২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৮:৩৮

থানার বাইরে অন্তহীন প্রতীক্ষা

সকাল ৮টা। রমনা থানার সামনের রাস্তার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছেন গৃহবধূ মীম। তার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। আবার মাঝে মধ্যেই অন্যদের থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। মীমের হাতে খাবারের প্যাকেট। সাথে দেড় লিটার মিনারেল ওয়াটারের বোতল। জানতে চাইলে প্রথমে লজ্জায় নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন মীম। পরে ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, তার স্বামী ফারুককে আটক করেছে পুলিশ। দুই দিন ধরে রমনা থানার গারদে রয়েছেন তিনি। কী কারণে পুলিশ তাকে আটক করেছে, তা কেউ বলতে পারে না।
নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন কেন জানতে চাইলে পাশ থেকে তার এক আত্মীয় জানান, মাত্র কয়েক দিন হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। স্বামী ফারুক একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। মীম নিজেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। অথচ আজ স্বামীকে একনজর দেখার জন্য নববধূকে থানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এটিই মানতে পারছেন না। তাই লজ্জা। শুধু মীম নন, তার মতো শতাধিক স্বজন ভিড় করছেন রমনা থানার সামনে। একই অবস্থা শাহবাগ ও মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ের সামনেও। তীব্র কষ্ট উপেক্ষা করে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নির্ঘুম অপেক্ষা করছেন তারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কয়েক দফা রমনা, শাহবাগ থানা ও ডিবি কার্যালয়ের সামনে ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। রমনা থানার দু’টি গেটের মধ্যে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের দিকের গেইট ছিল তালাবদ্ধ। অন্য গেইটটি তালা বন্ধ না থাকলেও সেটিও ছিল আটকানো। স্বজনের সন্ধানে কাউকেই ভেতরে যেতে দেয়া হচ্ছে না। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ অপেক্ষা করছেন থানার সামনের রাস্তা ও ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে। তাদের ভিড় সামলাতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিন-চারজন পুলিশকে। মাঝে মধ্যেই তারা লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করছেন উপস্থিত স্বজনদের। সে যেন পুলিশ ও মানুষের ইঁদুর-বিড়াল খেলা।
জানা গেছে, রমনা থানার গারদে তিল ধারণের জায়গা নেই। খালি নেই ডিবি কার্যালয়ের গারদও। গত দু-তিন দিনে পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দুই শতাধিক মানুষকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে যেমন রয়েছেন রাজনীতির সাথে জড়িতরা; ঠিক তেমনি রয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সাধারণ মানুষ। স্বজনকে খুঁজে না পেয়ে এই মানুষগুলো জড়ো হচ্ছেন রমনা, শাহবাগ থানা ও ডিবি কার্যালয়ের সামনে। খুঁজে ফিরছেন নিজের স্বজনদের। এর মধ্যে কেউ স্বজনের সন্ধান পাচ্ছেন থানা হাজতে বা ডিবি কার্যালয়ের গারদে। আবার কেউ পাচ্ছেন না। যারা খুঁজে পাচ্ছেন তারা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। আর যারা খুঁজে পেয়েছেন তারা এক নজর দেখার চেষ্টা করছেন প্রিয় মানুষটিকে। চেষ্টা করছেন খাবার, পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ, শীতের কাপড় পৌঁছে দিতে। কিন্তু সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকেই সেই সুযোগটুকুও পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছে।
গৃহবধূ মীম বলেন, তার স্বামী কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত নন। গত ৩০ তারিখ রাতে টিউশনি করে বাসায় ফেরার পথে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। প্রথমে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে থানা ও ডিবি অফিসে খোঁজ নিয়ে রমনা থানায় তার সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু পুলিশ কোনোভাবেই তার সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না। সকাল ৮টা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। পুলিশ বলছে, সম্ভব হলে বেলা ২টার পর দেখা করতে দেয়া হবে।
মেয়ের স্বামী সাইফুল হকের জন্য সকাল থেকে রমনা থানায় দাঁড়িয়ে আছেন শ্বশুর লিয়াকত আলী। রয়েছেন বৃদ্ধা শাশুড়ি ও ছোট ভাই জুবায়ের। শ্বশুর লিয়াকত আলী বলেন, সাইফুলের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে। সে নয়াপল্টনে প্রেস ও গার্মেন্ট এক্সেসরিজের ব্যবসা করে। গত ৩০ তারিখ রাতে কর্মস্থল থেকে নয়াপল্টনের বাসায় ফেরার পথে পুলিশ তাকে আটক করে। প্রথমে পরিবারের সদস্যরা তার কোনো সন্ধান পাননি। এরপর শুরু হয় খোঁজখবর নেয়। একপর্যায়ে পল্টন থানা গেলে সেখান থেকে বলা হয় ডিবি কার্যালয় অথবা রমনা থানায় যেতে। এরপর গতকাল ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে রমনা থানায় গিয়ে জানতে পারেন তার জামাতা পুলিশের রিমান্ডে রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে থেকে নাকি সাইফুল গাড়ি ভাঙচুর করেছে। গ্রেফতার হওয়া বুলবুল আহমেদকেও থানা হাজতে খুঁজে পেয়েছেন তার বোনেরা।
তিন দিনেও স্বামী রুবেলকে খুঁজে পাচ্ছেন না গৃহবধূ লিপি। তিন দিন ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন ডিবি কার্যালয়ের সামনে। কিন্তু এখন পর্যন্ত রুবেলের হদিস পাননি তিনি। লিপি জানান, রুবেল রামপুরা এলাকায় ফার্নিচারের ব্যবসায় করতেন। গত ৩০ জানুয়ারি রাতে একই এলাকার বাসায় ফেরার পথে ডিবি পরিচয়ে তাকে তুলে আনা হয়। এর পর থেকে তার কোনো সন্ধান পাননি। ডিবি কার্যালয়ের গেইটের সামনে থেকে তাকে বলা হয়েছে, ‘ডিবির যে টিমের সদস্যরা তাকে ধরেছে, প্রয়োজন হলে তারাই আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবে। অযথা আপনারা এখানে ভিড় করবেন না।’ স্বামীর সন্ধান না পেয়ে রাত-দিন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দৌড়ে ফিরছেন তারা। জামাতা আরিফ হোসেন বুদ্দুকেও খুঁজে পাচ্ছেন তার শাশুড়ি রাজিয়া। তিনিও ডিবি কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষা করছেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে রাজিয়া জানান, আরিফ যাত্রাবাড়ী এলাকায় মুদি দোকান দিতেন। গত ৩১ জানুয়ারি রাতে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার পথে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। জামাতার সন্ধানে যাত্রাবাড়ী থানায় গেলে সেখান থেকে বলা হয় আরিফকে ডিবি পুলিশ নিয়ে গেছে। থানা থেকে যোগাযোগের ডিবির এক কর্মকর্তার মোবাইল নম্বর দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ওই নম্বরে ফোন করলে এক ব্যক্তি বলছেন, ‘আমরা আপনার জামাতাকে গ্রেফতার করেনি’। তাহলে আরিফ কোথায় গেল বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
এ দিকে গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের সামনে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকে গত চার দিনে বিপুলসংখ্যক মানুষকে গ্রেফতার ও আটক করেছে মহানগর পুলিশ। গতকাল পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে আটকের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, গত চার দিনে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষকে গ্রেফতার ও আটক করা হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/290256