৩ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৯:২৭

কাজীর গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : গত ২৭ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার ইত্তেফাকের ভেতরের পাতায় প্রকাশ, ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের তামাকক্ষেতের ৪ কলামজুড়ে একটি ঢাউস ছবিসহ রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে ধান, গম, ভুট্টা বাদ দিয়ে তামাকচাষে চাষিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। তামাক কোম্পানিগুলো চাষিদের দাদন দিচ্ছে। তামাকচাষের প্রভাবে এলাকায় মানুষের যেমন রোগবালাই বাড়ছে, তেমনই এলাকায় গবাদিপশু মারা যাচ্ছে। রিপোর্টটি উদ্বেগজনক বৈকি।

কাজীর গরু যেমন কিতাবে থাকে কিন্তু গোয়ালে তার খোঁজ মেলে না। আমাদের তামাকনিয়ন্ত্রণ আইনটির অবস্থাও ঠিক তেমনই। এ আইন কেন এবং কার জন্য করা হয়েছে তার খোঁজখবর নেই বললেই চলে। আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত ঘোষণা করবার কথা থাকলেও এ সংক্রান্ত আইন ও তার প্রয়োগের মধ্যে কোনও মিল খুঁজে পাননি গবেষকরা। বাংলাদেশে তামাকনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শক্তিশালী করতে চাইলে খুচরা সিগারেট বিক্রি বন্ধ করতে হবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। কিছুদিন আগে রাজধানীর এক হোটেলে ‘তামাকনিয়ন্ত্রণ বিষয়ক গবেষণার তথ্য প্রকাশ’ অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন। বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রামস এবং আমেরিকার জন হপকিনস বুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ যৌথভাবে এ গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এতে মোট ৫টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। গবেষকরা বলেন, তামাক ক্রয় ও বিক্রয়ে শিশুদের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবত তার কোনও প্রমাণ মেলেনি। এমনকি ৮৬ শতাংশ মানুষের এ সম্পর্কে নেই ন্যূনতম ধারণাও। প্রকাশ্যে তামাকসেবন নিষিদ্ধ হলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ ব্যাপারে কোনও সতর্কতা নেই।

আলোচ্য অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেনসহ উপস্থিত সবাই ধূমপান ও এর উপকরণাদির প্রাচুর্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি প্রফেসর ডা. ব্রিগেডিয়ার (অব) আবদুল মালিক, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য ও বিশ্বস্বাস্থ্য) রোকসানা কাদের, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভিসি ড. এম শমশের আলী, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ডা. বর্ধন জং রানা, ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল টোবাকো কন্ট্রোলের রিসার্চ প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. নাসিব কিবরিয়াসহ আরও অনেকে। অনুষ্ঠানের অতিথি, গবেষক ও আয়োজকদের সকলেই এদেশের তামাকনিয়ন্ত্রণ আইন এবং এর কার্যকরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিশেষত শিশুকিশোরদের তামাকসেবন ও তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানান।

তামাকচাষ এখনও দিব্যি চলছে। বিশেষত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে এর চাষ বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য ব্যাংকঋণও দেয়া হয় বলে প্রকাশ। এর পেছনে বিড়ি-সিগারেট কোম্পানিগুলোর হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তামাকনিয়ন্ত্রণ আইন কেউ মানছেন না। অব্যাহতভাবে তামাকচাষের ফলে আবাদি জমির যেমন স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই পরিবেশেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
তামাকসেবন কেবল বিড়ি-সিগারেটের মাধ্যমেই হয় না। আরও নানাভাবে তামাকসেবন চলে। যেমন: খৈনি বা সাদাপাতা, জর্দা, গুল। এগুলোর গ্রহণকে হয়তো অনেক ধূমপান বলতে চান না। কিন্তু আসলে এগুলো ধূমপানের চাইতেও মারাত্মক বলা যায়। কারণ ধূমপানে তামাক জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে কেবল ধোঁয়া নেয়া হয়। আর খৈনি, জর্দা, গুল, সাদাপাতা সরাসরি খায় মানুষ। তবে হ্যাঁ, এসব যারা খায় তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ধূমপায়ীরা নিজের সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে যারা থাকেন তাদেরও বারোটা বাজায়।
গ্রামের মানুষ এখনও হুঁকো টানে। অর্থাৎ ধুমসে তামাক সেবন করে আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। এই নির্বোধ মানুষেরা মনে করে তারা তামাক খায়। আসলে কিন্তু তা নয়। তামাকই তাদের খায়। ধীরে ধীরে নানাবিধ অসুখ তামাকখোরের দেহে বাসা বাঁধে। কাশি, হাঁপানি, যক্ষ্মা এসব রোগ হয়। এমনকি মারণব্যধি ক্যান্সার পর্যন্ত পাকড়াও করে ধূমপায়ীকে। ফলে যার ৮০/৯০ বছর অনায়াসে বাঁঁচবার কথা, সে লোক হঠাৎ চলে যায় কাউকে না জানিয়েই। এমন দুর্বিষহ পরিণতির নির্মম শিকার হয়েও বাঙালি তামাক ছাড়তে চায় না। বউ-ঝিরা পর্যন্ত জর্দা, দোকতা, গুল, খৈনি প্রভৃতিতে ডুবে থাকে।

তামাক এমনই একটি উদ্ভিদ যে, কোনও পশুপাখি একে স্পর্শ করে না। জাবপোকা ব্যতীত আর কোনও কীটপতঙ্গ তামাকগাছে দেখা যায় না। তামাকক্ষেতের আশপাশ দিয়ে হাঁটলে তীব্র ঝাঁঝযুক্ত গন্ধ পাওয়া যায়। আশপাশের কোনও ফসল ভালো হয় না। আমি একবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার চরাঞ্চলে আমার শ্বশুরবাড়িতে ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর অঞ্চলের জনপ্রিয় নাফাশাক বপন করি। শাক হয়ও চমৎকার। কিন্তু শাক রান্নার পর দেখা গেল বেশ তেতো এবং বিস্বাদময়। পরে আবিষ্কার হলো, পাশেই ছিল তামাকক্ষেত। এরই প্রভাবে নাফাশাকের দফারফা অর্থাৎ বিষাক্ত হয়ে গেছে। তামাক এমনই একটি বিষময় এবং ক্ষতিকর উদ্ভিদ। এই তামাক দিয়ে প্রস্তুত হয় বিড়ি-সিগারেট, জর্দা, গুল ইত্যাদি। আর এসব তৃপ্তিসহকারে একশ্রেণির আদম সেবন করে।
তামাকসেবন হচ্ছে মাদকসেবনের সূতিকাগার। যারা তামাকসেবন করে তারাই সহজে মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তামাকের নেশাই অনেককে ইয়াবার মতো মাদকের দিকে টেনে নেয়। তামাক কেবল জনস্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি এমন নয়। এর নেশা যেমন তারুণ্য ধ্বংস করে, তেমনই পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। তামাকের ধোঁয়া যে সেবন করে কেবল তারই ক্ষতি করে না। আশপাশে যারা থাকে তাদেরও বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। ধীরে ধীরে তামাকখোররা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। নেশার পেছনে অর্থ ঢালতে ঢালতে অনেকের আর্থিক মেরুদ- ভেঙে যায়। মাদকদ্রব্যের যে দাপট এখন দেশময়, এর মূলে কিন্তু তামাক। তাই যে করেই হোক, তামাকের নেশা প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলে এর বড়রকম খেসারত দিতে হবে আমাদের। তামাক কেবল আসক্তদেরই পঙ্গু করে না। যে জমিতে এর চাষ হয় তার উর্বরতাও হ্রাস পায়। এমনকি তামাকের জমিতে পরে অন্য কোনও ফসল উৎপাদন করলেও তার খারাপ প্রভাব থেকে যায় বহুদিন। তাই এদেশ থেকে তামাক নির্মূলের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

যানবাহন, হাটবাজার, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, স্কুলকলেজে প্রকাশ্যে তামাকসেবন বা ধূমপান আইনত নিষিদ্ধ। এ আইন অমান্য করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অর্থদ- করবার কথা। কিন্তু যারা এ আইন কার্যকর করবেন তাদেরই একটি বৃহৎ অংশ প্রকাশ্যে ধূমপান করেন। উল্লেখ্য, যানবাহন, হাসপাতাল ইত্যাদিতে সাধারণ মানুষ এখন আর ধূমপান করে না বললেই চলে। তবে বাসের ড্রাইভার, হেলপারদের প্রায় সবাই একাজটা এখনও দিব্যি চালিয়ে যায়। কেন? এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অসুবিধে কোথায়? এজন্যই বলা হয় ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে কিন্তু গোয়ালে নেই।’ আমরা গরু যেমন কিতাবে দেখতে পাই, তেমনই গোয়ালেও এর অস্তিত্ব চাই। আইন থাকবে অথচ কেউ মানবে না তা হয় না। হতে পারে না। বিষয়টি ভেবে সংশ্লিষ্টদের এখনই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

 

http://www.dailysangram.com/post/321073