১২ আগস্ট ২০১৮, রবিবার, ১২:১৭

ইসির টানাপোড়েন প্রকাশ্যে

নির্বাচন কমিশন দুর্বল হয়ে পড়বে, সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হবে * সিইসি ও কমিশনারদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে * সংলাপে উঠে আসা সুপারিশ বাস্তবায়নে আগ্রহ নেই ইসির

নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে টানাপোড়েন ক্রমশ প্রকাশ্যে চলে আসছে। বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং অন্য কমিশনাররা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের (ইসির) ঘরোয়া বৈঠক বা প্রকাশ্য সভাতেই এ ধরনের বক্তব্য উঠে আসছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন এক বা একাধিক কমিশনার। আবার কমিশনারের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করছে সিইসি। নির্বাচনসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়াসহ নানা বিষয়ে নিজেদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে মতবিরোধ। সবাই একমত হয়ে অংশীজনদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করছেন না।

এ বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। এ নিয়ে সরকারের দুই মন্ত্রী বলেছেন সিইসির এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। অন্য দিকে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোকজন ইসির বিরোধ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। তাদের মতে, নির্বাচন কমিশনারদের মতবিরোধ আগামী জাতীয় নির্বাচনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার কিছু দিন পর থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। নির্বাচন কমিশনের ৩৩ জন কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি নিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ওই ঘটনায় প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে মাহবুব তালুকদারকে লক্ষ্য করে সিইসি বলেছিলেন, এটা তালুকদার সাহেবের প্রোডাক্ট।
সিইসির ওই বক্তব্যে সংবাদ সম্মেলনে হাসির রোল পড়ে। নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে মাহবুব তালুকদারের একটি বক্তব্যে ভিন্ন মত প্রকাশ করে সিইসি বলেছিলেন, এটা মাহবুব তালুকদারের ব্যক্তিগত মতামত, নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য নয়। এ ছাড়া সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এমপিদের প্রচারের সুযোগ দিয়ে আচরণবিধি সংশোধন নিয়েও কমিশনের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ওই বিষয়টিও প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেন সিইসি।
সম্প্রতি বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে মত দেন একজন নির্বাচন কমিশনার। তখনও মতবিরোধ দেখা দিলে ১৫টি ভোটকেন্দ্রের ফল প্রকাশ স্থগিত রেখে তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। গত সপ্তাহে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচনে অনিয়ম হবে না এমন গ্যারান্টি তিনি দিতে পারবেন না।
এর বিরোধিতা করেছেন অন্য কমিশনাররা। তারা বলেছেন, এটি সিইসির ব্যক্তিগত মত। নির্বাচন কমিশনের প্রধান বা অন্য সদস্যরা কমিশনের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এভাবে প্রকাশ্যে ব্যক্তিগত মন্তব্য করতে পারেন কিনা তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সাংবিধানিক পদে থেকে তারা কাজটি করতে পারেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান যুগান্তরকে বলেন, কমিশনারদের নিজেদের মধ্যে যদি মতবিরোধ বা মতপার্থক্য থাকে তবে তারা সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না। এতে কমিশন আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। জাতীয় নির্বাচনের মতো কঠিন সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তারা আরও সংকটে পড়বে।
নির্বাচন নিয়ে আমাদের প্রত্যাশাও পূরণ হবে না। তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে যে শপথ তিনি (সিইসি) নিয়েছিলেন তা রক্ষা করতে পারছেন না। তার এ বক্তব্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা- তা নিয়ে রাজনৈতিক দল ও অন্যদের মনে শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ করতে আমরা নির্বাচন কমিশনের সংলাপে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিলাম। ওইসব সুপারিশ আদৌ আমলে নিয়েছেন কিনা বা সুপারিশ বাতিল করেছেন কিনা- কিছুই আমাদের জানানো হয়নি। এতে ধরে নেয়া যায়, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে তাদের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, সিইসি এবং কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ নির্বাচনের প্রধান স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে। নির্বাচনে যারা অনিয়ম করতে চায়, তারা অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কাজে লাগাতে পারে। এ ক্ষেত্রে সিইসি বা অন্য কমিশনারদের বক্তব্য তাদের উৎসাহিত করবে। কাজেই বক্তব্য দেয়ার সময় সিইসি ও কমিশনারদের এ বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত। তারা বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা।
পাঁচজনে মিলে এই কমিশন। পাঁচ বছর পরপর জাতীয় নির্বাচন হয়, এতে ভোট দিয়ে মানুষ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। কমিশন ঐক্যবদ্ধ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন করার নজিরও যেমন আছে, তেমনি অতীতে এর বিপরীত দৃশ্যও দেখা গেছে। সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু ভোটের প্রক্রিয়ায় কোনো রকম অনিয়ম হলে নির্বাচন হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
এদিকে সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখা উচিত বলে তারা মনে করেন। তারা অনেকটা অভিযোগের সুরে বলেন, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান নয়। অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে অংশীজনেরা যেসব সুপারিশ করেছিলেন সেগুলো বাস্তবায়নেও কমিশনের তেমন আগ্রহ নেই। নিজেরাও উদ্যোগী হয়ে দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন এমনটি দেখা যায়নি।

সব মিলে তারা অনেটাই হতাশ। প্রসঙ্গত, আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা শুরু হচ্ছে। ২৭ জানুয়ারির মধ্যে এ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম দিকে ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের।
গত মঙ্গলবার এক কর্মশালা শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, নির্বাচনে অনিয়ম হবে না এমন গ্যারান্টি তিনি দিতে পারবেন না। সিইসির ওই বক্তব্যকে ব্যক্তিগত বলে আখ্যায়িত করে বাকি চার কমিশনার সিইসির সঙ্গে একমত নন বলেও গণমাধ্যমের খবরে এসেছে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শপথ নিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেছেন কোনো কোনো নির্বাচন কমিশনার। পরে একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সিইসি তার বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনে ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্র, প্রায় তিন লাখ ভোটকক্ষ- এত বড় নির্বাচনে কোথাও অনিয়ম হবে না- এমন বললেও মিথ্যা বলা হবে। আমি বাস্তবতার কথা বলছি, অনিয়ম হবে না- এমন নিশ্চয়তা আমি তো দিতে পারি না।

এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন সিইসির বক্তব্য কমিশনে বিভাজন সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, সিইসি যে বক্তব্য দিলেন এবং পরে অন্য কমিশনাররা যা বললেন তাতে নিজেদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে; সিইসির এমন মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। তার এ মন্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অংশীজনদের সঙ্গে ইসির সংলাপে উঠে আসা তিন ক্যাটাগরির অর্ধশত সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়নি ইসি। ওই সংলাপে ইসির এখতিয়ারভুক্ত ৩৪টি সুপারিশ উঠে আসে। পাশাপাশি সংসদ নির্বাচন আইন-গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-এর অন্তত ৩৫টি সংশোধনী আনার প্রক্রিয়া শুরু করলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়ম ঠেকাতে পারেনি বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দল অংশগ্রহণ করেনি। তাই আমরা আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ইসিকে কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু ওইসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেছেন এমন কোনো কিছু দেখিনি। উল্টো সুষ্ঠু নির্বাচনে সিইসি গ্যারান্টি দিতে পারবেন না- এমন বক্তব্যে আমি শঙ্কিত, চিন্তিত। কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা।
বর্তমান ইসির কার্যক্রম ও অতি কথন আগামী নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান। তিনি বলেন, নির্বাচনে অনিয়ম হবে না এমন গ্যারান্টি দেয়া যাবে না- সিইসির এ বক্তব্যে যে কোনো রাজনৈতিক দল হোক সরকারি বা বিরোধী দল তারা সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বেন।

যিনি নির্বাচন পরিচালনা করবেন, যে নির্বাচন নিয়ে সামনে অনেক প্রশ্ন, সেই নির্বাচনের কয়েক মাস আগে যখন সিইসি বলেন, নির্বাচনের অনিয়ম বন্ধের গ্যারান্টি দিতে পারবেন না- তা সব দলের মধ্যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে নতুন শঙ্কা সৃষ্টি করবেই। তার এ বক্তব্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সরকারি বা বিরোধী রাজনৈতিক দল তাদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা থাকবে। সিইসির পদে থেকে তার এটা বলা ঠিক হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, কী কারণে কোন প্রেক্ষিতে সিইসি এ মন্তব্য করেছেন তা গভীরভাবে অনুসন্ধানের দাবি রাখে। তার এ বক্তব্য বাজারে গুজব তৈরি করবে, মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। এর মধ্য দিয়ে বিরোধী দলকে উৎসাহিত করলেন। নির্বাচন নিয়ে তাদের অভিযোগ করার পরিবেশ সৃষ্টি করলেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/79625