৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৫০

এসএসসির প্রশ্নপত্রে হেয় করায় সর্বস্তরের চিকিৎসকেরা ক্ষুব্ধ

মাধ্যমিক পরীক্ষার (এসএসসি) বাংলা প্রথম পত্র, আবশ্যিক, সৃজনশীল ক-সেট প্রশ্নপত্রে চিকিৎসকদের হেয়প্রতিপন্ন করায় চটেছেন দেশের সর্বস্তরের চিকিৎসকেরা। চিকিৎসার মতো মহান পেশায় যুক্তদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে হেয় করায় নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া চিকিৎসকদের প্রধান সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামও (এনডিএফ) বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে। এ ছাড়া দেশের একমাত্র মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বিএসএমএমইউ, বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎকেরা পৃথকভাবে বিভিন্ন ব্যানার ফ্যাস্টুন প্লেকার্ড সহকারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। ব্যক্তিগতভাবেও চিকিৎসকেরা বিবৃতি দিয়ে এ ধরনের কাজের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে চিকিৎসকদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এসএসসির মতো জাতীয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ডাক্তারকে আনা হয়েছে। তারা বলেন, একটি মহল সব সময় চিকিৎসকদের পেছনে লেগে আছে। তারা প্রমাণ করতে চাচ্ছে বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা ভালো চিকিৎসা করতে পারেন না। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হবে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ওই মহলটির সাথে এসএসসির প্রশ্ন যে বা যারা তৈরি করেছেন তাদের উদ্দেশ্য মিলে যায়। সরকারের উচিত শক্তিশালী তদন্ত কমিটি করে প্রশ্নকর্তার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জানা এবং তাকে বা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
যা লেখা হয়েছে প্রশ্নপত্রে : ‘জাহেদ সাহেব একজন লোভী ডাক্তার। অভাব ও দারিদ্র (এ শব্দটা হবে দারিদ্র্য। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এভাবেই ভুল শেখানো হচ্ছে) বিমোচন করতে গিয়ে তিনি সব সময় অর্থের পেছনে ছুটতেন। এক সময় গাড়ি-বাড়ি, ধন-সম্পদ সব কিছুর মালিক হন। তবুও তার চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। অর্থ উপার্জনই তার একমাত্র নেশা। অন্য দিকে তাঁর বন্ধু সগীর সাহেব তাঁর ধন-সম্পদ থেকে বিভিন্ন সামাজিক জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করেন। তিনি মনে করেন, সুন্দরভাবে জীবনযাপনের জন্য বেশি সম্পদের প্রয়োজন নেই।’ এমনভাবে প্রশ্নে চিকিৎসককে চিত্রিত করা হয়েছে যেন একমাত্র চিকিৎসা পেশার মানুষই অর্থলোভী, তাদের দ্বারা কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ হয় না।
বাংলা সৃজনশীলের এ প্রশ্নপত্রে শুধু চিকিৎসকদেরই হেয় করা হয়েছে এমন নয়। এখানে সংবিধানও লঙ্ঘন করা হয়েছে। গদ্যাংশের প্রথম প্রশ্নটিতে ‘আদিবাসী’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে ‘আদিবাসীরা’ সামুদ্রিক বিভিন্ন জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ‘আদিবাসী’ বলে কোনো শব্দ নেই। যে জাতিগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ বোঝানো হয়েছে, সংবিধানে তাদের ‘ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
প্রশ্নপত্রে চিকিৎসকদের চিত্রিত করার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা: মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও মাহসচিব ডা: মো: ইহতেশামুল হক চৌধুরী।
বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড প্রণীত বাংলা প্রশ্নপত্রের ২ নং প্রশ্নের ‘জাহেদ সাহেব একজন লোভী ডাক্তার’ অংশটি বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। দেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে চিকিৎসা পেশার মতো মহান ও মহৎ একটি পেশা সম্পর্কে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা প্রদান করা হয়। নেতৃদ্বয় বলেন, দেশের সব থেকে মহৎ পেশায় নিয়োজিত চিকিৎসক সমাজকে হেয়প্রতিপন্ন করায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এর তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বাধিক আত্মদানকারী চিকিৎসকসমাজ সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য জাতির জন্য লজ্জাজনক। চিকিৎসকেরা নিরন্তর চেষ্টা করে তাদের সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম দিয়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এই প্রশ্নপত্র প্রণয়নে জড়িতদের আগামী তিন দিনের মধ্যে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান এবং এ দেশের চিকিৎসক সমাজের কাছে প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনা করানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছে। অন্যথায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন চিকিৎসক ও চিকিৎসা পেশার মান-মর্যাদা রক্ষায় যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।
ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সভাপতি ডা: এ কে এম আজিজুল হক এবং মহাসচিব ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের ১৬ কোটি দরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে নিয়োজিত চিকিৎকদের হেয়প্রতিপন্ন করে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে দুর্বল ও ধ্বংস করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু অসৎ ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বাস্থ্যসেবাকে হেয়প্রতিপন্ন ও বিতর্কিত করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে আজ কমলমতি শিশুদের শেখানো হচ্ছেÑ ছাগল আম গাছে উঠে আম পাড়ছে। এরকম উদ্ভট শিক্ষা আজ আমাদের শিশুরা গ্রহণ করছে। তারই প্রতিফলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম পাস নম্বর অর্জনেও ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা চিকিৎসকসমাজ কোনো অবস্থাতেই স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ধ্বংস করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে দিতে পারি না। সীমিত চিকিৎসক ও সম্পদ দিয়ে গোটা দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এরূপ কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। পাশাপাশি পেশার স্বার্থ সংরক্ষণে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা পেশার মতো একটি মহান ও সেবামূলক পেশাকে কলঙ্কিত করে স্বার্থ হাসিলের যে অপচেষ্টা চালানো হয়েছে তাদের অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ভবিষ্যতে এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে এর জোর দাবি জানাচ্ছি।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. এম এ আজিজ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের চিকিৎসক সম্পর্কে মিথ্যা, উদ্দেশ্যমূলক শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এ কথা শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করবে।
ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) সভাপতি ডা. নজরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. এ কে এম ওয়ালী উল্লাহ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে চিকিৎসকদের বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে এর নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন। নেতৃদ্বয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এ ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
বিশিষ্ট মেডিক্যাল শিক্ষাবিদ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেছেন, সকল পেশাজীবীদের মধ্যেই ভালো ও মন্দ আছে। কিন্তু একটিমাত্র পেশাজীবীদের হেয় করাটা উদ্দেশ্যমূলক ও নিন্দাজনক। প্রশ্নপত্রে যা লেখা হয়েছে, এসব কথাই অন্যভাবে বলা যেত কোনো পেশার নাম না বলে। এটা প্রশ্ন প্রণয়নকারীদের জ্ঞানের অগভীরতা ও অজ্ঞতাই প্রকাশ পেয়েছে।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/193259