৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৯

প্রত্যাশা পূরণ হলো না

|| সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা ||

বিদায়ী কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনই যেমন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না, ঠিক তেমনিভাবে তারা দক্ষতা, যোগ্যতা, পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে পারেনি। এমনকি দলবাজি করতে গিয়ে এই কমিশনকে আদালতে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা পর্যন্ত করতে হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এমন অথর্ব ও দলবাজ কমিশন অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি।
বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীব উদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন, বিদায়ী কমিশন যেভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে নতুন কমিশনও সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে; যা জনমনে বেশ হাস্যরস ও কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। কাজী রকীব কমিশনের সফলতার (?) ধারাবাহিকতা যদি বিশ্বের সব দেশের নির্বাচন কমিশন মডেল হিসেবে নেয় তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশেই ক্ষমতার পালাবদলের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। কাউকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রেও যেতে হবে না।
নিরপেক্ষ নতুন কমিশন গঠনে খাজনার চেয়ে বাজনাটায় বোধ হয় বেশি হচ্ছে। বঙ্গভবন সংলাপবিষয়ক যে এলাহি কাণ্ডের আয়োজন করেছে তার ফলাফলটা ইতিবাচক মনে করার আপাত কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আসলে জনগণ বঙ্গভবনের কাছে যে ধরনের দায়িত্বশীল আচরণ আশা করেছিল সার্র্চ গঠনে সে আশার প্রতিফলন ঘটেনি। আর এমনটিই অনুমান করেছিলেন অভিজ্ঞমহল। কারণ রাজনীতি এখনো পুরোপুরি অতীতবৃত্তেই আটকে আছে। তাই সার্চ কমিটি গঠনবিষয়ক যে অপ্রাপ্তি তার জন্য প্রেসিডেন্ট বা বঙ্গভবনকে দায়ী করাটা খুব একটা যৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না। কারণ সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতি দিয়ে সরকার সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলোকে নেশার বড়ি গেলাতে চাইছে। সরকারের এই কর্মযজ্ঞ সফল হয়নি।
মূলত সমস্যাটা অন্যখানে। রাষ্ট্রপতির ওপর যে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে উচ্চাশা পোষণ করা হলো তা কি সঠিক? সংবিধান তো রাষ্ট্রপতিকে কোনো ক্ষমতায় দেয়নি। আমাদের দেশের সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। তাই ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছা ছাড়া রাষ্ট্রপতির পক্ষে নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি বা নির্বাচন গঠন করা শুধু অসম্ভবই নয়, বরং একেবারেই অবাস্তব ছিল। আর প্রেসিডেন্টের পক্ষে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। এমন নজির তো আমাদের দেশেই আছে। সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির তো কোনো কিছু করার নেই, বরং এদিক-সেদিক হলে বঙ্গভবনে বসবাসটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই ইতিবাচক কিছু করতে গেলে সবার আগে সরকারকেই ইতিবাচক হতে হবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, সংবিধানের ১১৮-এর বিধানমতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শুধু ১১৮-এর বিধান মতে একক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন না। তার সংবিধানের ৪৮(৩) এবং ১৯৯৬ সালের রুলস অব বিজনেসের বিধান অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রুলস অব বিজনেসে বলা হয়েছে, ১১৮-এর বিধান অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর মতামত নিতেই হবে।
১৯৯৬ সালের রুলস অব বিজনেস ২০১২ সাল পর্যন্ত সংশোধিত হয়েছিল। এই রুলসের ৭ বিধির অধীনে চতুর্থ তফসিলে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে কী কী বিষয়ে নথি পেশ করতে হবে, সে বিষয়ে একটা ফিরিস্তি দেয়া আছে। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রুলস অব বিজনেসে ৮ক, ৮খ ও ৮গ হিসেবে তিনটি দফা সংযোজন করা হয়েছে। ৮ক তে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ১, ৫ ও ৬ উপদফার আওতায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ, পদত্যাগ এবং চাকরির শর্তাবলি, ৮খ মতে ১১৮ (৫) ও ৯৬(২) অনুচ্ছেদের আওতায় সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ এবং ৮গ মতে সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদের আওতায় নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সরকারি কর্মচারী সরবরাহ করা সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করতে হবে। তাই এসব বিষয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাটা পুরোপুরিই আলঙ্কারিক।
অতীতে দলীয় সম্পৃক্ততার অভিযোগে বিচারপতি কে এম হাসানকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মেনে নিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। তখনো কিন্তু তদানীন্তন সরকার এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। কিন্তু ১/১১ মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঠেকানো সম্ভব হয়নি। যার প্রায়শ্চিত্তটা এখনো আমাদের করতে হচ্ছে। আর তা কত দিন করতে হবে তার সময়সীমা বেঁধে দেয়া বেশ কষ্টসাধ্যই বলতে হবে।
মূলত ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে আগাছা মনে করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আর এই কথিত আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়েই আমাদের দেশের সুস্থধারার রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার একটি উদগ্র বাসনায় আমাদের দেশের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ করেছে। আমাদের দেশের রাজনীতিকে আর গণমুখী বলার সুযোগ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না, বরং এখন তা জীবন বাঁচার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। আর এর প্রমাণ মেলে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রীর আত্মস্বীকৃতি থেকে। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ক্ষমতা হারালে বাঁচতে পারবেন না। তাই যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে হবে।
নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়েছিল। এমনকি সংলাপে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোও উচ্চাশা পোষণ করেছিল। কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা করতে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করতে চেয়েছেন ঢাকায় কর্মরত পশ্চিমা কূটনীতিকেরা। তারা জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বে ইসি গঠনে আইন চান। পশ্চিমা দূতাবাসগুলোর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। কূটনীতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসার আগে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন কূটনীতিকেরা। এরই মধ্যে এ নিয়ে রাষ্ট্রপতির সময় চেয়ে চিঠিও দেয়া হয়। সেখানে ইসি পুনর্গঠন নিয়ে তারা আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। সে সময় কূটনীতিকেরা একত্রে বসে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠনে আলোচনার জন্য তিনটি বিষয় ঠিক করেন। তবে এখন পর্যন্ত তারা রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতের সময় পাননি।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে উদ্বিগ্ন পশ্চিমা কূটনীতিকেরা। বাংলাদেশে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চান তারা। এ কারণে জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করে নির্বাচন নিয়ে নিজেদের মতামতগুলো তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। নতুন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত হওয়ার পর এ ধরনের বৈঠকের আবেদন নিঃশেষ হয়ে গেলেও আগামী দিনের জন্য নির্বাচন সহায়ক সরকার নতুন ইস্যু হতে পারে।
smmjoy@gmail.com
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/194003