২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৮:৪৫

বেপরোয়া কারপার্টি

রাজধানী জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ছিনতাই চক্রের কারপার্টি। দামি প্রাইভেট কারে চড়ে ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে এ চক্র। কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গ্রেপ্তারের নাটক সাজিয়ে তুলে নেয়া হচ্ছে গাড়িতে। সুযোগমতো মারধর করে সর্বস্ব লুটে নেয়ার পর চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলছে তাদের। এছাড়াও সুযোগ পেলেই পথচারী ও রিকশা আরোহীদের ব্যাগ টেনে নিচ্ছে এই কারপার্টি। যাত্রী উঠিয়ে সুযোগমতো তার সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা বেড়েছে প্রায় চার গুণ। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার অবস্থা ভয়ঙ্কর। এখানে কারপার্টির হাতে শুধু ছিনতাই ঘটছে তাই নয়। ঘটছে প্রাণহানিও। শিশু ও নারী কেউ নিরাপদ নেই এখানে। নানা কৌশলে বেপরোয়া কারপার্টি।
রাজধানীর পল্লবীর কালশী। সকাল পৌনে ৮টা। ডেকে ডেকে যাত্রী তোলা হচ্ছিল প্রাইভেট কারে। এক এক করে অনেক কার কালশী থেকে যাচ্ছিল মহাখালীর দিকে। অফিসগামী আনসার আলমের ছিল তাড়াহুড়া। দেখতে পান একটি প্রাইভেট কারের চালক ডাকছিলেন ‘একজন দরকার, একজন, একজন হইলেই ছেড়ে দেব।’ সাদা রঙের এলিয়েন গাড়িতে তখন তিন যাত্রী। চালকের পাশে কলেজের ইউনিফরম পরা, কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো এক তরুণ। পেছনে মধ্য বয়সী দুজন। পেছনের সিটেই বসেন আনসার আলম। গাড়ি ছুটছে। বনানী ফ্লাইওভারে উঠতেই মূল ঘটনার শুরু। পাশে বসা এক যাত্রী গাড়ির গ্লাস বন্ধ করতে করতেই বলছিল, বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস। গ্লাসটা বন্ধ করে দেই। আনসার আলম বলেন, হ্যাঁ ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। গ্লাস বন্ধ করতেই পাশে বসা যাত্রীবেশী যুবক পকেট থেকে একটি পিস্তল বের করেন, অন্য যুবক বের করেন চাকু। ক্ষেপে উঠেন আনসার। বিষয় কি আপনারা এসব কি করছেন? কথা শেষ হওয়ার আগেই পিস্তলটা তার মাথায়, বুকের সামনে চাকু। যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীর হুমকি, পকেটে যা আছে বের কর। এটিএম কার্ড ও আর পিন নম্বরটা দে- নইলে মেরে রাস্তায় লাশ ফেলে চলে যাবো। ততক্ষণে পকেট থেকে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ হাতে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। না সেখানে কোনো কার্ড নেই। প্রায় এক হাজার টাকা আছে। জানতে চাওয়া হয় কার্ড কই রাখছিস। আনসার জানান, তিনি ছোটখাটো চাকরি করেন। তার কোনো কার্ড নেই।

শুরু হয় মারধর। সিটের নিচ থেকে লাঠি বের করে প্রহার করা হয় তাকে। সেইসঙ্গে কিল, ঘুষিতো আছেই। গাড়িটি বনানী ফ্লাইওভারে উঠছিল, নামছিল। আর ভেতরে ঘটছিল এই ঘটনা। এক পর্যায়ে বাসায় কল দিতে বলা হয় তাকে। অপহরণ করা হয়েছে জানিয়ে ফোনে টাকা চাইতে বলা হয় তার স্ত্রীর কাছে। তাদের দাবি এক লাখ টাকা। টাকা না দিলে মেরে ফেলা হবে তাকে। আনসার অপারগতা প্রকাশ করে জানান, তিনি গরিব মানুষ। বাসায় দেয়ার মতো টাকা নেই। বাড়ানো হয় মারধরের মাত্রা। বেদম প্রহার করার এক পর্যায়ে তিনশ’ ফিট এলাকায় তাকে ফেলে চলে যায় ছিনতাইকারীরা। গত ২৮শে জানুয়ারি ঘটনাটি ঘটে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মিরপুর ১২/বি’র ১৬/৩৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা আনসার আলম। তিনি জানান, ছিনতাইকারীদের হামলায় আহত হলেও আইনি জটিলতা এড়াতে থানা পুলিশমুখো হননি তিনি।

আরো ভয়ঙ্কর কৌশলে মাঠে নামে কেউ কেউ। সঙ্গে কারতো আছে। কারের গ্লাসে প্রিন্ট করা কাগজে লেখা আছে ‘ডিবি’। গাড়িটি ধীরগতিতে থামে টার্গেটকৃত ব্যক্তির সামনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ‘এই আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে গাড়িতে উঠেন।’ বলতে বলতে হ্যান্ডকাফ ও কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলটা দেখিয়ে নেবে একপলক। মুহূর্তের মধ্যেই টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে তাকে। তারপর মারধর। সঙ্গে থাকা টাকা রেখে রাস্তায় ফেলে দিয়ে হাওয়া হয়ে যায় এই কারপার্টি। এরকম ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। গত ৬ই ডিসেম্বর উত্তরায় এভাবেই মারধর করে গার্মেন্ট কর্মকর্তা সাঈদ মাহমুদ আল ফিরোজের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরে কুড়িল বিশ্বরোডে তাকে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। দিন-দুপুরেই এক নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর সড়কে ঘটে ঘটনাটি। তার সহকর্মী রাসেল হাওলাদার জানান, ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফিরোজ ও গাড়িচালক রবি মাইক্রোবাসে করে কার্যালয়ে ফিরছিলেন। হঠাৎ ডিবি পরিচয় দিয়ে গাড়ির গতিরোধ করে চার-পাঁচ জন। তাদের সঙ্গে ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ ও কোমরে রিভলবার।

এই কারচক্রের কয়েক হোতা প্রায়ই গ্রেপ্তার হচ্ছে। জামিনে বের হয়ে আবার একই কাজ করে বেড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছে, আবুল কাশেম, আব্দুল বারেক, গাফ্ফার , মনির হোসেন, রাসেল, আল আমিন দিপু, মোর্শেদ, সবুজ হোসেন, আলম, রিয়াজ, মেহেদি হাসান, আরমান ও নাজমুল হাসান এরশাদ।
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, এই চক্রটি ডিবি পরিচয়ে ছিনতাই করে। তারা দু’তিনটি ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কেউ ব্যাংকে অবস্থান করে। তারা টাকা উত্তোলনকারী গ্রাহকদের সম্পর্কে ব্যাংকের বাইরে অবস্থানকারী দলের কাছে তথ্য পৌঁছে দেয়। টাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তি সুবিধামতো জায়গায় এলে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এই গ্রুপের ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন মনির হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী। মনির ও তার সঙ্গী মহিউদ্দিনকে রিকশা থেকে নামিয়ে ডিবি পরিচয়ে কারে তুলে নিয়ে যায়। গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে মারধর করে পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় এই চক্র।

পুুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরে দেশে ডাকাতির মামলা হয়েছে ৩৩৬, দস্যুতার ৬৫৭। তার আগের বছরে ডাকাতির অভিযোগে মামলা হয়েছে ১০৪ ও দস্যুতার অভিযোগে ১৫১টি। ঢাকায় গত বছরে ডাকাতির অভিযোগে মামলা হয়েছে ২০ ও দস্যুতার অভিযোগে ১০৩টি। তার আগের বছরে ডাকাতির মামলা হয়েছে চারটি ও দস্যুতার ২০টি।
ঢাকায় বেপরোয়া এই কারপার্টির হাতে গত শুক্রবার ভোরে ধানমন্ডি ও গেণ্ডারিয়া এলাকায় নিহত হয়েছেন দুজন। তার আগে গত ১৮ই ডিসেম্বর ভোরে ওয়ারীর দয়াগঞ্জে ছিনতাইয়ের সময় মায়ের কোল থেকে পড়ে নিহত হয় শিশু আরাফাত। ৫ই ডিসেম্বর নিহত হন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ফরহাদ আলম। ২৯শে নভেম্বর বিকালে তিনি কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার পথে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে আহত হন। গত ৮ই অক্টোবর ওয়ারীর কেএম দাস লেনে নিজ বাসার সামনেই ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার আবু তালহা। ৩০শে জুন ওয়ারী এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান জালাল নামে এক তরুণ।

সূত্রমতে, পল্লবীর কালশি, আগারগাঁও ক্রসিং থেকে শ্যামলী শিশুমেলা, তালতলা, টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর, মহাখালী থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়, মতিঝিলের শাপলাচত্বর থেকে টিকাটুলি মোড়, মতিঝিল কালভার্ট রোড থেকে আরামবাগ, কমলাপুর, মানিকনগর, পীরজঙ্গির মাজার, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের আশেপাশের এলাকা, যাত্রাবাড়ী মোড়, জুরাইন রেলগেট থেকে পোস্তগোলা, কাকরাইল মোড় থেকে ফকিরাপুল, রাজারবাগ পূর্বপাশের মোড় থেকে শাহজাহানপুর রেললাইন, মালিবাগ রেলগেট থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচ পর্যন্ত, মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ মোড়, দোয়েল চত্বর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, নিউ মার্কেটের দক্ষিণ দিকের রাস্তা, আজিমপুর মোড়, ধানমন্ডি দুই নম্বর সড়ক, পান্থপথ মোড় থেকে রাসেল স্কয়ারসহ দেড় শতাধিক স্পটে প্রায়ই ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।
এসব বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সোহেল ফেরদৌস বলেন, ছিনতাই ঠেকাতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। পেট্রোল ডিউটি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুলিশের অভিযানে প্রায়ই ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=103212