৩ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৯:৩১

ফের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা চলছে

কোন কারণ ছাড়াই বাড়ছে গ্যাসের দাম। তিতাসসহ দেশীয় কোম্পানিগুলোর দাম বৃদ্ধির পর এবার প্রথমবারের মত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিকে কেন্দ্র করে আরেক দফা গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। এতে করে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।

পেট্রোবাংলা কর্মকর্তারা মনে করছেন, দেশে উৎপাদিত গ্যাস স্থানীয় বাজারে এখন যে দামে বিক্রি হচ্ছে, এলএনজি আমদানির পর তা প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে হবে। এই ধারণার ভিত্তিতে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার পর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনও (বিইআরসি) কাজ শুরু করেছে।

জানা গেছে, দেশে গ্যাস সংকটের অজুহাতে গত কয়েক বছর যাবত আবাসিক সংযোগ বন্ধ রয়েছে। এতে করে বাধ্য হয়ে এলএনজি গ্যাস ব্যবহার করছে ভোক্তারা। ফলে সারা দেশে ব্যাপকহারে এর চাহিদা বেড়ে গেছে। আবাসিক গ্যাসের দাম কয়েক দফা বৃদ্ধি পেলেও এখনও এলএনজি গ্যাসের দাম বেশি। গ্যাসের দামের এই পার্থক্য কমাতে এবার এলএনজি গ্যাসের আমদানি মূল্যের বৃদ্ধি অজুহাতে দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে।
মূলত গ্যাসের বাজার এলএনজি হাতে তুলে দিতেই সরকার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে আসলে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোন যৌক্তিক কারণ নেই। সরকার আসলে কি কারণে এই মুহূর্তে গ্যাস দাম বৃদ্ধির চিন্তা ভাবনা করছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। এতে করে ভোক্তার ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি হবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আসলে দাম বৃদ্ধির কারণ হলো এ খাতে যাতে এলএনজির আমদানিকারকরা বাজার দখল করতে পারে এ কারণেই দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সরকার জনগণের পক্ষ না নিয়ে আমদানিকারকদের পক্ষ নিচ্ছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও গ্যাসের দাম বাড়ানোর আভাস দিয়েছেন। শুক্রবার বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, এলএনজি এলে বিদ্যুৎসহ শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগে মূল্য সমন্বয় করতে হবে।
অবশ্য আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রেও দাম বাড়ানো হবে কি না- তা স্পষ্ট করেননি প্রতিমন্ত্রী। কবে থেকে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে, সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি বলতে পারি, এটা কমফোর্ট থাকা উচিৎ। শুনানি শেষে বিইআরসি এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
গতবছর ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়। মার্চ ও জুলাই থেকে দুই ধাপে তা বাস্তবায়িত হয়। এক বছরের মাথায় নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তোড়জোড়ের মূল কারণ এলএনজি আমদানি।

যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি কক্সবাজারের মহেশখালিতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসায় এপ্রিলের শেষ অথবা মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই এলএনজি আমদানি শুরু করা যাবে বলে সরকার আশা করছে।
ওই এলএনজি টার্মিনাল থেকে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট (১৪ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ঘনমিটার) গ্যাস সঞ্চালন লাইনে দেয়া যাবে। এলএনজি আমদানির বিষয়টি এগিয়ে আসায় গ্যাসের দাম নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো।
সম্প্রতি পেট্রোবাংলা থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ারম্যানকে জানানো হয়, এলএনজি আমদানির পর প্রতি ঘনমিটার গ্যাস (প্রাক্কলিত) গড়ে ১৩ টাকার কমে বিক্রি করা সম্ভব হবে না।

বর্তমানে পেট্রোবাংলার প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় মূল্য হার সাত টাকা ৩৫ পয়সা। গত বছর দাম বাড়ানোর পর বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৩ টাকা ১৬ পয়সা, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ৯ টাকা ৬২ পয়সা, সার কারখানায় ২ টাকা ৭১ পয়সা, শিল্পে ৭ টাকা ৭৬ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১৭ টাকা ৪০ পয়সায় দরে বিক্রি করা হচ্ছে। আর আবাসিক সংযোগে এক চুলার জন্য মাসে ৯০০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৯৫০ টাকা করে দিতে হচ্ছে।
গ্যাসের দাম আবারও বাড়ানো হলে নির্বাচনের বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও এক দফা বাড়বে। তবে তা যেন জনজীবনে বড় কোনো চাপ তৈরি না করে, সরকার সেদিকে নজর দেবে বলে আশ্বস্ত করেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি বলেন, আমরা এ বিষয় নিয়ে গত একবছর ধরে পরিকল্পনা করছিলাম। স্টেকহোল্ডার যারা এই গ্যাস কিনবেন ও ব্যবহার করবেন, তাদের সাথে আমরা বসেছি। প্রচুর হিসাব-নিকাশ, গবেষণা ও অনুসন্ধান করেছি। গ্যাসের দাম বাড়লেও সেটা জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে শকিং হবে না।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশে যেসব ডুয়েল ফুয়েল (দুই ধরনের জ্বালানিতে চালানো যায়) বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সেগুলো গ্যাসের অভাবে তেল দিয়ে চালানো হচ্ছে। এলএনজি এলে সেখানে তেলের বদলে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানো যাবে।
তখন এটা তেলের থেকে কম খরচ পড়বে। তেলে যে দামটা পড়ত, গ্যাসে চালালে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে না। পেট্রোবাংলার হিসাবে, বৃহস্পতিবার দেশে ২ হাজার ৬৬৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের পরও ঘাটতি ছিল এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি।
এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১ হাজার ৮৪১ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৯১৭ মিলিয়ন ঘনফুট এবং সার কারখানায় ৩১৬ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে ৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা গেছে।
সরকারের পরিকল্পনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎ উৎপাদনে যদি গ্যাস দিতে পারে, তাহলে খরচ বাঁচবে সন্দেহ নেই। কারণ তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেক খরচ পড়ে যায়।

কিন্তু গ্যাস মূলত দিতে হবে শিল্পে। আমি যতটুকু শুনেছি, চট্টগ্রামে শিল্পে প্রায় দ্বিগুণ দাম প্রস্তাব করা হচ্ছে।
শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ প্রসঙ্গে নসরুল হামিদ বলেন, তাদের ওখানে কতটুকু প্রভাব পড়বে সেটাও আমরা গবেষণা করেছি। বাজার অস্থিতিশীল হবে না, সহনীয় পর্যায়েই থাকবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, গ্যাস না থাকার যে মূল্য, সেটা অনেক বড়। তারা যদি উৎপাদন বাড়াতে পারে এবং এটা যদি সমন্বয় করতে পারে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ যদি তারা পায়, তাহলে ব্যবসার উন্নতি হবে বলে আমি মনে করি। তখন এই খরচ মিনিমাম হয়ে যাবে।
পেট্রোবাংলার হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকিতে গ্যাস বিক্রি করে ৩৬২১ কোটি টাকা এবং সার উৎপাদনে গ্যাস বিক্রি করে ৫১১ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে করপোরেশনের।
গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আগামী এপ্রিল থেকে যদি প্রতি ঘনমিটার ১৩ টাকা দরেও বিক্রি করা হয়, তারপরও তাদের লোকসান বাড়বে বলে কর্মকর্তাদের ভাষ্য।

http://www.dailysangram.com/post/321075