২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৮:৫০

এসএসসি পরীক্ষা শুরু

প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলল ফেসবুকে পাওয়া প্রশ্ন


♦ প্রশ্নপত্র আসছে হোয়াটসঅ্যাপেও, লেনদেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে
♦ আগাম প্রশ্নপত্র প্রতি সেট ৭০০ থেকে দুই হাজার টাকা


এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে ফেসবুকের কয়েকটি আইডি থেকে যোগাযোগের সূত্র দিয়ে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে, মূল প্রশ্নপত্র আর ফেসবুকে যোগাযোগের পর পাওয়া বহু নির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) হুবহু এক। আবার কিছু আইডি থেকে প্রশ্নপত্র দেওয়া হলেও তা মেলেনি। অনেক আইডি থেকে পরীক্ষার আগে রচনামূলক অংশের প্রশ্ন দেওয়া হলেও সেগুলোর মিল পাওয়া যায়নি মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে। পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ফেসবুকে দেওয়া প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নের মিল নেই।
গতকাল বৃহস্পতিবার সারা দেশে একযোগে শুরু হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এবার পরীক্ষা দিচ্ছে ২০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। এসএসসিতে এবার অভিন্ন প্রশ্নপত্রে হচ্ছে সব বোর্ডের পরীক্ষা।

আগাম প্রশ্নপত্র পেতে আগ্রহীরা ফেসবুকে অনবরত ঢুঁ মারছিল। আর এতে মিলেছেও প্রশ্ন। আগাম প্রশ্নপত্র যেসব ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া হচ্ছে, তারা প্রথমে ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলছে। সেখানে যোগাযোগ করা হলে মোবাইল ফোন নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা সংরক্ষণ করার জন্য হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে প্রশ্নপত্র। কারণ ইন্টারনেটভিত্তিক এই অ্যাপসটি এখন পর্যন্ত নিরাপদ পথে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। আগাম প্রশ্নপত্র পেজভেদে ৭০০ থেকে দুই হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে।
আগাম প্রশ্নপত্র দিয়ে থাকে এমন বেশ কিছু ফেসবুক পেজে গতরাত পর্যন্ত গিয়ে দেখা যায়, এসএসসি বাংলা প্রথম পত্রের মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে একটি পেজ থেকে দেওয়া এমসিকিউ অংশ হুবহু এক। সেখানে ওই পেজের অ্যাডমিনের পক্ষে লেখা রয়েছে, ‘এটি আগাম প্রশ্ন (বাংলা প্রথমপত্র)। যারা নগদ অর্থ আমাকে দিবে তাদেরকে পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্র দেয়া হবে।’ আগ্রহীদের ইনবক্সে যোগাযোগ করতেও বলা হয়।
এ রকম বেশ কিছু ফেসবুক অ্যাডমিনের সঙ্গে ইনবক্সে যোগাযোগ করা হলে তারা একটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেয়। বিকাশ নম্বরে অর্থ দিলে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র দেওয়া হবে বলেও তারা জানায়।

জানা যায়, ‘ঝঝঈ ঊীধস য়ঁবংঃরড়হ ২০১৮’ নামের একটি ফেসবুক আইডিতে গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে একটি পোস্টের মাধ্যমে বাংলা প্রথম পত্রের এমসিকিউ অংশের দুই পৃষ্ঠার প্রশ্ন দেওয়া হয়, যা দেখতে হুবহু প্রশ্নের মতোই। ‘খ’ সেটের এই প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নের ‘খ’ সেটের ৩০টি প্রশ্নই হুবহু মিলে গেছে। ওই পোস্টের ওপরে লেখা আছে, ‘প্রমাণ দেখ দিতে পারি কি না...। বাংলা দ্বিতীয় পত্র আজকেই দিব।’ এরপর ইংরেজিতে লেখা ‘পধষষ ফধড়... ০১৭৬৪৪৩৯১০০’। ফেসবুক পোস্টে দেওয়া এক নম্বর প্রশ্ন ছিল ‘প্রাচীন ভারতবর্ষে রচিত মহাকাব্য কোনটি?’ আর ৩০ নম্বর অর্থাৎ শেষ প্রশ্ন ছিল “কপোতাক্ষ নদ’ কবিতায় ‘প্রজা’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে?” এই দুটি এবং মাঝের ২৮টি প্রশ্নও হুবহু মিলে গেছে।

কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ওই নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। তবে একবারও কল ঢোকেনি। বারবারই বলা হয়, ‘এই নম্বরটি এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে।’ তবে মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত ট্রু কলারের মাধ্যমে দেখা যায়, ওই নম্বরটির ব্যবহারকারীর নাম ‘অষধসরহ’।
‘এস.এস.সি এক্সাম ক্রোশ্চেন ২০১৮’ ফেসবুক পেজে গতকাল সকাল ৯টা ৪১ মিনিটে এমসিকিউ প্রশ্নপত্র আপ করা হয়। ওই প্রশ্নপত্রের সঙ্গে বোর্ডের প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল রয়েছে। ফেসবুকের ওই পেজের ইনবক্সে আগামীকাল শনিবার অনুষ্ঠিতব্য বাংলা দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন চাওয়া হয়। তখন ইনবক্সে ০১৯০৭১২৪২০৫ নম্বরে ফোন করে কথা বলার জন্য বলা হয়। ওই নম্বরে ফোন করলে জয় পরিচয় দিয়ে একজন জানান, ‘আমার এই মোবাইল ফোনটি মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর। এখানে এক হাজার টাকা দেওয়া হলে সঙ্গে সঙ্গে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফেসবুকের ইনবক্সে দেওয়া হবে।’ প্রশ্নপত্র না মিললে কী হবে জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘প্রশ্নপত্র শতভাগ মিলবে। এর প্রমাণ আজকে বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্র। এটি দিয়েছি এ কারণে যাতে মানুষ বিশ্বাস করে আমি প্রশ্নপত্র আউট (ফাঁস) করতে পারি।’

‘এসএসসি এইচএসসি এক্সাম ২০১৮’ পেজ থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয় বলে দাবি করে বেশ কয়েকটি পোস্ট দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো ধরনের আগাম প্রশ্নপত্র ওই পেজে দেওয়া হয়নি। আগাম প্রশ্নপত্র পেতে আগ্রহীদের পেজের ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। ওই পেজের ইনবক্সে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, আগাম প্রশ্নপত্র নিতে প্রতি সেট প্রশ্নের জন্য ৭০০ টাকা করে দিতে হবে। প্রশ্নপত্র শতভাগ না মিললে টাকা দেওয়ার দরকার নেই। ইনবক্সে ০১৭৮৮৫৪০৭৫৫ নম্বরটি দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ইনবক্সে আরো বলা হয়, প্রথমে পরীক্ষার্থীর একটি আইডি কার্ডের ছবি পরীক্ষার্থীর নামসহ হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে হবে। এর পরই প্রশ্নপত্র দেওয়া হবে। যদি প্রশ্নপত্র না মেলে তাহলে টাকা দেওয়ার দরকার নেই।

এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, অন্য কোথাও থেকে প্রশ্ন বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিছু শিক্ষক পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলার পর তা বাইরে পাঠিয়ে দেন। এ জন্যই এবারের এসএসসি পরীক্ষা সকাল ১০টায় শুরু হলেও শিক্ষার্থীদের সকাল সাড়ে ৯টায় সিটে বসা বাধ্যতামূলক করা হয়। এর পরই প্রশ্নের প্যাকেট খোলার সিদ্ধান্ত হয়। কেন্দ্রসচিব একটি অ্যানালগ ফোন ছাড়া অন্য কেউ কোনো ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এর পরও পরীক্ষার প্রথম দিনই সকাল সাড়ে ৯টার আগেই ফেসবুকের বিভিন্ন আইডিতে প্রশ্নপত্রের এমসিকিউ অংশ হুবহু পাওয়া যায়।
গতকাল রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শন করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে প্রমাণ হলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা বাতিল করা হবে। যদি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ হয়, আমরা সেই পরীক্ষা বাতিল করে দিব, কোনো দ্বিরুক্তি হবে না।’

মন্ত্রী আরো বলেন, ‘আপনারা বোঝেন, ফেসবুকে এমন ভুয়া ঘোষণাও আসে—আউট হয়ে গেছে। সাড়ে ২০ লাখ ছেলেমেয়ের পরীক্ষা আবার নেওয়া, তাদের দুশ্চিন্তার বিষয় চিন্তা করেন। এ কারণে যদি প্রমাণ হয়, ফাঁস হয়েছে, তাহলে আমরা পরীক্ষা বাতিল করে দেব, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে কোনো পরীক্ষা হবে না।’ প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, ‘আমরা খুবই ডেসপারেট, খুবই অ্যাগ্রেসিভ এ বিষয়ে এবং যদি কোথাও কেউ কোনোভাবে প্রশ্ন ফাঁসের চেষ্টা করে তিনি কোনোভাবেই রেহাই পাবেন না। কী হবে, আমিও সেটা ধারণা করতে পারি না। চরম একটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ফেসবুকের একটি গ্রুপে আসা একটি ‘প্রশ্নপত্র’ শিক্ষামন্ত্রীকে দেখিয়ে একজন সাংবাদিক বলেন, ওই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে গুঞ্জন চলছে। পরে মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা বিদ্যালয় কার্যালয়ে গিয়ে ওই প্রশ্ন মিলিয়ে দেখে আসেন। পরে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রশ্ন আউট হয়েছে বলে যে প্রমাণ আমাদের দেখানো হয়েছে, মূল প্রশ্নের সঙ্গে আমরা সেটা মিলিয়ে দেখেছি। মিলিয়ে দেখলাম, এই প্রশ্নের সঙ্গে সেটার মিল নেই। গুজব কি গুজব না, সেটা আপনারা দেখবেন।’ ‘মিথ্যা ছড়িয়ে’ কেউ যেন বিভ্রান্ত না করে সে বিষয়ে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন শিক্ষামন্ত্রী।
আধাঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদের হলে ঢোকার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সন্দেহ ছিল, ছেলেমেয়েরা আগে আসতে পারবে কি না? আমরা দেখতে পেরেছি, কেউ দেরি করেনি। আমরা বলেছি, প্রশ্নের খামটা ৩০ মিনিটের বেশি আগে খোলা যাবে না। আরো ব্যবস্থা নিয়েছি, কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখছি। সারা দেশে শিক্ষা কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসন তৎপর রয়েছে।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/02/02/597043