১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, সোমবার, ১০:২৩

ট্যানারি মালিকরা ১৮ দফায় ১৩ বছর কাটিয়েছে

৮ দফায় ১৩ বছর কাটিয়েছে হাজারিবাগের ট্যানারি মালিকরা। সরকার আর পরিবেশ সংগঠনগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে এসব ট্যানারি মালিক। সর্বশেষ ১ ফেব্রুয়ারি থেকে হাজারিবাগে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত নিষিদ্ধ হলেও তা পুরোপুরি মানছে না সিংহভাগ ট্যানারি মালিক। এখনো সেখানে ঢুকছে কাঁচা চামড়া। ফলে ১ এপ্রিল সব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরিত হওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন শঙ্কা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন কাঁচা চামড়া ওয়েট ব্লুর নামে চলছে নতুন ষড়যন্ত্র।
অনেক প্রতিষ্ঠান নিষেধ অমান্য করে তৈরি করছে ওয়েট ব্লু। তবে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সরকারের নির্দেশ মেনে কাঁচা চামড়া ঢোকানো বন্ধে চেষ্টা করছেন তারা। তাদের পাশে রয়েছে পুলিশ, ডিবি, এসবি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতি নিয়ত হাজারিবাগে প্রবেশ করছে কাচা চামড়া। তাহলে এর সাথে কারা জড়িত। কাদের ইন্ধনে প্রবেশ করছে কাঁচা চামড়া। তবে ট্যানারি এসোসিয়েশন আশাবাদী বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই সাভারে স্থানান্তর হবে।
একের পর আল্টিমেটাম। সরকারের কঠোর হুশিয়ারি। সব শেষ সিদ্ধান্ত, ১ ফেব্রুয়ারির পর হাজারিবাগে আর ঢুকবে না কাঁচা চামড়া। বন্ধ থাকবে ওয়েট ব্লু প্রক্রিয়াজাত করাও।
এত কিছুতেও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। হাজারিবাগে এখনো কাঁচা চামড়া ঢুকছে। বেশ কয়েকটি ট্যানারিতে চলছে ওয়েট ব্লু প্রক্রিয়ার কাজ। অনেক ট্যানারিতে মজুদ আছে প্রচুর কাঁচা চামড়া। তবে চামড়া ঢোকা বন্ধে নেই তেমন কোনো পদক্ষেপ। দেখা যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো উপস্থিতিও। যদি সরকার পক্ষের দাবি রয়েছে সব ধরনের প্রশাসন। রয়েছে সাদা পোষাকের পুলিশও। কোনোভাবেই কাঁচা চামড়া প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বলছে, সরকারের নির্দেশের পর কাঁচা চামড়া না ঢোকাতে সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। তবে সরকারের বেঁধে সময় আগামী পহেলা এপ্রিল থেকে সবগুলো ট্যানারির সাভারে স্থানান্তর কতটা বাস্তবায়ন হবে এ ব্যাপারে সন্দিহান তারা।
এছাড়া পুরোপুরিভাবে সাভারে কার্যক্রম শুরু করতে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের কাজ শেষ করা এবং জমি ট্যানারি মালিকদের বুঝিয়ে দেয়ারও দাবি জানান তারা।
জানা গেছে, ট্যানারি স্থানান্তরে ১৩ বছরে ১৮ দফা সময় নিয়েছে ট্যানারি মালিকরা। তাদের অভিযোগ প্লট বরাদ্দপত্র এখনও বুঝে পায়নি। গ্যাস সংযোগসহ সাভারে চামড়া শিল্প নগরীর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি শেষ না হওয়ায় এ সময় লাগবে। সরকার যদি অযৌক্তিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে তাহলে এ শিল্পের অনেক ক্ষতি হবে। তাদের এসব দাবি অতীত। তাদের সব দাবি পূরন করা হয়েছে। তার পরেই হাজারি বাগে কাঁচা চামড়া প্রবেশ বন্ধ করেছে সরকার ও ট্যানারি মালিকদের সংগঠন। কিন্তু তাদের সেই উদ্যোগও ভেস্তে যেতে বসেছে।
তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, ১ এপ্রিলের পর হাজারিবাগের ট্যানারি বন্ধ হয়ে যাবে। তা না হলে এ শিল্পের প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারাবে। তাদের ১৮ দফায় সময় দেয়া হয়েছে। কারখানা স্থানান্তরের জন্য ক্ষতি পূরণও দেয়া হয়েছে।
হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নিতে একনেকে প্রকল্প পাস হয় ২০০৩ সালে। ১৩ বছরে দফায় আল্টিমেটাম দিয়েছে সরকার। নানা অজুহাতে সময় নিয়েছে কালক্ষেপণ করেছে ট্যানারি মালিকরা। মালিকরাও বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু একটি ট্যানারিও পুরোপুরি সাভারে সরিয়ে নেয়া হয়নি। সবশেষ এ মাসের মধ্যেই সব ট্যানারি সরিয়ে নিতে একমত হয় উভয়পক্ষ।
সরেজমিন দেখা গেছে, সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে কোনো কারখানার অবকাঠামো তৈরি শেষ হয়েছে। অধিকাংশ কারখানার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের প্লট বরাদ্দের কাগজপত্র বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে আবার প্লটের দলিল মরগেজ রেখে ব্যাংক থেকে ঋণও নিয়েছেন। এছাড়া গ্যাস সংযোগও পেয়েছে অনেকে।
তারা বলছেন, প্রতিদিন এখানে ১ লাখ ২৫ হাজার ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হয়। সব কারখানা চালু হলে গ্যাসের চাহিদা হবে ৬ লাখ ঘনফুট। এ পরিমাণ গ্যাস দেয়ার ক্ষমতা নেই সরকারের।
প্রকল্প পরিচালক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, প্রকল্পের সব কাজ শেষ। তারা ইচ্ছে করলে এখনই বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু তারা কেন এখানে কারখানা স্থানান্তর করছে তা আমার বুঝে আসছে না। গ্যাস লাইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি বিসিকের অধীনে নয়। তারপরেও আমি জানি তারা যে শর্তে গ্যাস চাচ্ছে সব শর্র্ত মেনেই চাহিদামাফিক গ্যাস দেয়া হচ্ছে। গ্যাসের কোনো সংকট নেই।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ লাভ-ক্ষতির হিসাব মেলাতে গিয়ে অনেক মালিক ট্যানারি সরাতে চায় না। দায় আছে সরকারেরও।
সাভারে বর্জ্য শোধন ঠিকভাবে করা হচ্ছে কিনা তাও তদন্ত করার দাবি জানিয়ে পরিবেশ আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এই বিলম্বের পিছনের সরকার এবং মালিক পক্ষে সায় রয়েছে। হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরে মালিকরা এখনও লাভ-লোকসানের চিন্তা-ভাবনা করছেন। যতদিন তারা এখানে থাকতে পারেন ততই তাদের লাভ।
তিনি আরও বলেন তাদের ১৮ দফায় ১৩ বছর সময় দেয়া হয়েছে। সরকার বলছে, সাভারে কারাখানা স্থানান্তরে কোনো বাধা নেই। সব উন্নয়ন কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ১ এপ্রিলের পর থেকে হাজারিবাগে আর ট্যানারি থাকতে পারবে না।
সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে কারখানা স্থানান্তরে গড়িমসি করায় পরিবেশ দূষণ অব্যাহত থাকায় গত বছরের ১৬ জুন হাজারিবাগের ১৫৪টি ট্যানারি কারখানাকে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন হাইকোর্ট। পরে কারখানা মালিকদের আপিল আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৮ জুলাই কারখানাপ্রতি দৈনিক ১০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন আদালত। এরপর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে কারখানা মালিকদের কাছে লিখিত নির্দেশ যাওয়ার পর গত ১১ আগস্ট থেকে শিল্প সচিব বরাবর সোনালী ব্যাংক- শিল্প মন্ত্রণালয় শাখার মাধ্যমে জরিমানা দেয়া শুরু করেন ট্যানারি মালিকরা।
গত ছয় মাসে কয়েক কোটি টাকা জরিমানা জমা হয়েছে। শিল্প সচিব বলছেন, জরিমানাই শেষ কথা নয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হাজারিবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর করতে হবে। সর্বশেষ এ বছর ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় নেয় শিল্প মালিকরা। কাচা চামড়া প্রবেশে নিষেজ্ঞা চলছে। যাদের কাঁচা চামড়া রয়েছে তারা শুধু ব্লুর কাজ করছে। তবে কাঁচা চামড়া প্রবেশের অভিযোগ আমাদের কাছেও রয়েছে।
ঢাকা জেলা কাঁচা চামড়া সমিতির সেক্রেটারি রবিউল আলম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ওয়েট ব্লুর নামে ট্যানারি মালিকরা নতুন করে ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, হাজারিবাগের ট্যানারিগুলোতে যে পরিমাণ কাঁচা চামড়া রয়েছে তা ওয়েট ব্লু করতে আরও এক বছর সময় লাগবে। এর মধ্যে এখনও গোপনে প্রবেশ করছে কাঁচা চামড়া। তাহলে কিভাবে ১ এপ্রিল সব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরিত হবে আমার বুঝে আসে না। এটি তাদের নতুন ষড়যন্ত্র।
তবে ট্যানার এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, কাঁচা চামড়া প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। দু’একজন প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কাঁচা চামড়া প্রবেশ করাচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না ১ এপ্রিল থেকে হাজারিবাগে আর ট্যানারি থাকবে না।
http://www.dailysangram.com/post/271592-%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E0%A7%A7%E0%A7%AE-%E0%A6%A6%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A7%A7%E0%A7%A9-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A7%9F