৩ জুলাই ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৪১

কোটা সংকটের যৌক্তিক সমাধান অপরিহার্য

কোনটা ফেলে কোনটার কথা ভাববো? আমাদের অবস্থা এখন তাই। সেদিন খুলনার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ভয়ভীতি ত্রাস সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনের একশ্রেণির কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ভোট কারচুপি ও ভোট চুরির যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তার বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভ দানা বেধে উঠতে না উঠতেই গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ‘শান্তিপূর্ণ ও ‘নীরব পন্থায়’ আওয়ামী লীগের পক্ষে আরেকটি কারচুপির নির্বাচন খুলনাকে ভুলিয়ে দিল। এবার মানুষ দেখল বিরোধী দলের কোনও নির্বাচনী এজেন্ট নির্বাচন কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারছে না। তাদের অনুপস্থিতিতে পোলিং স্টাফদের সহায়তায় একদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করছে অন্যদিকে ব্যালট পেপার ভর্তি ব্যালট বাক্স দিয়ে কেন্দ্রের কক্ষগুলো ভর্তি করা হচ্ছে। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে দেয়া হচ্ছে না। বলা হচ্ছে তোমরা ফিরে যাও, তোমাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে, ভোটের দরকার নেই। বিক্ষুব্ধ ভোটাররা ওয়ার্মিংআপের সুযোগ পেলেন না। আরেকটি ঘটনা শুরু হয়ে গেল। অবশ্য এই ঘটনার মাধ্যমে শাসক দলের শীর্ষ ব্যক্তিরা তাদের কথা রেখেছেন। ইতোপূর্বে তারা বলেছিলেন যে, সরকার বিরোধী আন্দোলন দমানোর জন্য তাদের আর পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক নিয়োগের প্রয়োজন নেই, ছাত্রলীগই এ জন্য যথেষ্ট। তাই হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্রনেতারা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোটা বিলোপের সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন অতর্কিতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা তাদের ওপর হামলা চালায়। এতে সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম নেতা নূরুল হকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা মারাত্মকভাবে আহত হয়। এই হামলা থেকে তাদের রক্ষা করতে গিয়ে একজন শিক্ষকও আহত হন। অনেকের ধারণা ছিল এই হামলায় সরকারের কোনও সায় ছিল না, নিতান্তই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী অংশ এর সাথে বিচ্ছিন্নভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু তা নয়। একদিকে ছাত্রলীগ বলেছে, কোটা আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই এই ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে পুলিশ ও ডিবি বিভিন্ন এলাকা থেকে আন্দোলন সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের গ্রেফতার করেছে এবং কাউকে কাউকে গুমও করেছে। গত রোববার ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মারমুখী ছাত্রলীগ কোটা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ থেকে পরিস্কার বুঝা যায় যে, সরকারই এদের পেছনে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর কারণ কি?
কয়েক মাস আগে সারা দেশে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় তখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়াকে সাক্ষী রেখে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন যে, সরকারি চাকরিতে কোনও কোটা থাকবে না। তার ঘোষণার পর সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন। এই সব ঘোষণা ও আলাপ আলোচনার প্রেক্ষাপটে আন্দোলনকারীরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে, শীঘ্রই এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে। কিন্তু তা হয়নি। এর অর্থ কি? সরকার প্রধান কি তাদের সাথে প্রতারণা করেছেন? যদি না করে থাকেন তাহলে বার বার কেন প্রজ্ঞাপনের জন্য তাদের আন্দোলন করতে হবে?
সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাংলাদেশে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। মুক্তিযোদ্ধা কোটা, মহিলা কোটা, তফসীলি-উপজাতি কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা, জেলা কোটা ইত্যাদি ইত্যাদি। এক সময় হয়ত এই কোটা দরকার ছিল। কিন্তু বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবেশও পাল্টেছে। এখন আর সব কোটার দরকার নেই বলেই জাতি মনে করে। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৮ বছর এবং অবস্থা এত পাল্টেছে যে, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এখন সব কিছুই আমাদের মেধার ভিত্তিতে বিচার করে কোটা সংষ্কার করা দরকার। এখন প্রতি শ’তে ৫৬টি চাকরিই আমদের কোটা নির্ভর। অর্থাৎ ১০০টি পদের মধ্যে ৪৪টি পদ মেধার জন্য উন্মুক্ত থাকে। অবশ্য কার্যতঃ আরো কম। ফলে জাতি মেধা বঞ্চিত হয়। যুব মাজের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয় এবং জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, হোক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা বাস্তবায়ন, আমাদের মান অবনমিত হয়। কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের নিম্নমানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ১৯৯৬-৯৭ সালে বিশ্ব ব্যাংক ‘Government that works’ শীর্ষক এক রিপোর্টে বাংলাদেশের তৎকালীন কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার অদক্ষতার একটি চিত্র তুলে ধরেছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে তারা Aid negetiatin জানেন না, এমন কি ইংরেজিতে একটি চিঠির মুসাবিদা কীভাবে করতে হয় সে সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই। দাতা সংস্থাগুলোকেই এই খসড়া তৈরি করে দিতে হয়। এটা ছিল অপমানকর মন্তব্য।
এর আরেকটি দিক আছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সত্যিকার অর্থে কখনো কোটার সদ্ব্যবহার হয়নি। কোটা থেকে সুযোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কোটার ছত্রছায়ায় নিয়োগ পেয়েছে দলীয় ক্যাডাররা। এখন তো মেধার কোনো মূল্যই নেই। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মতে যারা মেধাবী তারা বেআদব হয়। সরকারি নেতাদের কথা শুনে না। যারা মেধাবী নয় তারা সরকারের অনুগত হয় এবং জীবন দিয়ে- সরকারকে রক্ষা করে। সরকারের দরকার তাদের যারা চাকরি রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে হলেও সরকারকে রক্ষা করবে। অদ্ভুত যুক্তি! বর্তমান সরকারের আমলে ৫৬ শতাংশ কোটার আড়ালে তারা মেধা তাড়ানোর জন্য আরো কিছু কোটার ব্যবস্থা করেছেন তা হয়ত অনেকেইÑ জানেন না। এখন সরকারি চাকরি পেতে হলে অনেক কিছুই দেখা হয়। যেমন চাকরি প্রার্থী ছাত্র জীবনে কোন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল, তার ভাই, পিতা, চাচা, মামা কোন রাজনৈতিক দল করেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল কিনা ইত্যাদি। এরা যদি ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ অথবা লীগ পন্থী কেউ না হয়ে থাকেন তাহলে তাদের ভাগ্যে চাকরি জুটবে না। হিন্দু হলেও আওয়ামী লীগ হিন্দু হতে হবে।
Nateond sersice এর নামে দেশে বর্তমানে যে আওয়ামী সার্ভিস চালু রয়েছে তার খোঁজ খবর নিন। তাতে দেখা যাবে কোটা কত প্রকার ও কি কি বাংলাদেশে এখন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। লেখাপড়া শিখে, উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ছেলেমেয়েরা চাকরি-বাকরি পাচ্ছে না। এতে তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে, অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে একাধিক আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
আমাদের জাতীয় জীবনে শিশুরা অনাগত, বৃদ্ধেরা গড় আয়ু, যুবকরাই বর্তমান এবং ভবিষ্যতও বটে। এমতাবস্থায় তাদের হতাশার মধ্যে নিক্ষেপ না করে কোটা সংস্কারে তাদের হতাশার মধ্যে নিক্ষেপ না করে কোটা সংস্কারের মাধ্যমে চলমান সংকটের সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি।

 

http://www.dailysangram.com/post/336353-