রিও আনা হয় তাহলেও লোকসান হবে ৫-১০ টাকা। তাহলে কি হবে ৫৫ লাখ ছাগলের চামড়ার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে চামড়ার এত দুরাবস্থা কখনও দেখা যায়নি। এবছর গরুর চামড়াই বিক্রি হবে ৫০০-৭০০ টাকা। আর ছাগলের চামড়া কিনার কোন প্রশ্নই উঠে না। কারণ যারা এ চামড়া ক্রয় করবে তারাই বিপাকে পড়বে।
জানা গেছে, প্রতি বছর কুরবানি ঈদে ৬০ লাখ গরু-মহিষ আর ৫০ থেকে ৫৫ লাখ ছাগল ভেড়া জবাই হয়ে থাকে। কিন্তু এত পরিমাণে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করতে এখনও প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি সাভারের চামড়া শিল্পনগরী। এতে করে প্রতিবেশি দেশে কাঁচা চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা রয়েছে মাত্র ১০ ট্যানারির। আর প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এমন ট্যানারির সংখ্যা প্রায় ৫০ টি। ৮ টি ট্যানারিতে বছরে মাত্র ৩০ লাখ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম। বাকি ৮৫ লাখ চামড়ার কি হবে। চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়বে ব্যবসায়ীরা আর বঞ্চিত হবে হকদাররা।
চামড়া প্রক্রিয়াকরণে এখন সক্ষম সাভারের ট্যানারি শিল্প। বিসিকের এমন রিপোর্টে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প স্থনান্তরের ঘোষণা দেয় সরকার। ২০০৩ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০০৬ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত ১৪ বছরের কাজ শেষ হয়নি। পুরো কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগবে কয়েক বছর। অথচ মিথ্যা রিপোর্টের ওপর আদালতের রায়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এর আগে রায় না মানার কারণে আদালত জরিমানাও করে ট্যানারি মালিকদের। এখন দেখা যাচ্ছে কাজ শেষ হয়নি এক তৃতীয়াংশও। এতে করে কোটি কোটি টাকার রফতানি অর্ডার হারালো ট্যানারি মালিকরা। রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে ১২ শতাংশ। বেকার হলো কয়েক লাখ শ্রমিক। কিন্তু কার স্বার্থে এ শিল্প ধ্বংস করা হলো তা এখনও অজানা।
সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্প নগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় সেখানে শুরু করা যাচ্ছে না কাজ। এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও মিলছেনা গ্যাসের সংযোগ। তাহলে এখন বিসিকের বিরুদ্ধে কি রায় দেবে? চামড়া শিল্পের এ ক্ষতিপূরণ কিভাবে হবে। এ ক্ষতির দায়ভার কে নেবে? লাখ শ্রমিকের পরিবার কে চালাবে? কি হবে দেশের হাজার হাজার এতিম খানাগুলোর। বাজেটের অভাবে অনেকেই এতিমখানা পরিচালনা করতে পারছে না। কুরবানির বাকি মাত্র ১০ দিন। দেশে সারাবছর যে পরিমাণ চামড়ার জোগান আসে, এর ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ আসে কোরবানির ঈদে। এ সময় দেশে প্রায় ৬০ লাখ গরু-মহিষ জবাই হয়। এ ছাড়া ৫০-৫৫ লাখ ছাগল-ভেড়ার চামড়া পাওয়া যায়।
জানা গেছে, এ বছর প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম কমেছে ১০ টাকা। এতে করে। এ বছর ৬০ লাখ গরু-মহিষ জবাই হতে পারে। একটি মধ্যম আয়ের গরুর চামড়ার পরিমান ২৪ বর্গফুট। এতে গরুর চামড়ার পরিমান হয় ৬ কোটি বর্গফুট। ১০ টাকা হার ক্ষতি(দাম কমেছে) ১৪৪ কোটি টাকা। আর একটি ছাগলের চামড়া হয়ে থাকে ৩ ফুট। এতে করে ক্ষতি হয় ১৫ কোটি টাকা। এতে বছরে গরীবের বাজেট কমেছে ১৫৯ কোটি টাকা।
২০১৩ সালে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ছিল ৮৫-৯০ টাকা। ২০১৪ সালে তা কমিয়ে করা হয়েছে ৭০-৭৫ টাকা। আর ২০১৫ সালে তা আর কমিয়ে করা হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা। একইভাবে ২০১৬ সালে আরও দশ টাকা কমিয়ে করা হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা। আর ২০১৭ সালে তা আর কমিয়ে করা হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা। আর এ বছর করা হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা। এ হিসেবে গত ছয় বছরে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম কমেছে ৪০ টাকা। এ সময়ে দেশের গরীব এবং এতিমরা বঞ্চিত হয়েছে ৪ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, সারা দেশের চামড়ার আড়ৎদাররা এখনও ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া রয়েছে প্রায় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা। গত দুই বছর ধওে ট্যানারি স্থনান্তরের অজুহাতে তারা কোন বকেয়া পরিশোধ করছে না। সামান্য বকেয়া পরিশোধ করলেও বাকি নেয় তার দ্বিগুণ। এতে করে প্রতি বছরই বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে। এতে করে এখাতে সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।
ট্যানারি মালিকরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ব্যয় করছে কারখানা নির্মাণের কাজে। এতে করে তারা আগের বকেয়া পরিশোধও করতে পারছে না। নতুন করে চামড়া ক্রয়ও করতে পারছে না। চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়ছে সংশ্লিষ্টরা।
শরীয়া মতে চামড়া বিক্রয়লব্ধ এ টাকার হকদার হলো যারা যাকাতের হকদার। অথাৎ এতিম মিসকিন,গরীব ও অসহায় দুস্থরা। এশিল্পে যত সংকট বাড়ছে তত বেশি বঞ্চিত হচ্ছে এ হকদাররা। অথাৎ এ বছর তারা বঞ্চিত হবেন প্রায় ১৫৯ কোটি টাকা।
সাভারের ট্যানারি মালিকরা বলছেন, শিল্পনগরীতে বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫৪টির মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ট্যানারি এখন চালু হয়েছে। তবে অধিকাংশ ট্যানারি শুধু চামড়া কাঁচা প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপের ওয়েট ব্লু উৎপাদন কাজ শুরু করতে পেরেছে। কিন্তু প্রক্রিয়ায় মধ্যবর্তী ধাপ- ক্রাশড লেদার ও পণ্য তৈরির উপযোগী ফিনিশড লেদারের তৈরি করার সুবিধা নেই সে সবের বেশিরভাগ ট্যানারিতে। হাতেগোনা কয়েকটি ট্যানারি সম্পূর্ণ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম। এ কারণে কোরবানির পশুর চামড়া কেনার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহ থাকবে না অধিকাংশ ট্যানারি মালিকের।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, ক্রাশড ও ফিনিশিংয়ের কাজ করছে গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তদের মধ্যে ৫০ ট্যানারি। এতে মধ্যে মাত্র এসব ট্যানারিতে মাত্র ১০ ট্যানারি ফিনিশড লেদার তৈরি করতে পারবে। তারা প্রায় ৩০ লাখ চামড়া ফিনিশড করতে সক্ষম। বাকিগুলো শুধু প্রাইমারি কাজ করতে পারে। এ হিসেবে বাকি প্রায় ৮৫ লাখ চামড়ারর ভবিষৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত। এতে করে চামড়া ব্যবসায়ী এবং গরিব হকদাররা ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হবেন। যারা গ্যাস সংযোগের অভাবে এসব প্রক্রিয়া চালু করতে পারেনি, তারা চরম প্রতিযোগিতায় পড়বে। অনেকে লোকসানের ভয়ে কোরবানির চামড়ায় আগ্রহ দেখাবে না। এমনটা হতেই পারে। এ ছাড়া অনেক ট্যানারি মালিক অবকাঠামোর কাজের জন্য পূঁজি সংকটে ভুগছে। তারাও চামড়া কিনতে পারবে না।
এদিকে যারা প্রক্রিয়াকরণ শুরু করেছে, তাদের মধ্যে বেশিভাগ ট্যানারি শুধু কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণের ওয়েট ব্লু করছে। কিন্তু ক্রাশড লেদার তৈরি করার সুবিধা নেই। সেক্ষেত্রে ওইসব ট্যানারি পরবর্তীতে অন্য ট্যানারি থেকে ক্রাশড করাচ্ছে। আবার পণ্য তৈরির উপযোগী ফিনিশড লেদারের কাজ হচ্ছে আরেক জায়গায়।
এ ধরনের বিক্ষিপ্ত অবস্থা আসন্ন কোরবানির ঈদে সংগৃহীতব্য চামড়ার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে’ বলে জানিয়ে ইউসুফ ট্যানারির মালিক ইউসুফ আলী বলেন, সবাই এখন স্বাভাবিক পরিমাণের কাজ তুলতেই চাপের মধ্যে পড়ছে। তখন তো অনেক বেশি চামড়া আসবে। এ অল্পসংখ্যক রেডি ট্যানারিতে এতো চামড়া কীভাবে প্রক্রিয়াকরণ হবে? এ কারণে এবার ব্যবসায়ীরা কোরবানির চামড়ার প্রতি আগ্রহ হারাবে। এতে চামড়ার দাম এবারও কম হবে।
এব্যাপারে ঢাকা জেলা চামড়া আড়ৎদার সমিতির সাধারন সম্পাদক রবিউল আলম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, সরকার যেভাবে চামড়ার দাম নির্ধারন করেছে তাতে কওে গরীব অসহায় আর এতিমরা বঞ্চিত হবেন। আমরা এখনও গত দুই বছরের বকেয়া পাইনি। প্রায় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা এখনও বাকি রয়েছে। তাহলে আমরা কিভাবে এ বছর চামড়া ক্রয় করবো। এ বছর কোনভাবেই ছাগলের ছামড়া ক্রয় করা যাবে না। কারন ছাগলের চামড়ার দাম ধরা হয়েছে ১৫-১৭ টাকা বর্গফুট। আর লবনযুক্ত করলে এতে ব্যয় হবে ৩৫ টাকা। সরকারি হিসেবে বিক্রি করলে প্রতি বর্গফুটে লোকসান হবে ২০ টাকা। এ বছর ছাগলের চামড়া হবে কুকুরের খাবার।
এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, এখনও সংকটে রয়েছে আমাদের ট্যানারি শিল্প। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে। তা ছাড়াও আর্ন্তজাতিক বাজারেও চামড়ার দাম কমেছে। আর এ কারনেই চামড়া মূল্য দশ টাকা কমানো হলো।
প্রতি বছর কুরবানি এলেই সীমান্ত দিয়ে ভারতে কাঁচা চামড়া পাচার হয়ে থাকে। চামড়া পাচার ঠেকাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও পাচার বন্ধ হয় না। এ বছর পাচার হওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়েছে কয়েকগুন। কারণ সাভারে এখনও পর্যন্ত মাত্র ১০টি ট্যানারি চালু হয়েছে। বাকি ট্যানারি মালিকরা বেশি চামড়া কিনতে চাইবে না। ফলে বাধ্য হয়ে কাঁচা চামড়া ভারতে পাচার করবে সীমান্তবর্তী ব্যবসায়ীরা। এতে করে চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার হারাবে বাংলাদেশ।

 

http://www.dailysangram.com/post/341678-