৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:৪৭

প্রশ্নফাঁস : চলিতেছে সার্কাস

সহজ কথা

‘এ পরীক্ষা নিরাপদ রাখতে মানুষের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, এবার তাই করা হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস করলে কেউ রেহাই পাবে না। কী হবে আমি নিজেও বলতে পারি না। তবে চরম ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ Ñ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ
এসএসসি ও সমমানের ২০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীর পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শেষ করে শিক্ষার্থীরা জানতে পারছে, পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই অনেকের হাতে প্রশ্ন চলে গেছে। পরীক্ষার আগে এখন ফেসবুকের মেসেঞ্জার, ভাইবার ও ইমোতে প্রশ্ন ‘ঘোরাফেরা’ করে। মাত্র ৩০০ টাকা কিংবা ১৫০ টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো প্রশ্ন বিক্রেতা প্রথম পরীক্ষার প্রশ্ন ফ্রি দিয়ে বলেছেন, টাকা দিলে পরের পরীক্ষার প্রশ্ন দেয়া হবে।

এভাবে প্রশ্নফাঁস যে এবার প্রথম হচ্ছে তা নয়। এসএসসি, এইচএসসি এমনকি প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষার প্রশ্ন পর্যন্ত এর আগে ফাঁস হয়েছে। শুরুতে মন্ত্রীর যে কঠোর হুঁশিয়ারি আমরা তুলে ধরেছি, সেটি এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে তিনি দিয়েছিলেন। মন্ত্রীর বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারের সাথে প্রশ্নফাঁস হওয়ার খবরও প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি হুবহু তুলে ধরা হয়েছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। প্রশ্নফাঁসের এ খবর প্রথমে সরকারের কর্মকর্তারা অস্বীকার করেছেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো প্রমাণ বা নমুনা পাইনি। আমাদের পরীক্ষার্থীরা সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে পরীক্ষার হলে ঢুকে গেছে। তারাও কোনো প্রশ্নপত্র দেখেনি। নিজেরাও অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান করে দেখেছি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’ কিন্তু এ অবস্থানের ওপর খোদ শিক্ষামন্ত্রী আর অনড় থাকতে পারেননি। কারণ, পরের পরীক্ষাগুলোর প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।

এরপর মন্ত্রী প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অনেকটা কবুল করে জরুরি বৈঠকে বসে কিছু সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। তিনি পরীক্ষার আগে বলেছিলেন, প্রশ্ন ফাঁস হলে নতুন করে পরীক্ষা নেয়া হবে। পরবর্তী সময়ে জরুরি বৈঠক করে তিনি জানান, চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করতে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সাথে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িতদের ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত কিংবা যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ছড়ায় তাদের ধরিয়ে দিতে এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।

এখানে উদ্বেগের বিষয় হলো, যারা গুজব ছড়াবে তাদের ধরিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখন প্রশ্নফাঁসের খবর প্রকাশ কিংবা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন প্রকাশ করার কারণে কাউকে আবার হেনস্তা হতে হয় কি না তা দেখার বিষয়। এমনকি ভবিষ্যৎ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাও তাদের ওপর প্রয়োগ করা হতে পারে। বলা হয়েছে, পুরো পরীক্ষার সময় এ কমিটি বিশেষ তদারকি করবে। একই সাথে প্রশ্নপত্র আদৌ ফাঁস হয়েছে কি না, এ কমিটি প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করে পরীক্ষা বাতিলের বিষয়ে সুপারিশ করবে।
শিক্ষামন্ত্রী আগে যে ঘোষণা দিয়েছিলেনÑ ‘পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হলে আবার পরীক্ষা নেয়া হবে’, তা এখন এই কমিটির সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আবার কমিটি যদি রিপোর্ট দেয়Ñ প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, তাহলে তো কোনো কথাই চলবে না; বরং প্রশ্নফাঁসের গুজব ছড়ানোর জন্য হয়তো গণমাধ্যমকেই উল্টো দায়ী করা হবে।
মন্ত্রী বলেছেন, এবার প্রশ্নফাঁস রোধে অনেক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ডিজিটাল চোরেরা প্রশ্নফাঁসরোধী এসব অ্যানালগ ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে যথাসময়ে প্রশ্নপত্র নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে হাজির হয়েছে।

মন্ত্রী-এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষার জন্য সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। ঘুষ, দুর্নীতি বা অনিয়মের কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করা কিংবা দুর্নীতির কোনো তথ্যের ভিডিও ধারণকে গুপ্তচরবৃত্তির মতো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে আইন প্রণয়নে সম্মতি দিয়েছেন মন্ত্রীরা। কিন্তু যারা প্রশ্ন ফাঁস করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তাদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারছেন না। বিরোধী দলের কোনো নেতাকর্মী সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দিলে তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা হচ্ছে। টেলিফোনে কললিস্ট দেখে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘অসামান্য দক্ষতা’ দেখাতে পারছে; কিন্তু প্রশ্নফাঁসকারীদের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারছে না।

দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অপরাধ দমনে, উগ্রপন্থীদের দমনে এত সাফল্য দেখাচ্ছে; অথচ প্রশ্নফাঁস করার সাথে একটি চক্রকে কেন ধরতে পারছে না তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এর প্রধান কারণ হতে পারে, সর্ষের ভেতর ভূত রয়েছে। বছরের পর বছর পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হওয়ার দায় এককভাবে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। যারা প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত, তারা ক্ষমতা বলয়ের খুব কাছাকাছি যে অবস্থান করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন মন্ত্রী ‘চরম ব্যবস্থা’ নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, অথচ মাসখানেক আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘প্রশ্নফাঁস নতুন কিছু নয়। একষট্টি সালেও প্রশ্নফাঁস হতো।’ প্রশ্নফাঁস যেন সার্কাসের মতো একটি মজার বিনোদনমূলক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর ভয়াবহ পরিণতির দিকটি কোনোভাবেই বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎকেই অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাবে। তারা মনে করবেÑ লেখাপড়া করে লাভ কী? পরীক্ষার আগেই তো প্রশ্ন পাওয়া যায়। তা দিয়ে পরীক্ষা দিলেই তো ভালো ফল মিলবে।’ প্রতিটি পরীক্ষায় এভাবে প্রশ্নফাঁসের কারণে অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ছে।

আসলে প্রশ্নফাঁসের সাথে বড় ধরনের আর্থিক সংযোগ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা প্রশ্নফাঁস করছে, তারা বলে দিচ্ছে প্রশ্ন পাওয়ার বিনিময়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা কিভাবে টাকা পাঠাবেন। এই দুর্নীতির সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়গুলোর একটি হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রী নিজে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের এর আগে ‘সহনীয়’ মাত্রায় ঘুষ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বলেছিলেনÑ শুধু কর্মকর্তারাই ঘুষ খান না, মন্ত্রীরাও দুর্নীতি করেন। মন্ত্রীরা চোর, আমিও চোর।

মন্ত্রী নিজে যেখানে ঘুষ-দুর্নীতি করার এমন স্বীকৃতি দিতে পারেন, সেই মন্ত্রণালয়ে প্রশ্নফাঁসের বিনিময়ে টাকা আদায় করা মামুলি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। মাত্র কয়েক দিন আগে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতার হয়েছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘুষ, দুর্নীতি ও প্রশ্নফাঁসের মতো বড় ধরনের কেলেঙ্কারির পরও শিক্ষামন্ত্রীকে ‘সফল ও ক্লিন’ ইমেজের মন্ত্রী হিসেবে গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয়। অতীতে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে শীর্ষ পর্যায়ে সংশ্লিষ্টতার কারণে গণমাধ্যমের বাম কর্মীরা তাকে একজন ‘সফল ব্যক্তি’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে আসছেন। সরকারের আর কোনো মন্ত্রী তার মতো প্রচার পাননি। তার কথিত সাফল্যের গল্পের সাথে প্রশ্নফাঁস, ঘুষ আর চুরির কাহিনী শুনতে শুনতে মানুষ এখন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। দেশে যখন তার ইমেজ আর রক্ষা করা যাচ্ছে না, তখন ভারতের একটি সংস্থা তার মর্যাদা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। গত নভেম্বরে শিক্ষামন্ত্রীকে মুম্বাই ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড এডুকেশন কংগ্রেস গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড-২০১৭ প্রদান করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে এ অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে তিনি এই পুরস্কার পেলেন। ওয়ার্ল্ড এডুকেশন কংগ্রেসের অ্যাওয়ার্ডস ও অ্যাকাডেমিক কমিটির চেয়ারম্যান শিক্ষামন্ত্রীকে পাঠানো পত্রে বলেছেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে আপনার নেতৃত্ব ও অবদান সুপরিচিত। এ ক্ষেত্রে আপনি গুরুত্বপূর্ণ ও আইকনিক ব্যক্তি।’ নুরুল ইসলাম নাহিদকে চিন্তাবিদ, কর্মী ও পরিবর্তনে বিশ্বাসী একজন রোলমডেল হিসেবে উল্লেখ করেন। (প্রথম আলো, ১৯ জুলাই ২০১৭)।
বাংলাদেশে প্রশ্নফাঁস ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে সাফল্য দেখিয়েছে, তাতে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে অধঃপতনের কারণে এ দেশের বহু শিক্ষার্থী এখন ভারতে লেখাপড়ার জন্য যাচ্ছে। ভারতের এ প্রতিষ্ঠানটি হয়তো সে কারণে কৃতজ্ঞতা থেকে মন্ত্রীকে পুরস্কৃত করেছে। পুঁজিবাদী এই দুনিয়ায় বিনিময় ছাড়া কিছুই হয় না। আর সত্যিই যদি ভারতীয় পণ্ডিতেরা আমাদের শিক্ষামন্ত্রীকে আইকনিক ব্যক্তি হিসেবে মনে করে থাকেন, তাহলে বলতে হবে, প্রশ্নফাঁসের মতো দক্ষতার জন্য হয়তো আমরা এখন পুরস্কার পাচ্ছি।

এর মধ্যে জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন বিরোধী দলের এমপি জিয়াউদ্দিন বাবলু শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষামন্ত্রী যদি পদত্যাগ না করেন তা হলে তাকে বরখাস্ত করা হোক। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া জিয়াউদ্দিন বাবলুর দাবি প্রসঙ্গে বলেন, নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি শুনেছেন। তিনি তার বিবেক বিবেচনায় জাতির স্বার্থে যতটুকু করার প্রয়োজন অবশ্যই তিনি করবেন। এখন দেখার বিষয় শিক্ষা খাতে নৈরাজ্য দূর করতে প্রধানমন্ত্রীর বিবেক জাগ্রত হয় কিনা।
alfazanambd@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/291692