১৪ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ১২:৩৬

বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী আরও ৬শ’ বাস আসছে

ভারতের প্রথম এলওসির আওতায় ২০১২ সালে ১০০ কোটি টাকায় এসি এবং আর্টিকুলেটেড বাস কেনে বিআরটিসি। ১২ বছরের বেশি সময়ের আয়ুষ্কালের এমন ১৩৮টি বাসের অধিকাংশই নিয়ে আসার দুই বছরের মধ্যেই জরাজীর্ণ হয়ে যায়। বর্তমানে সেসব বাস চলাচলের অনুপযোগী। এ তথ্য স্বয়ং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি)। এতে বলা হয় বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলে অনুপযোগী ও নিম্নমানের বাস হওয়ায় তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। অতি অল্প সময়ে এতো বিপুল অঙ্কের সরকারি অর্থে এ ধরনের নিম্নমানের পণ্য কেনার অধিক তদন্ত চেয়েছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, যা সরকারের একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। এরপর আবারও নতুন করে ভারত থেকে বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী ৬শ’ বাস আমদানী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আর এ বাস আমদানীতে বাংলাদেশের ইচ্ছার কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। বরং ভারতের ঋণে বাস কিনতে বাংলাদেশের ক্রয় শর্তের ৪৫টি শর্ত পরিবর্তন করিয়েছে তারা। তবে দামের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন করতে দেননি। ফলে ভারত বাংলাদেশকে তাদের ইচ্ছামতো বাস ক্রয়ে বাধ্য করেছে।
সূত্র জানায়, ভারত থেকে আগের কেনা বাসগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সরকার ও বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে আগামীতে কোনো বাস কিনতে হলে তা বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলের উপযোগীতা বিবেচনা করে কিনতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলের উপযোগী বিশ্লেষণ করে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়। সেই প্রস্তাবনার আওতায় ৫৮০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬০০টি বাস কেনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রতিটি বাসের মূল্য ধরা হয় ৬৯ লাখ থেকে ৭২ লাখের মধ্যে। একই সাথে বিআরটিসির আগের কেনা বাসের খারাপ অবস্থার কারণে নতুন বাস ক্রয়ের প্রকল্প অনুমোদনে আপত্তি তোলে পরিকল্পনা কমিশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মহাসড়ক ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুনভাবে স্পেসিফিকেশন তৈরি করে সংস্থাটি।
জানা যায়, ভারতীয় ঋণের টাকায় বাস বা যানবাহন ক্রয় করতে হবে সে দেশ থেকেই। এজন্য বাংলাদেশ সরকারের চাহিদা অনুসারে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রস্তুত করলেও তা সংশোধন করতে হয়েছে। কেননা মন্ত্রণালয়ের চাহিদার অনুযায়ী বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলের উপযোগী বাস ভারতের কোনো কোম্পানি তৈরি করে না। এজন্য ভারত যে ধরনের বাস প্রস্তুত করে সেটাই আনতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। যদিও বাসের দামে কোনো হেরফের হচ্ছে না।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বিআরটিসির জন্য দ্বিতল, একতলা এসি/নন এসি বাস সংগ্রহ (১ম সংশোধনী) প্রকল্পের পিইসি সভা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ঋণের আওতায় ৬০০টি বাস আনা হবে। এর জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৮০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। যার মধ্যে ৪৩৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা এলওসি বা ভারতীয় ঋণ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলে উপযোগিতা বিবেচনায় এনে চাহিদা অনুযায়ী বাসগুলোর নকশা চূড়ান্ত করে ডিপিপি অনুসারে দরপত্রের কাগজপত্র ভারতীয় ঋণ সরবরাহকারী এক্সিম ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এতে তারা রাজি হয়নি। পরবর্তীতে প্রস্তুতকৃত ডিপিপির শর্তের মধ্যে ৪৫টিতে আপস করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। কেননা ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের চাহিদা ও শর্তানুরূপ বাস ভারতের কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে না। ফলে এসব ধারার সংশোধন না করলে বাসগুলো সরবরাহের দরপত্রে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে না। ফলে দর কষাকষি করে এসব ধারা সংশোধন করতে বাধ্য হয় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রকল্পের কার্যবিবরণী নিয়ে সভা হয়। সভায় ৩০০টি দ্বিতল ও ১০০টি একতলা নন এসি বাসের দরপত্র অনুমোদন পায়। অবশিষ্ট ২০০টি একতলা এসি বাস কেনার লক্ষ্যে দরপত্রের ওপর ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক কোনো মতামত বা অনুমোদন দেয়নি। ফলে ২০০টি এসি বাস কেনার বিষয়ে পরবর্তীতে জানানো হবে বলে কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়।

একই সভায় একাধিকার প্রকল্পের দরপত্র ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকে পাঠানো হলে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এরপর ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক, ভারতীয় হাইকমিশন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং বিআরটিসি প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এক বৈঠক হয়।
বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, এমনভাবে ডিপিপি প্রস্তুত করতে হবে যেন ভারতের বাস প্রস্তুতকারী সব প্রতিষ্ঠান এই দরপত্রে অংশ নিতে পারে। সেই প্রেক্ষিতে ডিপিপির ৪০ থেকে ৪৫টি জায়গায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
ইআরডি সূত্র জানায়, প্রকল্পের শর্তে পরিবর্তন আসলেও দাম অপরিবর্তিত থাকছে। প্রকল্পের আওতায় ৩০০টি দ্বিতল বিশিষ্ট বাস আনা হবে, যার দাম ধরা হয়েছে প্রতিটি ৭২ লাখ টাকা করে। একতলা বিশিষ্ট বাসগুলোর দাম ধরা হয়েছে প্রতিটি ৬৯ লাখ টাকা, আর ১০০টি এসি বাসের দাম পড়বে প্রতিটি ৭০ লাখ টাকা করে। এসব বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ১২ বছর হবে বলে জানিয়েছে ভারতীয় বাস সরবরাহকারী কোম্পানি অশোক লেল্যান্ড।

এ ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারতীয় ঋণে আনা বাস ক্রয়ে কিছুটা জটিলতা ছিল, সেগুলো কেটে গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০১৯ সাল নাগাদ ৩০০টি ডাবল ডেকার ও ২০০টি ১ তলা বাস আনা হবে। তবে এসি বাসগুলো আসতে আরেকটু সময় লাগতে পারে।
এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) থেকে জানা গেছে, ভারতের প্রথম এলওসির ১০০ কোটি টাকার আওতায় ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এসি এবং আর্টিকুলেটেড বাস কেনে বিআরটিসি। ১২ বছরের বেশি সময়ের আয়ুষ্কালের এমন ১৩৮টি বাসের অধিকাংশই ২০১৫ সালের (দুই বছরেই) মধ্যে জরাজীর্ণ হয়ে যায়। আর বর্তমানে সেসব বাস এখন চলাচলের অনুপযোগী। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিপুল অঙ্কের সরকারি অর্থে এ ধরনের নি¤œমানের পণ্য কেনার অধিক তদন্ত চেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, যা সরকারের একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে।
ওই বছরে বাংলাদেশকে ভারতের ১০০ কোটি ডলার ঋণসীমার আওতায় বিআরটিসিকে (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন) ২৯০টি দ্বিতল বাসের সবগুলোই সরবরাহ করে। মোট ঋণের মধ্যে ২ কোটি ৩৩ লাখ ২০ হাজার ডলার ব্যয়ে ২৯০টি দ্বিতল বাস ক্রয় প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছিল। ক্রয় চুক্তিটি পেয়েছিল ভারতের মেসার্স অশোক লেল্যান্ড।

এ ব্যাপারে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, বিআরটিসির বিদেশি ঋণের অর্থে আরও বাস কেনার অনুমোদনের আগে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রয়োজন। নি¤œমানের পণ্য রাষ্ট্রীয় অর্থে কেনার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি এ ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় তারও ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) সিঙ্গেল ডেকার, আর্টিকুলেটেড ও ডাবল ডেকার মিলে মোট ১ হাজার ৫৩৭ বাসের মধ্যে ৫৫৫টিই নষ্ট। এসব বাস বিভিন্ন সময় কেনা হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে এসব বাস কেনা হয়েছিল তা পূরণ হয়নি। কোন কোন বাস কেনার অল্প সময়ের মধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। বিআরটিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নি¤œমানের বাস কেনা, সড়ক দুর্ঘটনা, হরতাল-অবরোধ, সংশ্লিষ্টদের অযতœ-অবহেলা এবং যাত্রীদের সচেতনতার অভাবে বাসগুলো নষ্ট হয়েছে।

ভারত থেকে আনা মোট ৪৪৩ সিঙ্গেল ডেকার বাসের মধ্যে ২০১৬ সালে সচল ছিল ২৫৫টি। নষ্ট হয়েছিল ১৮৮টি বাস। বিআরটিসি বলছে, আর্টিকুলেটেড (জোড়ালাগানো) বাস মোট কেনা হয় ৫০টি। এর মধ্যে ৩৬ বাস চলছিল আর নষ্ট ছিল ১৪টি। ভারতের অশোক লেল্যান্ড কোম্পানি থেকে ডাবল ডেকার বাস কেনা হয় মোট ৪৫৮টি। এর মধ্যে ৩০৬ বাস চলছিল আর নষ্ট ছিল ১৫২টি বাস। এসব বাসের মধ্যে বর্তমানে খুব কম সংখ্যক বাস চালু রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির এক প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দরপত্রে আর্টিকুলেটেড বাসের আয়ুষ্কাল ১২ বছর উল্লেখ করেছে। বলা হয় ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, বাসে নি¤œমানের উপকরণ ব্যবহার, বাস জরাজীর্ণ হয়ে পড়া, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কাজ না করাসহ দেখা দেয় নানান ত্রুটি। এ কারণে বাসগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘এর আগে প্রকিউরমেন্ট অব ডাবল ডেকার, সিঙ্গেল ডেকার এ্যান্ড আর্টিকুলেটেড বাসেস ফর বিআরটিসি’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৩৭৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকায় ৪২৮টি বাস কেনা হয়। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২৯০টি দ্বিতল বাস (ডাবল ডেকার), ২০১৩ সালে ৫০ আর্টিকুলেটেড বাস এবং ৮৮টি একতলা এসি বিআরটিসির বহরে যোগ হয়। তিনটি প্যাকেজে এসব বাস সরবরাহ করে ভারতীয় কোম্পানি অশোক লেল্যান্ড লিমিটেড। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশী এজেন্ট ইফাদ অটোস লিমিটেড। এসব বাস ঢাকার ভেতরে ও দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলের জন্য বরাদ্দ দেয় বিআরটিসি।

http://www.dailysangram.com/post/337771