১৫ জুলাই ২০১৮, রবিবার, ১০:০৯

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

তিন কারণে ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার সঙ্কট

আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি ; বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম


চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে তিন কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। আমদানিনির্ভর দ্রুত ঋণ প্রবৃদ্ধির সাথে রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির পার্থক্য বেশি হয়েছে। এতে স্থানীয় বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক অনিয়মের জন্য ব্যাংকিং খাতে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সব মিলে ব্যাংকিং খাতে তারল্য ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তারল্য ব্যবস্থাপনায় এ চাপ সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও বেগ পেতে হয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে সহজেই টাকার সঙ্কট মেটাতে পারে এ জন্য রেপোর সুদহার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ কমাতে হয়েছে। ব্যাংকারদের চাপে কমানো হয়েছে সিআরআর হার। শিথিল করা হয়েছে কিছু নির্দেশনা। বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ২৩১ কোটি ডলার ছাড়তে হয়েছে। আর ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়মের দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সরকারি পাঁচ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা হয়েছে আর্থিক অনিয়মের কারণে সঙ্কটে পড়া ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন জোগান দিতে।

জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে বিনিয়োগ স্থবিরতায় ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত টাকা ছিল। গত বছরের শুরুতেও ব্যাংকের হাতে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য ছিল। বিনিয়োগ করতে না পারায় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমিয়ে দেয়। এ দিকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার আমানতের মুনাফা অপেক্ষা বেশি থাকায় বেশি মুনাফার আশায় ব্যাংকমুখী না হয়ে সাধারণ গ্রাহক বা সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এতে ব্যাংকের আমানত কমতে থাকে। এরই মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক অনিয়ম জানাজানি হওয়ার পর ব্যাংকিং খাতে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর ওপর অনেকটা আস্থা হারিয়ে ফেলেন আমানতকারীরা। এমনকি সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো বিধিবহির্ভূতভাবে নতুন ব্যাংকসহ বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণ আমানত রেখেছিল, তা প্রত্যাহার করতে থাকে। ফলে চলতি বছরের শুরুতেই ব্যাংকিং খাতে এ নগদ টাকার সঙ্কট হতে দেখা যায়। বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের টান পড়ায় ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি এ সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবিবেচনামূলক আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে কিছু তফসিলি ব্যাংকে তারল্য চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এ চাপ কমাতে ঋণ আমানতের সর্বোচ্চসীমা অর্থাৎ এডিআর সাড়ে ৮৩ শতাংশে নামিয়ে আনার সময়সীমা এক বছর বাড়িয়ে আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এ দিকে নতুন প্রজন্মের ব্যাংক ফারমার্সের আর্থিক অনিয়মের ফলে ওই ব্যাংকে উদ্ভূত তারল্য সঙ্কট সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের আমানতকারীদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করেছিল। এ অবস্থা থেকে স্বস্তিকর অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকটিতে নতুন করে মূলধন জোগান দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ দিকে ব্যাংকগুলো তহবিলের ব্যবস্থা না করেই দেদারছে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছে। এতে ব্যাপক ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার দায় সৃষ্টি হয়েছে। যেমনÑ গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) আমদানির প্রবৃদ্ধি হয় ২৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ মাসে চার হাজার ৯০১ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হয়। বিপরীতে গত অর্থবছরে (জুলাই-জুন) রফতানি প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ এক বছরে রফতানির মাধ্যমে আয় হয় তিন হাজার ৩৭৩ কোটি ডলার এবং রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হয় ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ রেমিট্যান্স আসে এক হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার। এতে দেখা যায় রফতানি ও রেমিট্যান্স মিলে এক বছরে যে পরিমাণ অর্থ দেশে আসে তার চেয়ে বেশি ব্যয় হয় ১০ মাসের আমদানিতে। বাকি দুই মাসের হিসাব এখন হালনাগাদ করা হয়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সমন্বয় করতে পারেনি।

বৈদেশিক মুদ্রার এ চাহিদা ও জোগানের মধ্যে যে বিরাট ফারাক সৃষ্টি হয় তা পূরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে ২৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ১৯ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। এর ফলে বাজারে সমপরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা হ্রাস পেলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগের বছরের চেয়ে কমে যায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর ঐকান্তিক চেষ্টা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য ও দেশে এসব পণ্যের আমদানির পরিমাণে বড় ধরনের বৃদ্ধি না ঘটলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমে আসবে বলে প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/332978