দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিলে এভাবে নকশাবহির্ভূত খাবারের দোকান গড়ে উঠছে।
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৪৫

যেখানে-সেখানে গড়ে উঠছে দোকানপাট

হাতিরঝিলের নকশা সৌন্দর্য তছনছ

রাজধানীর হাতিরঝিলের মূল নকশা না মেনে এরই মধ্যে ২৯টি দোকান বসিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ কারণে হাতিরঝিলের সবুজে উৎকট ছোপ পড়েছে। নষ্ট হচ্ছে সার্বিক সৌন্দর্য। এমনকি দেশের একমাত্র ‘লেজার শো’ রাস্তা থেকে দেখা যায় না। ব্যাঙের ছাতার মতো একের পর স্থাপনা বসার অনুমতি দেওয়ায় ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের দাবি, মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এ ধরনের দোকান ঝিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর নান্দনিকতা নষ্ট করছে।

দোকানগুলো কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া জায়গা ছাড়িয়ে পাশের আরো এলাকা নিজেদের মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। তাদের আগ্রাসনে বিভিন্ন স্থানে ফুলের চারা ও অন্য গাছ ধ্বংস হতে দেখা গেছে। আর প্রশান্তির জন্য এখানে আসা লোকজন দোকানের সেবা নিতে গিয়েও ত্যক্তবিরক্ত। নিম্নমানের খাবার দিয়ে চড়া মূল্য নেওয়ার অভিযোগ করেছে অনেকে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল পরিকল্পনাকারী ও দলনেতা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাতিরঝিলের মূল পরিকল্পনায় এ ধরনের রেস্টুরেন্ট ছিল না, এসব হওয়ার সুযোগও নেই। এখন যেখানে-সেখানে দোকান হচ্ছে, এমন অভিযোগ তো পাচ্ছি। যারা হাতিরঝিল রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলে দোকান ভাড়া দিচ্ছে তাও ঠিক হচ্ছে না। রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অন্যভাবেও ওঠানো সম্ভব। সব মিলিয়ে এখন সময় হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার।’

নগর পকিল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাতিরঝিলের এসব দোকান সম্পূর্ণ অবৈধ। প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণের আয় কিভাবে হবে তা আগে স্পষ্ট বলা আছে। যারা অনুমোদন দিয়েছে তারা হাতিরঝিল প্রকল্পের চেতনাবিরোধী। নীতিমালাবিরোধী এ ধরনের কার্যকলাপের জন্য সংশ্লিষ্টরা অভিযুক্ত হতে পারে।’
হাতিরঝিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৭ প্রকৌশল নির্মাণ ব্যাটালিয়ন। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, হাতিরঝিল ঘিরে মোট ২৯টি খাবার দোকানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি দোকানের জন্য স্থানভেদে এককালীন তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। আর মাসিক ভাড়া ৭৫ হাজার টাকা। ১০ বছর মেয়াদি চুক্তিতে ভাড়া দেওয়া এসব দোকান প্রতিদিন চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। শর্তানুযায়ী দোকানগুলো হবে ভ্রাম্যমাণ গাড়ির মাধ্যমে। সরকারি ছুটির দিন সকাল ৯টা থেকে দোকান খোলা যাবে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাতিরঝিলের ছোট ছোট উড়াল সড়কের নিচের অংশে ছয়-সাতটি স্থায়ী দোকান দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া হ্রদের ওপর ইট-বালুর ঢালাই আর লোহার অ্যাংগেল দিয়ে বসানো হয়েছে আরো কয়েকটি দোকান। রান্না ও আনুষঙ্গিক কাজ করা হচ্ছে এসব দোকানেই। তারা লেকপারে নেট আর রডের বেড়া দিয়ে চেয়ার-টেবিল বসিয়েছে। এসব স্থানে মানুষের ব্যাপক চলাচলের ফলে এরই মধ্যে কয়েকটি গাছও মরে গেছে। বেশ কিছু গাছ লালচে হয়ে আছে। রেস্তোরাঁগুলোর আশপাশে ময়লা-আবর্জনাও জমেছে। কিছু আবর্জনা লেকের পানিতেও পড়ছে। লোহা-লক্কড়ের মাধ্যমে স্থাপিত রেস্তোরাঁগুলো লেকের বেশ জায়গাও দখল করে ফেলেছে।
কর্তৃপক্ষ দোকান বসানোর কারণ হিসেবে মানুষের প্রয়োজনের কথা বললেও বাস্তবে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। পুলিশ কনকর্ড প্লাজার সামনের অংশে একটি রেস্তোরাঁ আছে। কিন্তু কয়েক মাস আগে এর একটু সামনেই মেরুল অংশে আরেকটি রেস্তোরাঁ বসানো হয়েছে। পুলিশ প্লাজা থেকে মেরুল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যে চারটি বিশাল আকারের দোকান বসে গেছে। এফডিসি মোড়সংলগ্ন পুলিশ বক্সের পাশেও একটি রেস্তোরাঁ বসানো হয়েছে।
প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, পুরো প্রকল্প এলাকার বেশ কিছু স্থানে পিকআপ ভ্যানেও খাবারের দোকান বসানো হয়েছে। সেখানে ছোট ছোট ছাতা আর চেয়ার-টেবিল বসিয়ে খাবার বিক্রি করা হচ্ছে। ঘুরতে আসা মানুষ এসব দোকান থেকে খাবার কিনে খায়। দোকানগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো জায়গা নিয়ে শামিয়ানা টানিয়ে বসাচ্ছে চেয়ার-টেবিল। বেশ কিছু দোকানে নেওয়া হয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। এসব দোকানে পাওয়া যায় ফাস্ট ফুড, ফুচকা, আইসক্রিম, কফি ও জুস। এসব খাবারের দাম নেওয়া হচ্ছে গলাকাটা। রামপুরা ব্রিজ এলাকায় মন্দিরের সামনে বসেছে এমন আরেকটি খাবারের দোকান। সেখানেও বিরাট একটি এলাকা দোকানটির আওতায়। শুরুতে অস্থায়ীভাবে বসানো হলেও বর্তমানে লোহার অ্যাংগেল দিয়ে বিশাল এলাকায় শামিয়ানা টানিয়ে স্থায়ী করা হয়েছে। কয়েক মাস আগে হাতিরঝিল কর্তৃপক্ষ সেখানে সৌন্দর্যবর্ধনে যে বৃক্ষ রোপণ করেছিল তাও নষ্ট হয়ে গেছে। মেরুল বাড্ডাসংলগ্ন ‘ইওড’ নামের আরেকটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। সেখানে প্রতিদিনই শত শত যানবাহন আসে। এসব যানবাহনও রাখা হয় রাস্তার ওপর। ফলে সেই স্থানে মাঝেমধ্যেই যানজট লেগে যায়।

হাতিরঝিল প্রকল্প পরিচালক জামাল আকতার বলেন, ‘দর্শনার্থীদের কথা চিন্তা করে আমরা কিছু ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান ইজারা দিয়েছি। আর কিছু দোকান দেওয়া হয়েছে স্থায়ী। সেখানে তারা একটি নির্ধারিত স্থানে বসবে। নিজস্ব আলোর ব্যবস্থা করে দুপুরের পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বসতে পারবে। দোকান অবশ্যই ভ্রাম্যমাণ হবে। তারা খাবার বিক্রির পর সব কিছু পরিষ্কার করে দেবে। কেউ কেউ অস্থায়ী বরাদ্দ নিয়ে রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে শামিয়ানা টানিয়েছে। তা সবার চোখে পড়ছে। আমরাও ভাবছি এ বিষয়ে কী করা যায়।’
প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর সাদিক শাহরিয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে কথা বলতে হলে লিখিত নিয়ে অফিসে আসেন। আমি উচ্চপর্যায়ে কর্মকর্তার অনুমতি না নিয়ে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না।’
রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমরা শর্ত সাপেক্ষে কিছু দোকানের অনুমতি দিয়েছি। বরাদ্দপ্রাপ্তদের অবশ্যই শর্ত মানতে হবে। যদি কেউ শর্ত না মানে বা নিম্নমানের খাবার বিক্রি করে তাহলে বরাদ্দ বাতিল করব।’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/02/06/598686