১২ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১২:২০

পানির দরে চামড়া কিনে উচ্চমূল্যে রফতানি

ট্যানারি মালিকরা পানির দরে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে উচ্চদরে রফতানি করছেন। এতে ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়ছে, কিন্তু মাঠপর্যায়ে চামড়ার দাম কম থাকছে। এদিকে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে চামড়ার দাম বেশি থাকছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে চামড়া ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কাঁচা চামড়ার দাম কম রেখে এদিকে রফতানিকারকরা বাড়তি মুনাফা করছেন, অন্যদিকে দেশ থেকে চামড়া পাওয়ার হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন তারা। ব্যবসায়ীরা একটি সিন্ডিকেট করে এ মুনাফার রোডম্যান বাস্তবায়ন করছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা থেকে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা করে কিনের ট্যানারি মালিকরা। এটি প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে রফতানি উপযোগী করতে ৪৮ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়। এতে খরচ পড়ে আরও ২৬ টাকা ৪০ পয়সা। ফলে চামড়ার প্রক্রিয়াজাত খরচসহ দ্বিতীয় স্তরে বিক্রি দাম নির্ধারিত হয় ৮১ টাকা ৪০ পয়সা। যা উৎপাদক মূল্য হিসাবে বিবেচিত। পরে তৃতীয় স্তরে রফতানির ক্ষেত্রে জাহাজীকরণ ব্যয়সহ অন্যান্য খাতে আরও ২০ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ হয়। এতে প্রতি বর্গফুট চামড়ায় প্রক্রিয়াজাত মূল্যের সঙ্গে আরও ১৬ টাকা ২৮ পয়সা খরচ যোগ হয়। সব মিলে প্রতি বর্গফুট চামড়া রফতানিতে খরচ পড়ে ৯৭ টাকা ৬৮ পয়সা। কাঁচা চামড়া থেকে রফতানি পর্যন্ত মোট ৬৮ শতাংশ মূল্য সংযোজন হচ্ছে। কিন্তু প্রতি বর্গফুট চামড়া রফতানি হচ্ছে ১৮৯ টাকা করে। ফলে প্রতি বর্গফট চামড়ায় একজন রফতানিকারক ৯১ টাকা ৩২ পয়সা মুনাফা করছেন।
বাস্তবে রফতানিকারকরা আরও কম দামে চামড়া কেনেন। গত বছর ঢাকায় কোরবানির কাঁচা চামড়া বিক্রি হয় ৫০-৫৫ টাকায়। এর মধ্যে গরু ঢাকায় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা বর্গফুট। খাসি ২০ থেকে ২২ টাকা, বকরি ১৫ থেকে ১৭ টাকা বর্গফুট। যেহেতু কাঁচা চামড়া তারা আরও কম দামে কেনেন সেই কারণে তাদের মুনাফা আরও বেশি হয়।

কোরবানির মৌসুমে মাঠপর্যায়ে জবাই হওয়া প্রতিটি গরু ও মহিষ থেকে গড়ে ২২ বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। ফলে সর্বোচ্চ দরে হলেও একটি গরুর চামড়া বিক্রি হয় ১ হাজার ২১০ টাকায়। কেনার পর ওই চামড়াটি বিভিন্ন হাতে গিয়ে প্রক্রিয়াজাত হয়ে এটি রফতানি হয় ৩ হাজার ৯৬০ টাকায়।
চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়ার বিল বা চামড়া রফতানি সংক্রান্ত ব্যাংকের এলসি রেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে মাসওয়ারি এলসি রেটে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি গরু ও মহিষের চামড়ার গড় রফতানি মূল্য পাওয়া গেছে ২.২৫ মার্কিন ডলার বা ১৮৯ টাকা (প্রতি ডলারে ৮৪ টাকা হিসাবে)।

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রাস্ট ও ফিনিশড- দু’ধরনের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হচ্ছে। গত বছর অক্টোবর থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত গত ৯ মাসে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ সময়ে প্রতি বর্গফুট ক্রাস্ট চামড়ার দাম দেড় থেকে আড়াই ডলার ও ফিনিশড চামড়ার দাম মানভেদে পৌনে ৩ থেকে ৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। তবে মহিষের ফিনিশড চামড়ার গড় দাম পৌনে ২ ডলারের বেশি উঠেনি।
গত বছর আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের কারণে অনেক ট্যানারির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আগের মূল্য প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা বহাল রাখা হয়। তখন সরকারের দায়িত্বশীল মাধ্যম থেকে বলা হয়, সরকার চায় এ শিল্পটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার স্বার্থে ঘুরে দাঁড়াক। দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করুক ও বিদেশে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করুক। অন্যদিকে খাতটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ওই বছর চামড়া খাতকে প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার বা বর্ষপণ্য ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে চামড়া শিল্প থেকে ৫০০ কোটি ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এসব লক্ষ্য অর্জনে ট্যানারি শিল্পকে কমপ্লায়েন্ট হওয়ার পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা বাড়াতেই চামড়ার মূল্য গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিু স্তরে রাখা হয়। এভাবেই কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয়-বিক্রয়ে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুটছে চামড়া ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানিয়েছে, গত বছর সংগৃহীত চামড়ার সবটা এখনও রফতানি করা সম্ভব হয়নি। তাদের গুদামে এখনও ৪০ শতাংশ চামড়া মজুদ পড়ে আছে। রফতানি করতে না পারায় এসব চামড়ার মানও দিন দিন নেমে যাচ্ছে। এতে তাদের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে চলতি বছর কোরবানির চামড়ার দাম আরও নামিয়ে আনা হয়েছে। এবার তারা গরুতে বর্গফুট প্রতি দাম গতবারের তুলনায় ৫ টাকা খাসি ও বকরিতে ২ টাকা কম নির্ধারণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন জানান, চামড়ার দাম নির্ধারণ করা ত্রিপক্ষীয়ভিত্তিতে। কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ী, ট্যানারি মালিক ও রফতানিকারক। মূলত আন্তর্জাতিক বাজার ও দেশে প্রক্রিয়াজাত করার খরচ বিবেচনা করে এ দর নির্ধারিত হয়।
এদিকে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, চামড়ার দাম এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যাতে প্রক্রিয়াজাত করার খরচ মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সামান্য লাখ রেখে রফতানি করা যায়। তিনি বলেন, চামড়া রফতানির ক্ষেত্রে খুব বেশি মুনাফা করা সম্ভব হয় না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/79611