১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৩

ঔদ্ধত্যের গণতন্ত্র

গণতন্ত্র বলতে আমরা কী বুঝি?
এ বিষয়ে সম্ভবত কোনো সর্বসম্মত অবস্থান নেই। যারা এ নিয়ে কথা বলেন এবং যারা শোনেন তাদের প্রত্যেকেরই গণতন্ত্র সম্পর্কে নিজস্ব ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ আছে। এ ক্ষেত্রে মতান্তরের চেয়ে মতভেদ অনেক সক্রিয়।
প্রাচীন গ্রীসে যখন গণতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে তখন এর মানে দাঁড়িয়েছিল জনগণের শাসন। যেহেতু সবাই কোনো প্রশ্নে একমত হতে পারেন না, তাই প্রয়োগের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। প্রাচীন গ্রীসে এবং বিশেষ করে যখন অষ্টাদশ শতাব্দীতে শব্দটির পুনরুজ্জীবন ঘটে তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। অবশ্য পরবর্তী সময়ে শব্দটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিকৃতি ঘটে যার ফলে গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষ আস্থাহীন হতে শুরু করে। অনেক রাষ্ট্র নামের সঙ্গে শব্দটি ব্যবহার করলেও মনে হয়েছে তারা পুরো বিষয়টির সঙ্গে প্রতারণা করছে। যেমন জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (জিডিআর) অথবা গণতান্ত্রিক কাম্পুচিয়া। এতৎসত্ত্বেও, এটা মনে রাখা প্রয়োজন গণতন্ত্র অথবা গণতান্ত্রিক শব্দটি এমনভাবে ব্যবহৃত হয় যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের বিন্দুমাত্রও থাকে না।

এই প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে: জনগণ বলতে কী বোঝায় এবং এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ কারা। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৩৫০ শতাব্দী পর্যন্ত এথেন্স ছিল গণতান্ত্রিক, কেননা সেখানে প্রত্যেক নাগরিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু নারী, দাস এবং বিদেশিদের এ অধিকার ছিল না। সে হিসেবে মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ বিবেচিত হতেন নাগরিক হিসেবে। এরপরেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সেই এথেন্সকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করেন। এই সংখ্যার সঙ্গে আবার ভোটাধিকার বা মতপ্রকাশের বিষয়টিও সম্পর্কিত। ১৯১৮ সালে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়ার আগে ব্রিটেনকে সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

জনগণ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দুয়ের আসলে কোনো সহজ-সরল জবাব নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ বলতে বোঝায় অর্ধেকের বেশি। নির্বাচনে দু’জন প্রার্থী হলে সমস্যা হয় না। কিন্তু প্রার্থীর সংখ্যা যখন দু’এর অধিক হয় তখনই সমস্যা দেখা দেয়। এ নিয়ে পণ্ডিতরা সুদূর অতীত থেকে আলোচনা করেও সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি।
দ্বিতীয় আরেকটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। কেন সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের শাসন করবে? খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ দশকে এথেন্সে পেরিক্লিস বলেছিলেন গণতন্ত্রের মানে সহনশীলতা। তিনি অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের পক্ষে দাঁড়াননি। প্লেটো এবং এরিস্টোটল উভয়েই গণতন্ত্রের নিন্দা করেছেন কারণ এর ফলে বিশ্লেষকরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে যান এবং জনগণের শাসন মানেই গরিবের শাসন যারা ধনীদের সম্পদ গ্রাস করে।
সেই থেকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির শাসনের বহু রূপান্তর ঘটেছে। ফরাসি বিপ্লবের সময় ভোটাধিকার বড় লোকের মাঝে সীমিত থাকলেও ১৯৭৩ সালের সংবিধানে তা আরও সম্প্রসারিত হয়। ব্রিটেনে ভোটাধিকার সম্প্রসারিত হয় ১৮৩২ সালে এবং সার্বজনীন ভোটাধিকার অর্জিত হয় ১৯২৮ সালে। তারপরে গণতন্ত্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করেছে।
বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকেই গণতন্ত্র বিভিন্ন দেশে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যেহেতু গণতন্ত্রের একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে জীবনের অধিকার তাই ক্ষমতাসীনরা বিভিন্নভাবে জীবনের অধিকারকে অস্বীকার করছেন। ক্ষমতার ঔদ্ধত্য দিয়ে গণতন্ত্রকে পরিণত করেছেন ঔদ্ধত্যের গণতন্ত্রে।
বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রকে ক্ষমতাসীনরা ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। আর এ কারণেই তাদের গ্রহণ করতে হয় বিভিন্ন পন্থা। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করে হিটলার পরিণত হয়েছিলেন ঔদ্ধত্যের প্রতীকে। তিনি গণতন্ত্রের নামে প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছেন, পার্লামেন্ট ভবনে আগুন দিয়েছেন, বিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছেন এবং নিজের বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়ার জন্য যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু এই ঔদ্ধত্যের পরিণতি হয়েছে করুণ।

গণতন্ত্রের কয়েকটি পূর্বশর্তের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের স্বাধীনতা, ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনগণের নেতা নির্বাচনের স্বাধীনতা সীমিত হয়ে আসছে। ঔদ্ধত্য দিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা।
অতি সম্প্রতি লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলায় ঔদ্ধত্যের গণতন্ত্রের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। জনপ্রিয় নেতা হুগো শ্যাভেজের উত্তরাধিকারী মাদুরো ক্ষমতায় আরোহণের কিছুদিন পর পর্যন্ত ভালোভাবেই দেশ চালাচ্ছিলেন। কিন্তু বিরোধী পক্ষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে মাদুরো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কাজে লেগে যান। মনে করা হচ্ছিল বর্তমান বছরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে বিরোধী দলীয় জোট জয়লাভ করবে। কিন্তু বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মাদুরো বেছে নেন ভোট জালিয়াতি থেকে শুরু করে সব প্রকার গণবিরোধী কৌশল। এর মধ্যে মাদুরো ২০১৭ সালের নির্বাচনে ২৩টি প্রদেশের মধ্যে ১৮টির ক্ষমতা দখল করেছেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মাদুরো নিজের খুশি মতো সংবিধান সংশোধনসহ আইন বদল থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যা করেননি। ২০১৭ সালের গণপরিষদ নির্বাচনে কারচুপি করেছেন ইলেকট্রুনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে, যা এই মেশিনের নির্মাতা স্মার্টমেটিক স্বীকার করেছে।

ভেনিজুয়েলায় এখন নির্বাচন অর্থহীন হয়ে গেছে। কারণ লাগামহীন দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাকার বিষয় মাদুরো সরকারকে এমনভাবে বেঁধে ফেলেছে যে তারা ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। মাদক ব্যবসা এমন পর্যায়ে গেছে যে, ২০১৭ সালে ভেনিজুয়েলার ফার্স্ট লেডির দুই ভাগনে মাদক পাচারের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটানে অভিযুক্ত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন চক্রের অনেকেই মনে করেন ক্ষমতা হারালে মাদক পাচারের অভিযোগে তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বিচার হবে। তাই মাদুরো সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী যাতে ক্ষমতা দখল না করে সেজন্য দেশের ৯৫ ভাগ রফতানি আয়ের উৎস তেল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীকে দিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনসহ সবকিছুই রাজনীতিকীকরণ করেছে, এমনকি নিজের অনুগতদের সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি বানিয়েছে। মোদ্দাকথায়, সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে গণতন্ত্র চর্চার অঙ্গীকারে মাদুরো সরকার ঔদ্ধত্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

মাদুরোর বিভিন্ন গণতন্ত্রবিরোধী পদক্ষেপের কারণে বিরোধী দল নির্বাচনে জয়লাভের আশা ছেড়ে দিয়ে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে। তাদের কেউ কেউ সরকারে বিভিন্ন কার্যক্রমকে অনুমোদন দিয়েছে। এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। এ বছরের নির্বাচনে বিরোধী নেতা লিওপোলডো লোপেজকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে তাকে জেলে পুড়েছে এবং বিরোধীদের সব কার্যক্রমকে পুলিশ ও দলীয় বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্যই মাদুরো ২০১৫ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ভেনিজুয়েলার জনগণের দুঃখ-কষ্ট আকাশ ছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতির কারণে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিরোধী দল সেখানে কিছুই করতে পারছে না। ভেনিজুয়েলার আজকের ট্রাজেডির চেয়ে ভবিষ্যতের ট্রাজেডি আরও করুণ হবে কারণ মাদুরো ক্ষমতা ছাড়তে চাইবেন না।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের ঔদ্ধত্যের অনেক উদাহরণ আছে। কয়েকদিন আগে এমন ঘটনাই ঘটেছে ইরানে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার সব শক্তি প্রয়োগ করেছে। ডিমের মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনকে হাসান রুহানীর সরকার মনে করেছে সরকার উৎখাতের বিরোধী ষড়যন্ত্র।
বাংলাদেশও জন্মলগ্ন থেকেই গণতন্ত্রের ঔদ্ধত্য দেখে আসছে। বর্তমান সময়ে তা চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষকে দমন করা, মামলা দিয়ে পর্যুদস্ত করা, সংসদ সদস্য হওয়ার গুণে যা খুশি করার স্বাধীনতা, ব্যাংক লুট, কণ্ঠরোধ সবকিছুই এখানে আছে। এই ঔদ্ধত্যের কারণেই সংসদ সদস্য তার শিক্ষককে প্রহার করে, সাবেক সংসদ সদস্য ছাত্র-ছাত্রীদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে, ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানে না যাওয়ার অপরাধে রাতের বেলা ছাত্রীকে পথে বের করে দেয়, সংসদে প্রতিপক্ষকে যেমন খুশি তেমন ভাষায় গালিগালাজ করে। এই ঔদ্ধত্যের কারণেই হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লুট উপেক্ষিত হয়। এমন উদাহরণ অসংখ্য। দেশের মানুষ স্বাধীনতার পরেও ঔদ্ধত্যের গণতন্ত্র দেখেছে।
বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার যে বিকৃতি ঘটেছে তার ফলে জনগণ এ ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছে। কিন্তু যারা ঔদ্ধত্যের গণতন্ত্রের নায়ক তারা এটা বুঝতে চান না যে এই ঔদ্ধত্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না। গণতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে কোনো কিছুই টেকসই হবে না। তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে মতপ্রকাশ ও নেতা নির্বাচনের স্বাধীনতা। রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রের গণতন্ত্র হয়ে ওঠার জন্য গণতান্ত্রিকতার কথা বলেন। কোন অবস্থার পরিণতিতে গণতন্ত্র এসেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গণতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই গণতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠায় কী করতে হবে ক্ষমতার নায়করা তা জানেন।
লেখক: সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

https://www.jugantor.com/todays-paper/go-far-away/13316