৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ১০:০৭

অপ্রয়োজনীয় স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল

হচ্ছে বিদ্যুৎ অপচয় ২৫ কোটি টাকাই গচ্চা

মঙ্গলবার সকাল দশটা। রাজধানীর কাকরাইল মোড়। টিপটপ করে চলছে সিগন্যাল বাতির সময় গণনার যন্ত্র। বাঁশি ও লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ট্রাফিক পুলিশও। তবে কিছুক্ষণ পর পর লাল বাতি জ্বলে গাড়ি থামার নির্দেশ এলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। এগিয়ে চলেছে গাড়ির সারি।

লাল-হলুদ-সবুজ যে বাতিই জ্বলুক না কেন চালকরা অপেক্ষায় থাকছেন ট্রাফিক পুলিশের হাত উঁচিয়ে সংকেত দেয়ার দিকে। কাউন্টডাউন যন্ত্রের দিকে না তাকিয়ে অনুমান করে সিগন্যাল দেয়া ও সিগন্যাল ছাড়ায় নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। প্রেস ক্লাব ও শাহবাগ মোড়েও একই অবস্থা। ট্রাফিক সদস্যরা দূর থেকে হাত উঁচিয়ে সংকেত দিলেও কাজ হচ্ছে না। কখনো রাস্তার মাঝে রশি বেঁধে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে ট্রাফিক সিগন্যাল। এমন দৃশ্য শুধু কাকরাইল, প্রেস ক্লাব ও শাহবাগ মোড়েরই না। রাজধানীর ফার্মগেট, বিজয় সরণি, মহাখালী, পল্টন ও গুলিস্তানসহ রাজধানীর প্রতিটি সিগন্যালে একই চিত্র। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকার প্রতিটি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি স্থাপন করা হলেও সেগুলো কোনো কাজে আসছে না। প্রশ্ন উঠেছে কেউ যদি ট্রাফিক বাতির দিকে না ই তাকাবে তবে সেগুলো

অযথা জ্বলছে কেন। কেন বিদ্যুতের এমন অপচয়?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে রাজধানীর ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে মোড়ে মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি স্থাপন করা হয়। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গণি রোডে স্থাপন করা হয় এটির নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। বর্তমানে এটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। ডিএসসিসি’র ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ প্রজেক্টের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী কর্মকর্তাদের বেতন বাদে রাজধানীর সিগন্যাল বাতিগুলোর বিদ্যুৎ খরচ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিবছর খরচ হয় প্রায় ৮০ লাখ টাকা। যা সিটি করপোরেশনকেই বহন করতে হয়। অথচ এই ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ের কোনো সুফলই পাচ্ছে না নগরবাসী। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, এটি সরকারি প্রজেক্ট। আমাদের যে দায়িত্ব দেয়া হয় সেটা পালন করতে হয়। পছন্দ না হলে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার কোন সুযোগ নেই। কাকরাইল, শাহাবাদ, প্রেস ক্লাবসহ কয়েকটি মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার প্রতিটি রাস্তায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলাচল করে। এতে কাউন্টডাউন যন্ত্রের বেঁধে দেয়া সময়ে সিগন্যাল কভার করা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ও চালকরা আইন মানতে চায়না। এতে বাধ্য হয়ে আমরা হাতের ইশারায় সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করি। শাহবাগ মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল আব্দুল হামিদ মানবজমিনকে বলেন, ঢাকায় রাস্তার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। একবার ৫ মিনিট সিগন্যাল ছেড়ে রাখলে দেখা যায় সামনে আর যাওয়ার জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে ফাঁকা রাস্তার সিগন্যাল অনেকক্ষণ ছেড়ে রাখি। এতে কাউন্টডাউন যন্ত্রের নির্দেশনামতো সিগন্যাল ছাড়া সম্ভব হয়না। রাস্তার যানজট দেখে যতটুকু সময় প্রয়োজন গাড়ি আটকাই আবার যতটুকু সময় প্রয়োজন গাড়ি ছাড়ি। এর বাইরে ডিজিটাল সিস্টেমের সিগন্যাল বাতির সময় অনুযায়ী এ শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। তবে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন সরকারি প্রজেক্টের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বলেই তারা কাজ করে যাচ্ছেন। তারা নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সিগন্যাল ফেলছেন আবার ছাড়ছেন। কিন্তু সেটা অনুসরণ না করলে শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের। সেখানে সিটি করপোরেশনের কিছু করার নেই। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক অ্যাডমিন এন্ড রিচার্স) জাহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলাচল করে রাজধানীর রাস্তায়। কিন্তু রাস্তার মোড়ে মোড়ে হয়তো ৪ জন ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। এই চারজনের পক্ষে এতোগুলো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে যানজট নিয়ন্ত্রণে ডিজিটাল পদ্ধতি ছেড়ে পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরতে বাধ্য হতে হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কোন শহরের আয়তন অনুপাতে গড়ে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা থাকলে সেটা ঢাকায় নেই। ফলে এখানে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি অনুস্মরণ করে ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
ডিএমপি’র ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, যানজট নিরসনে ২০০১-০২ অর্থবছরে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ‘ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর ৫৯টি সড়কের ৭০টি মোড়ে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানো হয়। এর মধ্যে ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগে ৩৪, পূর্ব বিভাগে ১২, উত্তরে ১১টি এবং পশ্চিমে ১৩টি ট্রাফিক সিগন্যাল রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক অ্যাডমিন এন্ড রিসার্চ) জাহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশে প্লানিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, এডুকেশন ও এনফোর্সমেন্ট এই চার ভাগে ট্রাফিকের কাজ হয়। এর মধ্যে শুধু এনফোর্সমেন্টের কাজ করে পুলিশ। বাকি তিনটি কাজ করে ঢাকা সিটি করপোরেশন। ট্রাফিক বাতি জ্বলার তথ্য বা টাকা-পয়সা খরচের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, ঢাকায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে ৪ জন ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এই চারজনের পক্ষে যতগুলো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তার চেয়ে অনেক বেশি গাড়ি চলাচল করে। এক্ষেত্রে যানজট নিয়ন্ত্রণে পুরনো পদ্ধতিতে ফিরতে বাধ্য হতে হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) রেজাউল আলম বলেন, পুলিশ ও সিটি করপোরেশন মিলে আমরা ডিজিটাল সিগন্যাল সিস্টেম চালুর চেষ্টা করছি। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় এটা চালু করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এটি সফল হলে আগামীতে হয়তো মেনুয়াল ট্রাফিক সিস্টেমের প্রয়োজন হবে না। তিনি দাবি করেন, গুলশান এক ও দুই নম্বরে এখন স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল সিস্টেম চালু রয়েছে। তবে মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে। গাড়ির চাপ বেশি থাকায় ট্রাফিক পুলিশ মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ করে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. সোহাব উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, পৃথিবীর যেসব দেশে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সব দেশেই আমাদের মতো এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল। এখন আমরা স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ট্রাফিক ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করছি। এটা কন্টিনিউ প্রসেস। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের যৌথ প্রচেষ্টায় আশা করি আস্তে আস্তে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবো। স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম চালুর ক্ষেত্রে প্রথমে গুলশান ২ নম্বরকে টার্গেট করা হয়েছে। সেখানে সফল হলে আস্তে আস্তে ঢাকার অন্যান্য এলাকায়ও শুরু হবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=103280