৯ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ৩:৩৩

সংকীর্ণতার গণ্ডি ভাঙুক

এমাজউদ্দীন আহমদ

গণতান্ত্রিক রাজনীতিই এ দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য কম ত্যাগ স্বীকার করেনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, জনগণের এত ত্যাগ, চাওয়া সত্ত্বেও গণতন্ত্র এখনও কাঙ্ক্ষিত রূপ লাভ করেনি। অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতিতে গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতার দৃশ্যত ঘাটতি চোখে না পড়লেও বাস্তবতা ভিন্ন। এর নিরসন ঘটানো যায়নি বলেই আমাদের রাজনীতি নিয়ে কখনও কখনও খুবই হতাশা দেখা দেয় জনসমাজে।

জনপ্রত্যাশার পূর্ণতা দিতে পারেন সরকারের দায়িত্বশীলরা, নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তরা, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকরা। এ জন্য দরকার সবার সদিচ্ছা, পারস্পরিক সমঝোতা, পরমতসহিষুষ্ণতা, গণতন্ত্রের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা। সংকীর্ণতা বিসর্জন দিতে হবে। প্রতিহিংসাপরায়ণতা সব সৌন্দর্য নষ্ট করে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য করে তোলে। এ দেশের সিংহভাগ শান্তিপ্রিয় মানুষ কোনোভাবেই এসব পছন্দ করে না, সমর্থন করে না। শান্তিপ্রিয় সচেতন মানুষ মাত্রই গণতন্ত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন। গণতন্ত্রের অপরিহার্য অনুষঙ্গগুলো কেন, কীভাবে, কাদের কারণে কালিমালিপ্ত হচ্ছে, তাও সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। মানুষকে এখন ধোঁকা দেওয়া সম্ভব নয়। মানুষ এখন অনেক সচেতন এবং আমাদের আশাও সেখানেই।

আমাদের দেশের রাজনীতিকে কীভাবে জনকল্যাণমূলক করা যায়, কীভাবে সুসংহত যৌথ জাতীয় কর্মে রূপান্তরিত করা যায়, কীভাবে জাতীয় কর্তব্যের প্রকৃষ্ট মাধ্যমরূপে তার প্রকৃতিতে সার্বিক পরিবর্তন সাধন করে রাজনীতিকে সৃজনশীল করা যায়- এ নিয়ে ভেবেছেন অনেকেই। এ সম্পর্কে চিন্তাভাবনাও করেছেন অনেকেই। তার সঙ্গে এই ছোট্ট লেখাটিও যুক্ত হোক। অন্তত কিছু সৎচিন্তার অধিকারী এ বিষয়ে হাজারো ভাবনাচিন্তা করুন। এই লক্ষ্যেই ছোট্ট ক'টি লাইন উপস্থাপিত হলো। ঔউগ গরষষবৎ রাজনীতি সম্পর্কে অনেক লিখেছেন। বহু তর্ক করেছেন; কিন্তু সর্বসম্মত কোনো সিদ্ধান্তে এখনও পৌঁছতে পারেননি (গরষষবৎ, ১৯৬৫, চবষরপধহ ইড়ড়শং)। তার কথায়, 'এক মহান ক্রীড়ার মতো রাজনীতিতে রয়েছে নেতৃত্ব, প্রশংসা লাভ এবং আত্মনিবেদনের সুযোগ' ('চড়ষরঃরপং, ষরশব ধ মধসব, মরাবং ংপড়ঢ়ব ভড়ৎ ষবধফবৎংযরঢ়, ভড়ৎ ধঢ়ঢ়ষধঁংব ধহফ ফবফরপধঃরড়হ'); কিন্তু রাজনীতি তার যথার্থ রূপ পেতে হলে হতে হবে 'জনকল্যাণের লক্ষ্যে এমন এক সুসংহত যৌথ কর্ম, যা হলো নৈতিকবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোনো মহৎ কর্ম সম্পাদন করার এক প্রকৃষ্ট পন্থা ('চড়ষরঃরপং রং ধ সবধহং ড়ভ মবঃঃরহম :যরহমং ফড়হব, ড়ভঃবহ রিঃয ধ ংঃৎড়হম ংবহংব ড়ভ সড়ৎধষ ঁৎমবহপু'- ওনরফ, ঢ়২৩)। তিনি জানতেন যে, সমাজ জীবনের যেসব উপাদানের জন্য অর্থাৎ অসম্মতি অথবা ভিন্নমত এবং স্বার্থের সংঘাতের (ফরংধমৎববসবহঃ ধহফ পড়হভষরপঃ) জন্য সমাজে রাজনীতির জন্ম হয়, তা অনেকটা চিরস্থায়ী, নিত্য। জনসমাজ যতদিন থাকবে ও সমাজে যতদিন অভাব-অনটন থাকবে এবং তা নিরসনের জন্য যতদিন বহুমুখী ব্যবস্থা থাকবে, রাজনীতিও ওই সমাজ জীবনকে ঘিরে টিকে থাকবে। রাজনীতিকে তাই শান্তিপ্রিয়, যুক্তিবাদী এবং প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য এবং রাজনীতি থেকে সন্ত্রাস ও সংঘাত দূর করার জন্য প্রয়োজন সমাজের মৌল সমস্যা সম্পর্কে সমাজব্যাপী এক ঐকমত্যের ঘন আস্তবরণ তৈরি করা। কিন্তু সমাজব্যাপী সেই ঐকমত্য শুধু তখনই তৈরি

হবে, যখন রাজনীতি সংকীর্ণ স্বার্থের আবর্ত থেকে জনজীবনের বৃহত্তর অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়বে এবং গোষ্ঠীস্বার্থ অথবা শ্রেণিস্বার্থের দেয়াল ভেঙে ছিটিয়ে-ছড়িয়ে পড়বে জনস্বার্থের উদার প্রান্তরে। বিস্তৃত হবে কল্যাণমুখী বিস্তৃত মোহনায়।

ক্ষমতার রাজনীতিকে অনেকে রাজনীতি বলতে চান না। ক্ষমতার রাজনীতির মধ্যে নৈতিকতার প্রলেপ নেই। না থাকায় মানব সমাজের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। যে ক্ষেত্রে ক্ষমতার রাজনীতিই মুখ্য তাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সেই রাজনীতির কুশীলবদের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে ক্ষমতার বিষক্রিয়ায় তা জনগণের ঘৃণায় হারিয়ে যাবে একদিন। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ধারণা হলো, ক্ষমতার রাজনীতিকে জনকল্যাণের রাজনীতিতে রূপান্তরিত করতে হবে সচেতন উদ্যোগের মাধ্যমে। আবদ্ধ জলাশয়ে কখনও আপনাআপনি স্রোতের সৃষ্টি হয় না। জীবনী শক্তির অসংখ্য ঝর্ণাধারায় সিক্ত ও সমৃদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা কখনও স্রোতস্বিনীতে পরিণত হবে না। এ জন্য চাই সার্থক নেতৃত্ব। চাই পরীক্ষিত ও কালোত্তীর্ণ উদ্যোগ এবং চাই জনকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ নেতার জাদুকরী স্পর্শ। ক্ষমতার রাজনীতির রোমশ এবং নির্মম পন্থা কোনোদিন সুস্থ রাজনীতির আকার ধারণ করবে না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শত বছর ধরে পরিবর্তন এসেছে, তা অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে সঙ্গত কারণেই। এর প্রেক্ষাপট এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন মহল মাত্রই জ্ঞাত। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের মতো অত সহজে জন্মলাভ করেনি। এ দেশের জনগণ সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে, সমাজ জীবনের শত ধারায় রক্ত ঝরিয়ে, এক সাগর রক্ত সাঁতরে তুলে এনেছে স্বাধীনতার রক্তকমল। লাভ করেছে সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাদের স্বপ্নের কুসুমকলিগুলো পদদলিত করে যেভাবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বৈরতান্ত্রিক বাংলাদেশ রূপে রচিত হচ্ছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতির প্রতি এ এক অনপনেয় অপমান। এ পথ বাংলাদেশের নয়। এ পথ যত দ্রুত সম্ভব পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। এভাবে চলতে পারে না। চলা কোনোভাবেই সঙ্গত নয়। যদি এ রকম চলতে থাকে তাহলে এর পরিণাম ভয়াবহ হয়ে উঠতে বাধ্য। আমাদের সামনে যে সুযোগ রয়েছে তা যেন আমরা হাতছাড়া না করি। সামনের জাতীয় নির্বাচনে এই সুযোগ আসছে। গ্রহণ করুন। নতুন আলোয় চারদিক ঝলসিয়ে উঠুক। এ জন্য খুব বেশি কিছু করতে হবে না। প্রয়োজন মাত্র কয়েকটি পদক্ষেপ।

এক. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন সংসদীয় ব্যবস্থায় বাংলাদেশে সংসদকে ভেঙে দেওয়া। প্রত্যেক সংসদীয় ব্যবস্থায় জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সংসদের নির্বাচিত কক্ষ ভেঙে দেওয়া হয়। কানাডার দিকে তাকান, ব্রিটেনের দিকে তাকান, জাপান, জার্মানির দিকে তাকান। এমনকি প্রতিবেশী ভারতের লোকসভার দিকে তাকান। নির্বাচিত কক্ষ না ভেঙে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা আসে না। এর ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হয়। নির্বাচনে সমতল ভূমি অনিশ্চিত থাকলে কী হয় কিংবা হতে পারে, এমন নজির তো আমাদের সামনেই রয়েছে।

দুই. গত কয়েক বছরে বিরোধী দলগুলোর, বিশেষ করে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৬০ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলাই শুধু বিরোধী দলের কর্মীদের ভীতি প্রদর্শনের লক্ষ্যে। কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলাও রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে যদি ফৌজদারি বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে থাকে তাদের সম্পর্কে আমার কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু যেগুলো প্রত্যাহার করা যায় অথবা নির্বাচন পর্যন্ত স্থগিত রাখা যায়, যেন যাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা রয়েছে তারাও যেন ভোট দিতে পারেন অথবা ভোট প্রার্থনা করতে পারেন।

তিন. অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, গত দশ বছরে দেশের শাসন-প্রশাসনকে অনুগত দলীয় ক্যাডারের মাধ্যমে এমনভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে যে, তাদের অনেকেই দেশের জনগণের আস্থা হারিয়েছেন। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার আসে আর যায়, কিন্তু শাসন-প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্থায়ীভাবে অবস্থান করে শাসন পরিচালনা করেন। নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন; কিন্তু নির্বাচন কমিশনকেও নির্ভর করতে হবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপরই। খুলনায় যা ঘটেছে, তা বিদেশিদের চোখেও পড়েছে। তাই আসছে নির্বাচনের সময় (নির্বাচনের দিন দশেক পূর্ব থেকে নির্বাচন সমাপ্তির দিন তিনেক পর পর্যন্ত) নিরাপত্তা বাহিনী থেকে কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মীর ওপর যদি পোলিং সেন্টার দেখাশোনা এবং ভোটদাতাদের আশপাশে থাকার ব্যবস্থা করতে হয়, তা হলে ভোটাদাতাদের আস্থা বৃদ্ধি পায়।

চার. জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরে নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ছোট আকারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার কথা, যার মাধ্যমে সরকারের দৈনন্দিন কার্য সমাধা হতে পারে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিরোধী দলগুলো থেকে, বিশেষ করে বিএনপি থেকে কয়েকজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করলে নির্বাচনের পরিবেশটা উন্নত করা যেতে পারে। এ জন্য দরকার উদার মানসিকতা ও গঠনমূলক চিন্তাভাবনা।

যখন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গণতন্ত্রের ওপর পাঠ গ্রহণ করতাম আমাদের কৃতী শিক্ষকদের কাছ থেকে, তখন তারা বলতেন, গণতন্ত্র সফল হয় যদি জনগণ রাজনীতি সচেতন হয়, নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন থাকে, সাক্ষরতার হার যদি একটু উন্নত হয় এবং গণঅধিকার লঙ্ঘিত হলে যখন জনগণ প্রতিবাদ করতে শেখে। দীর্ঘকাল ধরে এখন যখন ভাবি আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা যা বলেছিলেন তা খানিকটা অর্ধসত্যের মতো। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতা দেখলে এখন মনে হয়, জনগণের রাজনীতি সচেতনতা এবং অধিকার লঙ্ঘিত হলে জনগণের প্রতিবাদ নিশ্চয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রক্ষকবচ; কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গণতন্ত্রপ্রীতি। যে কোনো অবস্থায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে তাদের সুদৃঢ় সংকল্প। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি একাগ্রতা। রাষ্ট্রক্ষমতা যে জনগণের সম্পদ এবং সম্পদের রক্ষক হিসেবে কাজ করাই যে নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব, তা তখন আমরা শিখিনি। শিখলেই-বা কী হতো! আমাদের মতো উপনিবেশ-উত্তর সমাজে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, কোনো কোনো সময়ে ভীষণ ত্যাগ স্বীকারও করেছেন; কিন্তু স্বাধীনতা অর্জিত হলে অতীতকে ভুলে গিয়ে তখনকার শাসকদের জৌলুসপূর্ণ জীবন পদ্ধতি, সঙ্গে সঙ্গে তখনকার শাসকদের ক্ষমতা প্রয়োগ পদ্ধতিও অনুসরণ করতে আগ্রহী হয়েছেন। এ জন্য অনেকের মধ্যে ক্ষমতার প্রতি দুর্বলতা এবং ক্ষমতা-প্রসূত সুযোগ-সুবিধা ভোগের আকাঙ্ক্ষা লক্ষ্য করা যায়। এসব দেশে এ জন্যই গণতন্ত্র পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে। তারপরও আমরা আশা করি, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আমাদের চারপাশটা আলোকিত করে রাখুক।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

http://samakal.com/todays-print-edition/tp-editorial-comments/article/18071823