১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৬

অসহায়ত্ব দেখার মতো নয়

আমাদের দুর্ভোগের জন্য কাউকে এককভাবে দোষ দিয়ে লাভ নেই। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের, বিশেষ করে শিক্ষিত সচেতন লোকদের, দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের অভাব যে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে, সে কথা অস্বীকার করা যাবে না। আমরা শিক্ষিত লোকরা যে যেখানেই থাকি, দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনে এতটা বিবেকহীন কিংবা স্বার্থপর ছিলাম না। দেশকে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করতে আমাদের ভারতের সাহায্য নিতে হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন দেশে ভয়-ভীতিমুক্ত থেকে অধিকার ভোগের মর্যাদা নিয়ে বসবাসের চেতনায় উজ্জীবিত করতে এদেশের সাংবাদিক, লেখক, আইনজীবীসহ সব শিক্ষিত লোকরাই তো সাহসী অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। তবে দেশ স্বাধীন হলেই যে দেশ স্বৈরশাসনমুক্ত হয় তা কিন্তু নয়। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরাও স্বাধীন দেশের লোক ছিল। তাই জাতিকে অধিকার সচেতন করার দায়িত্ব সব দেশেই শিক্ষিত লোকরা পালন করে থাকেন। আর এখানে আমাদের শিক্ষিত লোকদের বিবেকহীনতা জাতির জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিক্ষিত লোকদের ভূমিকা ভিন্ন ন্যায়ভিত্তিক দেশও গড়ে উঠতে পারে না কোথাও। বাস্তবে কোনো না কোনো শিক্ষিত অংশের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়েই দেশে স্বৈরশাসক জন্ম নেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতায় থাকাটাকেই বড় করে দেখতে চান। কারণ ক্ষমতার নেশাই এরকম। রাজনীতিকে তারা নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ হিসেবে দেখতে চান। রাজকীয় জীবনযাপনের লোভ সংবরণ করতে পারেন না। অন্যদের ক্ষমতায় আসার কথা ভাবা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশেষ করে আমাদের মতো গরিব দেশে স্বার্থপর, ক্ষমতালোভী হতে বেশি সময় লাগে না। এমনকি আমলাদের বুদ্ধি নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে যান কীভাবে অন্যায় সুযোগ বিতরণের মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে রাখা যায়। তারা দাবি করতে থাকেন একমাত্র ক্ষমতাসীনরাই দেশপ্রেমিক এবং তাদেরই ক্ষমতায় থাকতে হবে। এ কারণে জনগণের দেশ আর জনগণের থাকল না। জনগণের ভোটে সরকার পরিবর্তনের প্রশ্ন তোলার প্রসঙ্গ তো উঠবেই না।

পাকিস্তান আমলে আমাদের শিক্ষিত লোকদের এত সহজে গণবিরোধী কাজে কেনাবেচা হতে দেখা যায়নি। তখন সাংবাদিকরা সরকারদলীয় কর্মী হওয়ার কথা ভাবতেনও না। সাংবাদিকরা সাংবাদিকতার জন্য আন্দোলন করেছেন জনস্বার্থের পক্ষে কথা বলার জন্য। তখন যেসব সাংবাদিক সরকারি ট্রাস্ট পত্রিকায় চাকরি করতেন তারা বিব্রতবোধ করতেন। তবুও তারা অন্য সাংবাদিকের সঙ্গে মিলে আন্দোলন করেছেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য। সরকারি নির্দেশে দৈনিক ইত্তেফাক বার বার বন্ধ হয়েছে। সাংবাদিকরা বেতন না পেয়ে নিদারুণ আর্থিক অনটনে ছিলেন। তবুও দৈনিক ইত্তেফাককে সরকারের ট্রাস্ট পত্রিকা করা সম্ভব হয়নি।

অল্প কিছুসংখ্যক সাংবাদিকের কথা বাদ দিলে স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকদের গরিষ্ঠ অংশটাই প্রধান দুটি দলের রাজনৈতিক কর্মী বনে গেছেন যেন। একাংশ আওয়ামী লীগের আর অপর অংশ বিএনপির। তাই বলতে হয় এখন সাংবাদিকতা নয়, রাজনীতিবিদদের মতো রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগের ব্যাপারেই অনেকের বেশি আগ্রহ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দাপট দেখাতেও তাদের কারও কারও অসুবিধা হয় না।
সাংবাদিকতা স্বাধীন সত্তা হারাল, সাংবাদিকরা গর্বের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনীতির অংশ হলেন। তারা আর জনগণের পক্ষের শক্তি থাকলেন না। তাদের পরিচয় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট বা বিএনপির রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট।
আমার আব্বাও একজন সাংবাদিক ছিলেন। সেজন্যই হয়তো সাংবাদিকদের দলীয় রাজনীতির কর্মীরূপে দেখতে আমার ব্যথা লাগে। সাংবাদিকদের দেখা হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে। জনগণের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে কথা বলার জন্য সাংবাদিকরা নিজেরাই দাবি করতেন সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই। এ কথার অর্থ দাঁড়ায় ক্ষমতাসীনরা তাদের বন্ধুরূপে দেখেন না। সাংবাদিকরাও ক্ষমতাসীনদের বন্ধুত্ব নিয়ে ভাবতেন না। আজকের চিত্র ভিন্ন। সাংবাদিকদের গণতন্ত্রবিরোধী শাসনব্যবস্থার স্তম্ভ হিসেবে দেখলে গণতন্ত্র বা দেশের জনগণের শাসন পাওয়ার ব্যাপারে হতাশ না হয়ে পারি না।

দেশের এত উন্নয়ন হয়েছে যে রাস্তার পাশে সরকারের বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে পড়ে তা জনগণকে জানতে হয়। একেই বলে আমলাতান্ত্রিক ধোঁকাবাজি। স্বাধীন বাংলাদেশে কেন আমরা এমন অভিশাপের শিকার হলাম? রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রশ্রয় পাচ্ছে। জনস্বার্থ উপেক্ষা করা অতি সহজ হয়েছে। সরকারের অনুগ্রহ লাভের জন্য শিক্ষকরা প্রকাশ্যে দলীয় রাজনীতি করছেন। আবার দলীয় রাজনীতির কারণে অন্যদের প্রতিপক্ষরূপে দেখে তাদের প্রতি অন্যায়ও করা হয়। শিক্ষকদের যদি শিক্ষক হিসেবে দেখার বদলে কে কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক সেই পরিচিতি নিয়ে ভাবতে হয়, তাহলে শিক্ষকরা কিভাবে শিক্ষকের মর্যাদা পাবেন? ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক দলাদলি ও সংঘাতের কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার সুুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। জানি, রাজনীতির প্রয়োজনে সরকারদলীয় লোকেরা চাইবেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা সবাই তাদের ক্ষমতায় থাকার সহযোগী হিসেবে থাকুন এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা অন্যায়ভাবে ভোগ করার সুযোগ লাভ করুন। কিন্তু শিক্ষকদের তো শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে। মানুষ গড়ার মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে। ছাত্রছাত্রীরা হবে মেধা ও নীতি-আদর্শের শক্তি। শিক্ষকরা তো ভাবতে পারেন না যে, অশিক্ষা-কুশিক্ষা দিয়ে আমরা জাতি হিসেবে সাফল্য এবং মর্যাদা অর্জন করতে পারব। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পেশিশক্তি হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আজ লাঠিসোটার মহড়াই দেখছি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষা করে চলা এখন বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। শিক্ষকরা কেন নিজেদের দলীয় রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের দলীয় রাজনীতি থেকে রক্ষা করতে ভূমিকা রাখছেন না? জাতি তো তাদের কাছ থেকে এটাই আশা করে।
আমার নিজের আইন পেশায়ও বিরাজ করছে একই অবস্থা। আইনজীবীরা আওয়ামী লীগ আর বিএনপির সক্রিয় কর্মী। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অতীতের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা আর আইনজীবীদের নেই। তারা দলীয় নেতাদের দলীয় কর্মসূচি পালন নিয়ে ব্যস্ত। বিচার বিভাগের, বিশেষ করে নিন্ম আদালতের জজ-বিচারকদের চাকরি সংক্রান্ত বিধিসমূহ সরকার এমনভাবে করে নিয়েছে যে তাদের নিয়োগ, বদলি বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন প্রেসিডেন্ট। তিনি অবশ্য সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এ ধরনের আলোচনায় সম্মতি পেতে অসুবিধা হয় না। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা কিছু প্রতিবাদ করেছেন। সরকারদলীয় আইনজীবীদের তো প্রতিবাদ করার প্রশ্নই আসে না। সরকার এ ব্যাপারে ১৯৭২ সালের মূল শাসনতন্ত্রের বিধান মানল না।

সামরিক বাহিনীসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করল; রাজনীতিবিদদের সরকার তা ব্যর্থ করে দিল। একেবারে অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হল। মাসের পর মাস যাচ্ছে; কিন্তু প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য রয়ে যাচ্ছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের চিন্তা-ভাবনা নেই। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ প্রধান বিচারপতি ছাড়াই চলছে।
স্বাধীন বিচার বিভাগ হল জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ প্রয়োগের শক্তি। অথচ স্বাধীন বিচার বিভাগের অনুপস্থিতিতে আইনের শাসনের পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা শক্তি অর্জন করে চলছে। বিচারের নামে পুলিশি বিচার চলবে কিনা তাই দেখতে হবে।

দুর্বল হচ্ছে জনগণ। অধিকার হারাচ্ছে জনগণ। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার গঠনের ব্যবস্থা বিলীন হয়ে গেছে। শাসনতন্ত্রে বলা আছে, প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতরা সরকার গঠন করবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও বিনা ভোটে তাদের নির্বাচিত বলা যাবে কিনা সে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে বলা যাবে না যে ভোটাররা তাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে। শাসনতন্ত্র তো বলেছে ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। গত সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ জন ‘নির্বাচিত’ হয়েছে ভোটারদের ভোট ছাড়াই। সেই সরকারের অধীন পুনরায় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। জোর গলায় বলতে অসুবিধা হচ্ছে না যে নির্বাচন তাদের সরকারের অধীনেই হবে।
জনগণের ভোটের সরকার নির্বাচিত না হওয়ার অর্থই হচ্ছে জনগণের কাছে সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা স্বীকার না করা। জনসমর্থন ছাড়া ক্ষমতায় থাকতে হলে তো আইন-কানুন বা শাসনতন্ত্র মেনে চলা সম্ভব নয়। তাই তাদের দুর্নীতির শক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সুবিধাবাদী লোকদের খোঁজা হচ্ছে। জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য জনগণের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভাগাভাগি করা হচ্ছে।

ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে কেলেঙ্কারি তো প্রমাণ করে দিল নির্বাচন কমিশনের না আছে যোগ্যতা না আছে স্বাধীনতা। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন স্থগিত রাখার হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপিল করার আগ্রহ দেখাল না। সাধারণত সুপ্রিমকোর্ট নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দিতে একেবারেই অনিচ্ছুক। মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনও চায়নি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন করতে। আবার নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বলা হচ্ছে, হাইকোর্ট তাদের বক্তব্য সঠিকভাবে রাখতে পারেনি। অথচ আপিল বিভাগে তাদের অবস্থা পরিষ্কার করার সুযোগ নেয়া হল না।
সমগ্র জাতি আজ অন্যায়-অবিচারের কাছে অসহায়। রাজনীতিতে শিক্ষার মর্যাদা নেই। সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষায় শিক্ষিত সমাজ ঐক্যবদ্ধ নয়, বিভক্ত এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি নিয়ে ব্যস্ত। নিজেদের লোকের কাছে জনগণের চরম অসহায়ত্ব দেখতে হচ্ছে।

শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও আমলাদের কাছে রাজনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে। জনগণের পক্ষে সংগ্রাম করার রাজনৈতিক দলও নেই। দেশের সঙ্কট উত্তরণের পথ হতে পারত গণতন্ত্র রক্ষায় রাজনৈতিক সমঝোতা। রাজনীতি নেই, তাই রাজনৈতিক সমঝোতাও আশা করা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ী রাজনীতিকরা নিজেদের লাভের কথা বুঝে থাকে। রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের রাজনৈতিক সমাধান তো তাদের কাছে গ্রহণীয় হতে পারে না। সঙ্কটে আছি; কিন্তু সঙ্কট উত্তরণের নেতৃত্ব কারও কাছ থেকে আশা করা যাচ্ছে না। বলতে গেলে সবাই ব্যবসাপ্রধান রাজনীতির ভাগ-বাটোয়ারা পেতে আগ্রহী।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/13344