সিটিং সার্ভিসের বাসেও বাদুড়ঝোলা। ছবি : কালের কণ্ঠ
১২ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১২:৪২

সিটিং বাসের নামে বিশৃঙ্খলা নৈরাজ্য

রাজধানীর কালশী মোড়। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা। রোদ মাথায় নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো বহু যাত্রী। বাস দাঁড়াচ্ছে না, যাত্রীরা উঠতেও পারছে না। ‘আকিক’ ও ‘প্রজাপতি’ পরিবহনের কয়েকটি বাস দরজা বন্ধ করা অবস্থায় না থেমেই চলে গেল। কারণ তারা ‘সিটিং’! বিআরটিসির দুটি বাসও থামল না। নতুনবাজারে যাওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাজীব আহমদকে অপেক্ষা করতেই হলো। পরে ‘নূর এ মক্কা’ পরিবহনের একটি বাসে তিনি ভিড় ঠেলে উঠতে পারলেন। গাবতলী থেকে মিরপুর হয়ে চলা ওই বাসে সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া আসে ১০ টাকা। রাজীবকে দিতে হলো ২৫ টাকা। রাজীব কালের কণ্ঠকে জানান, ২০১৭ সালের এপ্রিলে সিটিং সার্ভিস বন্ধ রাখা হলে তিন দিন ১০ টাকা ভাড়াই রাখা হয়েছিল। এবার কোনো কোনো বাস ‘সিটিং’ সেবা বন্ধ করে আগের বেশি ভাড়াই নিচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া বন্ধে কোথাও বিআরটিএ বা পুলিশ কর্মকর্তাদের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
সকাল সাড়ে ৯টা। কালশীর অদূরে ইসিবি চত্বর। সেখানেও ভিড়। অপেক্ষারতদের একজন আজিজুল ইসলাম ৩৫ মিনিট অপেক্ষা করে শেষে আকিক পরিবহনের একটি বাসের পাদানিতে পা রাখতে পারেন। তবে আজিজুল ইসলামও অতিরিক্ত ভাড়ার শিকার হন।

গতকাল মিরপুর-১০ নম্বর, পল্লবী, কালশী, ইসিবি চত্বর থেকে বিমানবন্দর সড়কে উঠে কুর্মিটোলা, শাওড়া, কুড়িল, খিলক্ষেত, জসীমউদ্দীন মোড়, কাওলা, আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেল, পথের ধারে ধারে অপেক্ষা করছে যাত্রীরা। ‘সিটিং’ বা ‘গেট লক’ বাস ছিল ২০ শতাংশের কম। তার ওপর এগুলোর দরজা ছিল বন্ধ। সকালের দিকে যাত্রী না তুললেও দুপুর দেড়টায় দেখা গেল, আব্দুল্লাহপুর, কাওলা, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন বাস স্টপেজে শুধু নয়, যেখানে যাত্রী মিলছে সেখানেই সিটিং বাস দাঁড়াচ্ছে।

বিকেলে মিরপুর-১০ নম্বরে বেস্ট ট্রান্সপোর্টের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব-১১৪১৬৩) ডেকে ডেকে যাত্রী তোলা হচ্ছিল। মিরপুর গোলচত্বর থেকে যাত্রী তোলার পরও আগারগাঁও পর্যন্ত ১১টি স্থানে বাসটি থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। তখনো বাসের জন্য যাত্রীরা অপেক্ষা করছিল। বাসটি মিরপুর-যাত্রাবাড়ী পথে চলাচল করে। বিহঙ্গ পরিবহনের বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৯১৩৫) বিভিন্ন স্থানে যাত্রী তোলার জন্য থামিয়ে রাখা হচ্ছিল। বাসটির চলাচল অনুসরণ করতে গিয়ে দেখা গেল, বাসটি এমনভাবে পথে রাখা হচ্ছিল যে তার পেছনের গাড়িগুলোকেও আটকে পড়তে হচ্ছিল। মিরপুর থেকে সদরঘাট পথে চলাচলকারী এই বাসের কর্মী বাবুল বললেন, ‘যাত্রী উডাইতে তো হইব, নাকি বাস বন্ধ কইরা দিমু?’
সদরঘাট থেকে ছেড়ে মালিবাগ, বনশ্রী, প্রগতি সরণি হয়ে চলছিল সুপ্রভাত পরিবহনের বাস। বাসচালক মঞ্জুরুল ইসলাম খুব ধীরে চালাচ্ছিলেন বাস। কারণ পথে গণপরিবহন নেই। বিকেলে নদ্দায় তিনি বাস থামিয়ে যাত্রী তুলছিলেন। সামনেই ছিল দুজন ট্র্যাফিক পুলিশ। অন্য গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করলেও চালক মঞ্জুরুল যাত্রী তুলছিলেন পথ থেক। কেন স্টপেজে থামান না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পথে বাস নেই , যাত্রীরাই অপেক্ষা করছে। তাই তুলছি।’ তিনি জানান, বিকেল পর্যন্ত পাঁচবার চলাচল করেছেন।

বসুন্ধরা গেটের বিপরীতে প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা গেল, জাবালে নূর পরিবহনের কোনো বাস নেই। দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মো. রাফি বললেন, ‘দুপুর আড়াইটা থেকে এ পরিবহন কম্পানির কোনো বাস চোখে পড়েনি। আমরাও এ কম্পানির বাস খুঁজছি। এ কম্পানির সব বাসের রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে।’ তিনি জানান, আড়াই ঘণ্টায় তিনি বিভিন্ন অপরাধে চালকের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা করেছেন। আরো একজন সার্জেন্ট সেখানে মামলা করছিলেন ছোট্ট যন্ত্রের সাহায্যে। সার্জেন্ট রাফি বলেন, রাস্তায় বাস অর্ধেকও নেই। কাগজপত্র নেই বলে এসব বাস রাস্তায় বের করা হচ্ছে না।

তেঁতুলিয়া পরিবহনের বাস চলে মিরপুর হয়ে আব্দুল্লাহপুর রুটে। গতকাল এ পরিবহনের বাসেও যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়া হয়। জানতে চাইলে এই পরিবহন কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ মাসুম গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বিআরটিএর তালিকা দেখেই ভাড়া নির্ধারণ করেছি। বেশি ভাড়া নিই না।’
গতকাল জাবালে নূর পরিবহনের ছয়টি বাস জব্দ করেছে র্যা ব। রাস্তায় এ পরিবহনের কোনো বাস দেখা যায়নি গতকাল। এই বাস কম্পানির বেশির ভাগ দায়িত্বশীলের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। নূর এ মক্কা পরিবহনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিটিং সার্ভিস বন্ধ করার জন্য গত বছর এপ্রিলে মালিকদের একটি সংগঠন সিদ্ধান্ত নিলে আমরা বাস বন্ধ রেখেছিলাম। সরকার কমিটি করে বলেছিল, সিটিং সার্ভিস থাকবে কি না জানাবে—১৫ মাসেও জানায়নি। বিআরটিসি, বিআরটিএ, পুলিশ কর্মকর্তারাও আমাদের নিয়মের আওতায় আনতে চায় না। কারণ তাদের উপরি পাওনা বন্ধ থাকবে।’

মিরপুর থেকে মতিঝিল রুটে নিউ ভিশন পরিবহনের বাস চলাচল করে। গত শুক্রবার রাতে এ পরিবহনের একটি বাস সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কাছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িকেও ধাক্কা দেয়। বাসটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী। এ কম্পানির বাসে মতিঝিল থেকে মিরপুর পর্যন্ত ভাড়া ২৫ টাকা নেওয়া হয়। বাসের ভেতরে ভাড়ার তালিকায় শাহবাগ থেকে শ্যামলী পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা লেখা রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে মো. বদিউজ্জামানকে দিতে হয়েছে ২৫ টাকা। ১০ টাকার ভাড়া ২৫ টাকা কেন প্রশ্নে যাত্রীদের বলা হয়, ‘এটাই নিয়ম’।
কয়েক দিন ধরে ট্রাফিক পুলিশের বিশেষ অভিযান চলায় বিহঙ্গ, শিকড়, শিখর, ছালছাবিল, তুরাগ পরিবহনসহ ১৩০টি কম্পানির বাস অপেক্ষাকৃত কম বের হচ্ছে। গতকাল মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে উত্তরা পরিবহনের একজন চালক জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর থেকে রাস্তায় তাঁদের অর্ধেক গাড়ি চলছে না। এগুলোর বৈধ কাগজপত্র নেই।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/08/12/668690