৮ জুলাই ২০১৮, রবিবার, ৯:৩২

অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবে আপত্তি পরিকল্পনা কমিশনের

আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ২৩৯ কিলোমিটারের এ রেললাইন ডুয়েলগেজে রূপান্তর করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। এ ব্যয় প্রস্তাবকে অস্বাভাবিক বলে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। জিটুজি পদ্ধতিতে চীন সরকার এ প্রকল্পে ১০ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি পাঁচ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে জোগান দেওয়ার কথা। কমিশন বলছে, প্রকল্পে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তা অস্বাভাবিক ও বেশি। কমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেন, এ প্রকল্প পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিয়েই বাস্তবায়ন সম্ভব। অস্বাভাবিক ব্যয় দেখিয়ে টাকা লুটপাটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব কারণেই অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হচ্ছে। ঋণের টাকায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কোনো লাভ হবে না বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।

পরিকল্পনা কমিশন আরও বলছে, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ডুয়েলগেজ লাইন হলে ট্রেন চলাচলের হার (ফ্রিকোয়েন্সি) বাড়বে না। এ রুটে ডাবল লাইন এবং ডুয়েলগেজ নির্মাণ করা হলে এ প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে। অন্যথায় সরকারের এ বিশাল বিনিয়োগে জনগণের তেমন কোনো সুবিধা হবে না। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পে ব্যালাস্ট (পাথর), স্লিপার, রেলসহ অন্যান্য উপকরণের পরিমাণ ও ব্যয় চলমান সমজাতীয় অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি। সব মিলিয়ে প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় সমজাতীয় চারটি প্রকল্পের তুলনায় প্রায় সাত গুণ বেশি। এত ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সমীচীন হবে না বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এ প্রকল্পে আপত্তি তুলে এক চিঠিতে বলেছেন, এটা ডাবল লাইন ও ডুয়েলগেজ হওয়া উচিত। শুধু ডুয়েলগেজ করে কোনো লাভ হবে না।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় অনেক ক্ষেত্রে উন্নত দেশের চেয়েও বেশি। নিউইয়র্কের একটি রাস্তা নির্মাণের চেয়ে বাংলাদেশে একটি রাস্তা নির্মাণে খরচ বেশি পড়ে বলে মন্তব্য করা হয়। প্রস্তাবিত প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অন্যদিকে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরে চলমান প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ছয় কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা ঢালারপর পর্যন্ত নতুন রেলপথ। এছাড়া মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল আরেকটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণে ব্যয় মাত্র আট কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
প্রকল্পের ভৌত কাজের জন্য প্রতিযোগিতা ছাড়া এক ঠিকাদারের মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতেও পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি জানিয়েছে। কমিশনের মতে, চীনের অন্যান্য দরদাতা প্রতিষ্ঠানের জন্যও দরপত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে করার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ওই প্রকল্পে অনেক বেশি ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়। এ কারণে শেষ পর্যন্ত চীনের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রিটিশ আমলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে আসাম ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মধ্যে কৌশলগত যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ১৮৯৮ সালে প্রথম করিমগঞ্জ-শাহবাজপুর-কুলাউড়া-আখাউড়া-চট্টগ্রাম সেকশনে রেললাইন স্থাপিত হয়। শাহবাজপুর-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের একটি সাব-রুট। মহীশ্মসান (ভারত) ও শাহবাজপুরের (বাংলাদেশ) মধ্যে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ভারতীয় ক্রেডিট লাইনের (এলওসি) আওতায় সেকশনটি পুনর্বাসনেরর জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের কাজ চলমান রয়েছে। আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণকাজও শুরু হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামে করিডোরের বাকি অংশ ডুয়েলগেজে রূপান্তরের লক্ষ্যে একটি সমীক্ষা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ভারতীয় অনুদানে আগরতলা ও আখাউড়ার মধ্যে ১০ কিলোমিটার রুটে আরেকটি ডুয়েলগেজ লিংক স্থাপনের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। এসব কাজের সঙ্গে সমন্বয় রাখতে আখাউড়া-সিলেট সেকশনটি ডুয়েলগেজে রূপান্তরের লক্ষ্যে আলোচ্য প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয়েছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চায়না রেলওয়ে ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় ২০১৫ সালে। এর পর প্রকল্পের প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাবনা (পিডিপিপি) তৈরি করা হয়, যা ২০১৬ সালে অনুমোদিত হয়। পরে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্প বিবেচনা করে প্রকল্পটি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটি মোট ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা।
মতামত জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে জিটুজি পদ্ধতিটাই সমস্যা। এ পদ্ধতি চীনের একক কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। তারাই ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে। এর আগে বিমান ও সড়কের প্রকল্পেও এ ধরনের সমস্যা হয়েছে। ব্যয় বেশি ধরায় চীনের অর্থায়নে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সরে আসতে সরকার বাধ্য হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। একবার এ ফাঁদে পড়লে বাংলাদেশের পক্ষে আর ওঠা সম্ভব হবে না।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান, চীন সরকারের অর্থায়ন প্রকল্পে সে দেশের সরকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনোনয়ন দিয়ে আসছে। মনোনয়ন পাওয়া প্রতিষ্ঠানই প্রকল্প ব্যয় ও নকশা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। ফলে তাদের মতো করে ব্যয় নির্ধারণ করার সুযোগ পায় তারা। কিন্তু একক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে দরপত্রের মাধ্যমে একাধিক দরদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করার সুযোগ চেয়ে চীন সরকারের কাছে আবেদন করেছে ইআরডি। এ বিষয়ে চীন বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সুযোগ রাখা হবে। তবে কেবল নতুন প্রকল্পের জন্য এ নিয়ম কার্যকর করা হবে। যেসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে বাণিজ্য চুক্তি হয়ে গেছে, সেসব প্রকল্পে এ সুযোগ রাখা হবে না। প্রস্তাবিত আখাউড়া-সিলেট প্রকল্পটির জন্য চীন সরকারের মনোনীত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি হয় ২০১৬ সালে। এ অবস্থায় এ প্রকল্পে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হবে না।
গত বৃহস্পতিবার এ প্রকল্পের ডিপিপির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রকল্প ব্যয়সহ অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে পরিকল্পনা কমিশন। জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান মো. এনায়েত হোসেন বলেন, এ প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে হলে রেলওয়েকে বাস্তবসম্মত ব্যয় নির্ধারণসহ কিছু শর্ত মানতে হবে। পিইসি সভায় এসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে। কেবল শর্তপূরণ করে ডিপিপি পুনর্গঠন করা হলেই প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায় উত্থাপন করা হবে।
এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কমলকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রানওয়ের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য মাটির দর প্রাক্কলন করা হয়েছে ঘনমিটারপ্রতি ৪৮৩ টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের চলমান ঈশ্বরদী থেকে পাবনার ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে মাটির দর ৩০৫ টাকা। প্রস্তাবিত প্রকল্পে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বাঁধ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ বাবদ রাখা হয়েছে এবং মাটির একক দর ধরা হয়েছে ঘনমিটার প্রতি ৮৪৩ টাকা। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্পের আওতায় ২০০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ৩৭২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ নির্ধারণ ও ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি সম্পর্কে প্রকল্প প্রস্তাবনায় কিছু বলা হয়নি। এ ছাড়াও ডিপিপিতে ৯৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা পুনর্বাসন ব্যয় রাখা হয়েছে। কিন্তু জমি ও আনুষঙ্গিক ক্ষতিপূরণ বাবদ মালিককে ৩ গুণ অর্থ পরিশোধ করা হয়। এ অবস্থায় পুনর্বাসনে আলাদা বরাদ্দ রাখার যৌক্তিকতা নেই। প্রকল্পে ১৪ জন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ পরামর্শক এবং ৬২ জন স্থানীয় বিশেষজ্ঞ পরামর্শকের সংস্থান রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সিনিয়র পরামর্শকের ক্ষেত্রে ২০ লাখ ১৬ হাজার টাকা এবং স্থানীয়দের জন্য ৪ লাখ টাকা সম্মানী প্রস্তাব করা হয়েছে। পরামর্শকের সংখ্যা এবং ব্যয় নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি জানিয়েছে।
পরামর্শক ও ঠিকাদারকে বিলম্বে অর্থ পরিশোধের জন্য ডি-লে পেমেন্ট হিসাবে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ডিপিপিতে। পরিকল্পনা কমিশন বলছে প্রকল্প শুরুর আগেই ডি-লে পেমেন্টের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রাখা অযৌক্তিক। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় বৈদেশিক সফরে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

http://samakal.com/economics/article/1807433/