৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শনিবার, ১০:০১

প্রকল্প সংশোধনের হিড়িক

সংশোধন প্রবণতা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী -ড. শামসুল আলম * গচ্চা যাচ্ছে বিপুল অর্থ, সেবাবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ


সরকারের শেষ বছরে প্রকল্প সংশোধনের হিড়িক পড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয়- উভয়ই বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো প্রকল্পে তিনবার পর্যন্ত সংশোধনী আনা হচ্ছে। এতে চার গুণ পর্যন্ত ব্যয় বাড়ছে। ব্যয় বাড়ায় গচ্চা যাচ্ছে বিপুল অঙ্কের সরকারি অর্থ, কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তাছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক শ্রেণীর কর্মকর্তা। চলতি অর্থবছরের ছয় মাস যেতে না যেতেই এত প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণে হিমশিম খাচ্ছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। বিগত কয়েকটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক পর্যালোচনা এবং আগামী বৈঠকের জন্য উপস্থাপন হতে যাওয়া প্রস্তাব থেকে এ তথ্য জানা গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ অবস্থা দেশের উন্নয়নের জন্য অশুভ সংকেত। এখান থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, সরকারের শেষ সময়- এটা বলা ঠিক নয়। প্রকল্প সংশোধন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পরিকল্পনা কমিশন এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। আমরা দেখেশুনে তারপরই সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন দিচ্ছি।

সূত্র জানায়, ‘বরিশাল টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটকে শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয় ২০১০ সালের জুলাইয়ে। আড়াই বছর অর্থাৎ ২০১২-এর ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৫৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় প্রথম সংশোধন করে প্রকল্পের মেয়াদ আরও আড়াই বছর বাড়িয়ে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত এবং ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১০৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা করা হয়। এবারও কাজ শেষ হয়নি। তাই দ্বিতীয় সংশোধন করতে হয়। এ পর্যায়ে মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত এবং ব্যয় কিছু বাড়িয়ে ১২২ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু শেষ করা যায়নি প্রকল্পটি। এবার তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এ পর্যায়ে এক বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত এবং ব্যয় ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা বাড়িয়ে ১২৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা করা হচ্ছে। আগামী একনেক বৈঠকে এ সংশোধনী প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে।
একই অবস্থা বৃহত্তর ফরিদপুর গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন (২য় পর্যায়) প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ৪১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা থেকে প্রায় চার গুণ বেড়ে দ্বিতীয় সংশোধিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৮৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এখন প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় না বাড়লেও কাজের পরিমাণ ও ব্যয় সমন্বয় করে তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী একনেক বৈঠকে উপস্থাপন করা হতে পারে প্রকল্পটি।
সমন্বিত কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ শীর্ষক প্রকল্পটির মূল ব্যয় ৭৩ কোটি টাকা থেকে এখন ৩৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১০৭ কোটি টাকা করার জন্য সংশোধনী প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করার কথা বলা হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ইন্দ্রপুর থেকে চক্রশালা পর্যন্ত বাঁক সরলীকরণ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। এখন এক বছর বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মূল ব্যয় ২৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা থেকে ২৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বাড়িয়ে ১০৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা করা হচ্ছে।

উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ প্রকল্পটির তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এ প্রকল্পে মূল ব্যয় ৬২৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা থেকে দুই ধাপে ব্যয় বাড়ানো হয় ২ হাজার ২৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এখন আবার নতুন করে প্রকল্পটির মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাস্তব অবস্থা বিবেচনা না করে অত্যধিক প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। পরে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না দিয়ে ১০-২০ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। আবার যে বরাদ্দ দেয়া হয়, সেটিও খরচ করতে পারে না সংশ্লিষ্টরা। ফলে প্রকল্পে বাস্তব কাজ পিছিয়ে থাকে। মেয়াদ বাড়াতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ে। তাছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, গাড়ি, বাড়ি ভাড়া অন্য সব খরচ দিতে হয়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বাস্তবতা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনা করে প্রকল্প অনুমোদন দিতে হবে।

তবে সরকারের শেষ বছরে প্রকল্প সংশোধন বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, অর্থবছরের শুরুতেই ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টিপাতের কারণে অবকাঠামো এবং নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। তাই এ সময়ে এসে প্রকল্প সংশোধনের হার বেড়েছে। তবে বাস্তব কারণ ছাড়া একাধিকবার প্রকল্প সংশোধনের বিষয়টি আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা উচিত।
গত কয়েকটি একনেক বৈঠক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১২টি প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার গাজনার বিলের সংযোগ নদী খনন, সেচ সুবিধার উন্নয়ন এবং মৎস্য চাষ প্রকল্প, জিএমডিএস এবং ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম স্থাপন, ইন্ট্রোডাকশন অব মেশিন রিডেবল ভিসা অ্যান্ড পাসপোর্ট ইন বাংলাদেশ, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ বাস্তবায়ন (ভ্যাট অনলাইন), লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণ, ৭টি র্যাব কমপ্লেক্স নির্মাণ, অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) শিল্প পার্ক, জরুরি ২০০৭ ঘূর্ণিঝড় পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন প্রকল্প এলজিইডি অংশ, ইমার্জেন্সি ২০০৭ সাইক্লোন রিকভারি অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট: কো-অর্ডিনেশন অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিট পার্ট, শেখ লুৎফর রহমান ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন, গোপালগঞ্জ এবং বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্প।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/13831