১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১৪

চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদ অপহরণ: ঘটনাস্থলের গাড়িটি পুলিশেরই

 

চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদকে অপহরণের সময় ঘটনাস্থলে থাকা গাড়িটি পুলিশের। অপহরণের তিন মাস পর আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে এ তথ্য স্বীকার করেছে পুলিশ। আদালত ওই এলাকায় ওই রাতে যাঁরা টহলে ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন।
তবে ওই এলাকার আশপাশের থানা কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে বলেছে, তাদের কোনো গাড়ি ঘটনাস্থলে ছিল না।
গত ১৪ অক্টোবর শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টা ১০ মিনিটে লক্ষ্মীপুর থেকে ইকবাল মাহমুদ ঢাকায় পৌঁছান। বাস থেকে নামার পরপরই সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে আড়ংয়ের সামনে থেকে সাদাপোশাকে একদল লোক তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে নেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, মাইক্রোবাসের পেছনে দুজন আরোহীসহ একটি মোটরসাইকেল এবং একটি পুলিশের গাড়ি। গাড়িটি ছিল নিশান ডাবল কেবিন পিকআপ।
ইকবাল মাহমুদের বাবা এ কে এম নুরুল আলম অভিযোগ করছিলেন, ছেলে অপহরণের পরপর পুলিশের যে তৎপরতা ছিল, সিসিটিভি ফুটেজে পুলিশের গাড়ি দেখার পর তা স্তিমিত হয়ে যায়। শুধু পুলিশই নয়, র্যা বেরও তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না বলে অভিযোগ করেছেন এ কে এম নুরুল আলম। এই প্রেক্ষাপটে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যা বের মহাপরিচালক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, গোয়েন্দা বিভাগের উপকমিশনার, র্যা ব-২, ৩ ও ধানমন্ডি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন।
রিটের শুনানি চলাকালে আদালতের নির্দেশে পুলিশ একাধিক প্রতিবেদন দাখিল করে। রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মো. জিয়াউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের একটি প্রতিবেদনে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, ঘটনাস্থলে উপস্থিত টহল গাড়িটি পুলিশের।
গত ২৯ জানুয়ারি বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি এম ফারুকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এক নির্দেশনায় বলেন, বাদীপক্ষের আইনজীবী ঘটনাস্থলে পুলিশের গাড়ি থাকার কথা বলেছিলেন। পুলিশ আদালতে নথিপত্র দাখিল করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘অনুচ্ছেদ ৪ এ বর্ণিত বিবৃতি আংশিক সত্য, কারণ পুলিশ ভ্যানটি মোবাইল পেট্রল ডিউটিতে নিয়োজিত ছিল।’ আদালত বলেন, এখন পুলিশের উচিত তাঁদের উপস্থিতিতে যে ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে প্রতিবেদন দাখিল করা। সেদিন টহল গাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের থেকে প্রতিবেদন নিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতে দাখিলেরও নির্দেশ দেন তাঁরা।
আদালতের এ নির্দেশনার পর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ের যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে, তার আশপাশে তিনটি থানায় অনুসন্ধান করে প্রথম আলো।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল লতিফ বলেন, তাঁর থানার গাড়ির দরজায় থানার নাম ও টেলিফোন নম্বর লেখা আছে। সিসিটিভি ফুটেজে যে গাড়িটি দেখা গেছে, সেটিতে থানার নাম ও নম্বর লেখা নেই। কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, গাড়িটি কোন থানার, তা তাঁর জানা নেই। নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুর রহমান বলেছেন, ওই রাতে তাঁর থানার গাড়ি ধানমন্ডিতে টহল দিতে যায়নি। আদালতের নির্দেশের পর এখন ওই রাতে থানার টহল গাড়িগুলো কোনটি কখন কোন অবস্থানে ছিল, তা যাচাই-বাছাই চলছে।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি অঞ্চলের উপকমিশনার পদমর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় প্রতিটি থানায় টহলের কার্যতালিকা থাকে। এক থানার গাড়ি সাধারণত অন্য থানায় টহল দেয় না। বিশেষ অপারেশন থাকলে দূরবর্তী কোনো থানা থেকেও টহল গাড়ি যায়। তবে, সে ক্ষেত্রে স্থানীয় থানাকে অবহিত করা হয়।
যে রাতে ইকবাল মাহমুদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, সে রাতে কি ধানমন্ডিতে কোনো বিশেষ অভিযান ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল লতিফ বলেছেন, এমন কিছু তাঁর জানা নেই। তিনি আরও বলেন, তাঁরা ধানমন্ডি আড়ং থেকে গণভবন পর্যন্ত রাস্তায় থাকা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর পর্যন্ত মাইক্রোবাসটি দেখা গেলেও তারপর আর সেটিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
‘এভাবে উধাও হয়ে যাওয়া খুবই অস্বাভাবিক ও দুর্ভাগ্যজনক’—গত ২৯ জানুয়ারি আদালত বলেন, ঘটনার শিকার ব্যক্তি একজন চিকিৎসক। তিনি সরকারের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। আন্তজেলা বাস থেকে ধানমন্ডিতে নেমে এভাবে তাঁর উধাও হয়ে যাওয়া খুবই অস্বাভাবিক ও দুর্ভাগ্যজনক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেসব কাগজপত্র জমা দিয়েছে, তাতে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখেছে ও তদন্ত করছে। কিন্তু ওই ঘটনার পর তিন মাস সময় পেরিয়ে গেছে। নিখোঁজ চিকিৎসক কোথায়, সে সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আরও বেশি তথ্য থাকা উচিত ছিল।
বিধ্বস্ত পরিবার
ইকবাল মাহমুদ ২৮তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার দিন কয়েক আগে অবেদনবিদ্যার (এনেসথেসিওলজি) ওপর তিনি স্নাতকোত্তর লেখাপড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। ছুটির দিনে লক্ষ্মীপুরে বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানের কাছে থাকতেন। সেখানকার একটি ক্লিনিকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী কাজ করতেন।
ইকবাল নিখোঁজ হওয়ার পরপরই ঢাকায় এসেছিলেন তাঁর বাবা এ কে এম নুরুল আলম। সনদ ও ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তিনি। এক মাস পরও ছেলের খোঁজ না পেয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন গত বছরের ১৭ নভেম্বর। তাঁর বক্তব্য ছিল, ইকবাল মাহমুদ যদি কোনো অপরাধ করে থাকে, তাঁকে যেন আদালতে হাজির করা হয়।
এর মধ্যে একটি পত্রিকায় অনামা সূত্র ব্যবহার করে ইকবাল মাহমুদের জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ার খবর প্রকাশ করে। খবরে বলা হয়, ইকবাল মাহমুদ জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করেছেন। নুরুল আলম বলেন, জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করলে তার প্রমাণ হাজির করা হোক। তাঁকে আদালতে তোলা হোক। তাঁর বিচার হোক। কিন্তু দিনের পর দিন ইকবাল মাহমুদ উধাও হয়ে থাকতে পারেন না।
ইকবাল মাহমুদ কি সত্যিই জঙ্গিবাদে জড়িত ছিলেন? জানতে চাইলে র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁকে তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না, তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়েছিলেন কি না, কী করে বলব? আমরা এখনো তাঁকে খুঁজছি।’
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1082447/%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%87