১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১১:২৭

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে

গতকাল বুধবার দেশের দুই শেয়ারবাজারে রেকর্ড পরিমাণ দরপতন হয়েছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় ৩১৫ শেয়ারের মধ্যে মাত্র ১২টি ছাড়া বাকি প্রায় সব কোম্পানি দর হারায়। এতে প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্সের পতন হয় ১১৬ পয়েন্ট। শতাংশের হারে যা ১ দশমিক ৯০ শতাংশ। অবশ্য সর্বশেষ ৮৮ পয়েন্ট সূচক পতনের মাধ্যমে গতকালের লেনদেন শেষ হয়। গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারির পর একদিনে শেয়ারদর ও সূচকের এতটা পতন আর কখনও হয়নি।

বাজার-সংশ্নিষ্ট পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ব্যাংকের এডি রেশিও নিয়ে নেতিবাচক প্রচার, খালেদা জিয়ার মামলার রায় নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা, বিভিন্ন কোম্পানির নেতিবাচক ইপিএস প্রকাশসহ এসব ইস্যুতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। ফলে গতকাল শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতনের ঘটনা ঘটে। এমনকি দরপতনের কারণে কয়েকদিনের তুলনায় লেনদেনও বেড়েছে। গতকাল দেশের দুই শেয়ারবাজারে সর্বমোট ৫১৫ কোটি ৭২ লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে, যা আগের দিনের তুলনায় ৮৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা বা প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। বাজার-সংশ্নিষ্টরা জানান, দরপতনের আতঙ্কে শেয়ার বিক্রির চাপে লেনদেন বেড়েছে।

অবশ্য ব্যাপক দরপতন রুখতে লেনদেনের দ্বিতীয়ার্ধে এসে শেয়ার কিনতে থাকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গতকাল এ প্রতিষ্ঠানটি একাই প্রায় ৩০ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে। তবে আইসিবি শেষ পর্যন্ত বড় দরপতন রুখতে না পারলেও দরপতনের হার কমাতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউস ইউসিবি ক্যাপিটাল এবং লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের গ্রাহকদের শেয়ার ক্রয় দরপতনের পরিমাণ কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

শেয়ার লেনদেন পর্যবেক্ষণে থাকা কর্মকর্তারা জানান, গতকালের দরপতনে ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ভূমিকাই ছিল বেশি। চিহ্নিত বাজার কারসাজিকারকদের মধ্যে একজন ছাড়া এদিন প্রায় সবাই নিষ্ফ্ক্রিয় ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল শুরুতে বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করলেও লেনদেনের শেষাংশে এসে পুনরায় শেয়ার কিনেছে। বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ থাকলেও ক্রেতার অভাব ছিল না। কয়েকদিনে সার্কিট ব্রেকারের সর্বনিম্ন দরে কিছু শেয়ার কেনাবেচা হলেও গতকালের লেনদেনে এমন কিছু লক্ষ্য করা যায়নি।

যেসব ব্রোকারেজ হাউস থেকে বিনিয়োগকারীরা বেশি পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করেছে এরকম হাউসের কর্মকর্তারা সমকালকে জানান, 'কী হয়, কী হয়'- এমন আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছেন তাদের গ্রাহকরা। এমনকি অনেকে লোকসানেই শেয়ার বিক্রি করছেন। বিপরীতে আশাবাদী বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা কম ছিল। যারা শেয়ার কিনেছেন, তারা অপেক্ষাকৃত কম দামে শেয়ার কেনার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এ বিষয়টিই দরপতনকে ত্বরান্বিত করে।

বিনিয়োগকারীদের এমন নেতিবাচক মনোভাবের কারণে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৩৫ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২৭৮টিরই বা ৮৩ শতাংশের দর কমে। বিপরীতে মাত্র ৩১টির দর বা সোয়া ৯ শতাংশের দর বাড়ে। বাকিগুলোর দর অপরিবর্তিত থাকে।

শেয়ারদর হ্রাসের এমন চিত্রের পরও ডিএসইএক্স সূচক শেষ পর্যন্ত ৮৮ পয়েন্ট হারিয়ে ৬০৪০ পয়েন্টের কিছুটা নিচে থেমেছে। অর্থাৎ লেনদেনের শেষ দেড় ঘণ্টায় আইসিবি, ইউসিবি ক্যাপিটাল ও লংকাবাংলার শেয়ার ক্রয়ে দরপতনের পরিমাণ কমায় সূচকটি ২৮ পয়েন্ট বেড়েছে।

শেয়ারবাজার-সংশ্নিষ্টরা মনে করেন, মুদ্রানীতি; বিশেষত ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) নিয়ে গণমাধ্যমগুলোর নানামুখী খবরই এ বিভ্রান্তির প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতা। এছাড়া কয়েকদিনে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমার খবরও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে।

যদিও এই বড় দরপতনের পর গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএ ও ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) নেতারা দাবি করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দরপতনের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

বিএমবিএর সভাপতি ও লংকাবাংলার শেয়ারবাজার সংশ্নিষ্ট বিভাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, কয়েকদিনে এডিআর নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনগুলো নেতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এর সঙ্গে খালেদা জিয়ার মামলার ইস্যুতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। হয়তো এরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে লেনদেনে।

এডিআর নিয়ে বিনিয়োগকারীদের কোনো গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এডিআর যে হারে কমাবে বলে শোনা যাচ্ছিল, তার মাত্র তিনভাগের এক ভাগ কমানো হয়েছে। তার থেকেও বড় কথা হলো, এডিআর কত হলো, তাতে শেয়ারবাজারের কিছু আসে যায় না। এক সময় ব্যাংকের এডি রেশিও ৭০ ছিল। কিছুটা কমানোর পরও তা এখন সাড়ে ৮৩ শতাংশ। কেউ যদি মনে করেন, এডিআর কমানোর কারণে শেয়ারবাজারে অর্থপ্রবাহ কমবে, তিনি ভুল করছেন। এমন ভীতিতে শেয়ার বিক্রি করলে আরও ক্ষতির শিকার হবেন তারা।

গতকাল লংকাবাংলা থেকে বিক্রির তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার ক্রয়ের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এটাই কৌশলী বিনিয়োগকারীদের চরিত্র। যখন অনেকে আতঙ্কে কম দামে শেয়ার বিক্রি করেন, তখন কৌশলীরাই কম দামে শেয়ার কিনে নেন।

একই কথা বলেছেন ডিবিএ সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক। তিনি সমকালকে বলেন, এডিআর ছাড়াও রাজনৈতিক ইস্যুতে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। তাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হয়েছেন। ডিবিএর পক্ষ থেকে ব্রোকারদের কোনোরূপ গুজবে কান না দেওয়া এবং তাদের গ্রাহকদের সচেতন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

মোস্তাক আহমেদ বলেন, এডিআর খুবই সামান্য কমানো হয়েছে। যতটুকু কমানো হয়েছে, তার জন্য শেয়ারবাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। তার থেকেও বড় কথা হলো, অতিরিক্ত ঋণ সমন্বয়ে ছয় মাস সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, এত অল্প সময়ে এডিআর সমন্বয় করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত উচ্চবাচ্য করেনি। ফলে বিনিয়োগকারীদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

এদিকে ব্যাপক দরপতনের পর গতকাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জও (ডিএসই) একটি বিবৃতি দিয়েছে। দেশের প্রধান এই স্টক এক্সচেঞ্জটি সদ্য ঘোষিত মুদ্রানীতিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, এই মুদ্রানীতির মাধ্যমে শেয়ারবাজারের অগ্রগতিতে নীতি সমর্থন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বেদেশিদের বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে সহায়তার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আরও উদ্যোগী হতে বলা হয়েছে। ডিএসই মনে করে, এতে বিদেশি বিনিয়োগ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

একই স্টক এক্সচেঞ্জের অপর এক সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় বিনিয়োগকারীরা যখন আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছেন, তখন বিদেশিরা কম দামে শেয়ার কিনে নিচ্ছেন। সূত্র জানায়, সদ্য সমাপ্ত জানুয়ারি মাসে এই স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিদেশিরা নিট ১৮৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। মাসজুড়ে তারা ৬৬৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকার শেয়ার কেনেন। বিপরীতে বিক্রি করেন ৪৮০ কোটি ১৯ লাখ টাকার শেয়ার।

সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কয়েকদিনের দরপতন দেখে মনে হচ্ছে, স্বার্থান্বেষী কোনো গোষ্ঠী দরপতনকে উস্কে দিচ্ছে। তারা হয়তো কম দামে শেয়ার কিনতে এমনটি করছে। দরপতনকে ত্বরান্বিত করতে এডিআরসহ নানা ইস্যুকে কাজে লাগাচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

http://samakal.com/economics/article/18026