৭ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ১০:৪০

অজুহাত শুল্ক বাড়ছে চালের দাম

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে আমদানি করা চালের ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহালের অজুহাতে রাজধানীর কিছু অসৎ ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দামের এই ঊর্ধ্বগতির জন্য এসব কারসাজিকারকদের দায়ী করেছেন ক্রেতাসহ সংশ্লিষ্টরা। আর পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, দেশে 

উৎপাদিত চালের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নেই। ঢাকার বাজারগুলোয় এখন প্রতিকেজি মিনিকেট (সরু) চালের দাম ৬৬ টাকা। প্রতিকেজি নাজিরশাইল চালের দাম ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা।
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার দরের প্রতিবেদনেও দাম বাড়ার এ চিত্র উঠে এসেছে।
জানা গেছে, দেশে এবার রেকর্ড পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়েছে। গত এক বছরে প্রায় ৩৮ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। আরো আমদানির প্রক্রিয়াধীন আছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারেও চালের দাম কমে এসেছে। গত এক মাসে কেজিতে ৪ টাকা দাম কমেছে ভারত ও থাইল্যান্ডের বাজারে। ফলে রাজধানীর বাজারে কমে এসেছিল চালের দাম। কিন্তু হঠাৎ করেই দাম বাড়তির দিকে। বস্তা প্রতি বেড়েছে প্রায় ৫০ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চাল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করায়, সুযোগ নিচ্ছে মিলাররা।

কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে ধান-চাল এখন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এবার বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় দুই কোটি টন। আমনের উৎপাদনও প্রায় দেড় কোটি টন। আর চলতি মাস পর্যন্ত এক বছরে আমদানি করা হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টন চাল। অর্থাৎ দেশে চালের মজুত প্রায় চার কোটি টন, যা চাহিদার চেয়ে বেশি। তারপরও চালের দাম বাড়ছে। এর কোনো সদুত্তর কারও কাছে নেই।
গত বছর দেশে আগাম বন্যা ও হাওরে পানি বাড়ার কারণে ধানের ফলন নষ্ট হয়েছিল। কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সর্বমোট ২৬ লাখ টন ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে সরকার চাল আমদানির মাধ্যমে এ সংকট কাটিয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকার চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে প্রথমে ১০ শতাংশ ও পরবর্তীতে ২ শতাংশ নির্ধারণ করে। চালের আমদানি শুল্ক ছাড়ের এই সুযোগ নিয়ে এ সময় পর্যন্ত দেশে মোট ৫৬ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। অথচ চালের দাম বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন অর্থবছরের বাজেটে আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ পুনর্বহালে আমদানিকারক ও মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া গত ২৬শে জুন বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, কোনো অবস্থাতেই শূন্য মার্জিনে অর্থাৎ বাকিতে চাল আমদানির এলসি (ঋণপত্র) স্থাপন করা যাবে না। চাল আমদানি কঠোর করতেই এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। চাল আমদানি বাড়াতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনা মার্জিনে ঋণপত্র খোলার সুযোগ ছিল। এখন নগদ টাকা নিয়ে ঋণপত্র খুলতে হবে ব্যবসায়ীদের। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সামপ্রতিক সময়ে দেশের আবহাওয়া ধান চাষের অনুকূলে থাকায় চলতি বছর ধানের উৎপাদন সন্তোষজনক হয়েছে। কৃষক ও স্থানীয় উৎপাদকদের ধান/চালের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করাসহ কৃষকদের ধান চাষে উৎসাহ দিতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এসব কারণে কোনো অবস্থায় শূন্য মার্জিনে ঋণপত্র স্থাপন করা যাবে না।
পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের কাছে এখন যে চাল মজুত আছে, তা শূন্য শুল্কের সুযোগ নিয়ে আমদানি করা। এ ছাড়া আমদানি শুল্ক পুনর্বহালের পর এখন পর্যন্ত নতুন করে কোনো চাল আমদানিও হয়নি। শূন্য শুল্কে আমদানি করা যে পরিমাণ চাল মজুদ রয়েছে তা দিয়ে আরো অন্তত ২/৩ মাস বাজারের চাহিদা মেটানো যাবে। তাই এখনই চালের দাম বাড়ার কারণ নেই।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে মিনিকেট, স্বর্ণাসহ প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে ১ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে মোটা স্বর্ণা চালের দাম প্রতিকেজি ৪২ থেকে ৪৫ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৩৮ থেকে ৪২। পাইজাম ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হলেও আগের সপ্তাহে এই চালের দাম ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। মিনিকেট ৬০ থেকে ৬২ টাকা এবং নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকা দরে। গত বছর বন্যার আগে মোটা চালের কেজি ছিল ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা এবং চিকন চালের কেজি ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। বন্যার পর মোটা চালের দাম কমানোর জন্য যে পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে তাতে চালের দাম কিছুটা কমলেও আগের দামে আর ফিরে আসেনি।
টিসিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম ৫ শতাংশ বেড়েছে। গত সপ্তাহে মোটা চালের কেজি ছিল ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। তা ৪০ থেকে ৪৪ টাকায় পৌঁছায়। মাঝারি ও সরু চালের দামও ২ থেকে ৩ শতাংশ বেড়েছে।
পাইকারি আড়তদাররা বলছেন, বাজারে দেশি চালের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। কেবল আমদানি করা চালের উপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের সুযোগ নিচ্ছেন কিছু অসৎ মিল মালিক।
কাওরান বাজারের বি.বাড়িয়া রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী ইকবাল বলেন, আমদানি শুল্ক পুনর্বহালেই চালের দাম বেড়েছে। আমদানিকৃত চালের দাম বাড়ায় দেশীয় মিল মালিকরাও চালের দাম বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, বাজারে এখন চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ ছিল না। বাজারে এখন চালের সরবরাহ ভালো।
আরেক চাল ব্যবসায়ী বলেন, কৃষকদের স্বার্থে সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক পুনর্বহাল করেছে। কিন্তু এর সুবিধা লুটে নিচ্ছে মিল মালিক, আমিদানিকারক ও মধ্যসত্বভোগীরা। কৃষকদের কাছে এখন কোনো ধান নেই। তারা কাটার আগেই মিল মালিকদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব’র সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, কৃষককে সুবিধা দিয়ে চাল উৎপাদন ও সংগ্রহে সরকার সরাসরি তদারকি করলে বাজারে শৃঙ্খলা ফিরবে। চালের দাম নিয়ে কারসাজিকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করারও পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ববাজারে কয়েক সপ্তাহ আগে প্রতিটন চালের দাম ৪৩৫ ডলার বা তার উপরে। কিন্তু এখন তা কমে ৪০০ ডলারে নেমেছে। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন চালের দাম কমেছে ৩৫ ডলার। তবে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশে চালের দাম না কমে উল্টো বেড়ে গেছে। ইউএসডিএর হিসাবে, ভারতে চালের রপ্তানি মূল্য ৪৩০ ডলার থেকে কমতে কমতে ৩৯৪ ডলারে নেমে আসে। সবচেয়ে বড় দরপতন হয়েছে থাইল্যান্ডে। দেশটি প্রতিটন চালের দাম প্রায় ৪০ ডলার কমিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক একেএম লায়েক আলী বলেন, রাজধানী ছাড়া দেশের কোথাও চালের দাম বাড়েনি। চালের দাম বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নাই। যদি চালের দাম কোথাও বেড়ে থাকে তা বেড়েছে রাজধানীতে। আর এর জন্য দায়ী অসৎ ব্যবসায়ীরা। তারা সুযোগ বুঝেই চালের দাম বাড়িয়েছে অনৈতিক মুনাফার জন্য।
বাজার বিশ্লেষকরা জানান, চালের বাজারে সরকারের তদারকি নেই। চালের দাম বাড়লে সোয়া কোটি হতদরিদ্র মানুষ বড় বিপদে পড়বে। ফলে চালের দামে যাতে কোনো কারসাজি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে সরকারকেই। 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=124571&cat=2/-