৩১ জানুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ১:০১

বিশেষজ্ঞদের মত

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করবে

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-বাক-স্বাধীনতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে আগের আইনের মতোই এ আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কা করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আইনটিতে যেসব ধারা ও শাস্তি রাখা হয়েছে তা গণতন্ত্রের সঙ্গেও সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ আইন শুধু গণমাধ্যম কর্মীদের জন্যই বৈরী হবে না, অন্য পেশার মানুষরাও এর অপপ্রয়োগের শিকার হতে পারেন। ভিন্নমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধেও এ আইন একটি হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক এ আইনের বিষয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সোয়া দুইশ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৯১ সালে বিধান করা হয়েছিল কংগ্রেস বা তাদের সংসদ বাকস্বাধীনতা খর্ব করে কোনো আইন পাস করতে পারবে না।

যেকোনো কারণেই বাকস্বাধীনতা খর্ব করার অর্থ গণতন্ত্রকে খর্ব করা। নতুন আইনের ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ধারায় বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যের জন্য দীর্ঘ কারাদণ্ডের যে ব্যবস্থা সেটা গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বাকস্বাধীনতার ওপর এত বিধিনিষেধ থাকার অর্থই হলো আমরা গণতন্ত্র বিসর্জন দিতে চলেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারার আগের ৫৭ ধারার মতোই অপপ্রয়োগ হতে পারে। বিতর্কিত ৫৭ বাতিল হলেও নতুন কিছু ধারায় ৫৭ ধারার বিষয়বস্তু রাখা হয়েছে। যেটা হয়েছে আগে কিছু ধারার শাস্তি জামিন অযোগ্য ছিল, তা এখন জামিনযোগ্য করা হয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর আইনমন্ত্রী বলেছেন, গোপনীয় বা অতি গোপনীয় নথি প্রকাশ গুপ্তচরবৃত্তির মধ্যে পড়বে। এখন কোনটি গোপনীয় আর কোনটি গোপনীয় নয় তা ঠিক করতে হবে। এর ব্যাখ্যা পরিষ্কার করতে হবে। আগে ৫৭ ধারা নিয়ে অপপ্রয়োগের যে অভিযোগ ছিল এখানেও সেটি হয় কিনা তা দেখতে হবে। যদি অপপ্রয়োগ হয় তাহলে এটিও নিবর্তনমূলক আইন হবে। তিনি বলেন, এটাও সত্য যারা প্রযুক্তি ব্যবহার করেন তাদের নিরাপত্তাও থাকতে হবে। গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। এটি আইনের মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে। নতুন আইনটি কিভাবে প্রয়োগ হয় সেটি দেখেই চূড়ান্ত বলা যাবে।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. ফাহমিদুল হক বলেন, আগের ৫৭ ধারায় মত প্রকাশের স্বাধীনতার বাধার বিষয়ে আপত্তি ছিল। এখন ৫৭ ভেঙে এর বিষয়গুলো নতুন ধারায় এসেছে। নতুন যে ৩২ ধারা যুক্ত হয়েছে তা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মতো। এই আইনের মাধ্যমে সিরিয়াস সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আগের আইনে কিছু ধারার শাস্তি ছিল জামিন অযোগ্য। তা এখন জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এটি এ আইনের ভালো দিক।

তিনি বলেন, নতুন আইনের কিছু ধারায় মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বা হবে। ডিজিটাল মাধ্যমের অপরাধ এর শাস্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে আমাদের মৌলিক পুরনো অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হবে। তিনি বলেন, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতার অংশ হিসেবে প্রকাশে প্রতিবাদের সুযোগ এখন কমে গেছে। মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সরব। হয়তো তা দমানোর জন্যই এমন আইন। এটি অগণতান্ত্রিক আচরণ।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি ও একুশে টেলিভিশনের সিইও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সন্ত্রাস দমনের জন্য একটা আইন করা হচ্ছে। আমরা মনে করি ডিজিটাল পদ্ধতিতে যে রকম অপরাধ হয় সেটাকে মোকাবিলা করার জন্য এরকম একটা আইন করা দরকার। কাজেই যারা রাষ্ট্রের, সমাজের, মানুষের ক্ষতি করতে চায় তাদের দমনের জন্য এরকম একটা আইন থাকা দরকার। আমাদের উদ্বেগ হচ্ছে অপরাধীদের জন্য প্রণীত আইনটা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় কিনা। তিনি আরো বলেন, যখন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা করা হয়েছিল তখনও বলা হয়েছিল যে এটা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য করা হবে। পরবর্তীকালে দেখা গেল যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সেটার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। কাজেই সেটার আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। স্বাভাবিকভাবে এই আইনে অনেক অপরাধের চেহারা দেখতে পাচ্ছি। যেগুলোর মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা আছে। এরকম আইন পাস হলে যারা আইন প্রয়োগ করবেন তারা সাংবাদিকদের ওপর অপপ্রয়োগ করতে পারেন। আমাদের দাবি শুধু খসড়া অনুমোদন হয়েছে। এটা চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংবাদিকদের যুক্ত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, অনেক সময় মন্ত্রীরা এটা স্বীকারও করেছিলেন যে আইসিটি অ্যাক্টে যে ৫৭ ধারা এটা অত্যন্ত গণবিরোধী, অগণতান্ত্রিক একটা আইন। কারণ এটা আইনের শাসনের জন্য খারাপ। এটা কেউ কেউ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এটা এক ধরনের প্রতিশ্রুতি ছিল যে ৫৭ ধারা বাতিল করা হবে। কিন্তু আজ ৫৭ ধারার বাতিল না করে বরং ৫৭ ধারার চেয়ে আরো খারাপ বিধান ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ঢুকানো হয়েছে। এটা পুরা জাতিকে ধোঁকা দেয়া, ধাপ্পা দেয়া ছাড়া আর কিছু না। ড. আসিফ নজরুল বলেন, সমস্যা হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বিভিন্ন অপরাধকে অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই অস্পষ্ট সংজ্ঞায়নের সুযোগ নিয়ে যেকোনো ব্যক্তির পক্ষে বিশেষ করে যারা সরকারের বিরুদ্ধে ভিন্নমত পোষণকারী রয়েছে বা যারা সৎ সাংবাদিকতা করছেন বা যারা কোনো মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি তুলে ধরছেন, কুশাসন তুলে ধরছেন বা নিপীড়ক কোনো সংস্থার কার্যক্রম তুলে ধরছেন সমস্ত কিছুতে শাস্তি দেয়ার সুযোগ এই আইনে রয়েছে। এই আইনে কতটা কঠোরভাবে প্রয়োগ হবে জানি না। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন শুধু গণমাধ্যম নয়, অন্য পেশার লোকদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে মনে করেন ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, একটা আইনে যখন এ ধরনের সুযোগ রাখা হয় বিরোধীদল বা সরকারের সঙ্গে ভিন্নমতপোষণকারী, সরকারের সমালোচক শুধুমাত্র না যেকোনো গণমাধ্যমকর্মী, এনজিও, সিভিল সোসাইটি যে কাউকে এই আইনের অধীনে পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার করা এবং অনির্দিষ্টকাল যাবৎ বিচারের যে ভোগান্তি, অনিশ্চিয়তা, শাস্তিদানের যে বিধান রয়েছে এটা এমন ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি করবে বাংলাদেশের ভিন্ন মতের চর্চা করা, সৎ সাংবাদিকতা করা, সরকারের অন্যায় অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আরো বেশি কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। এই আইন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এটা ৫৭ ধারা এবং আইসিটি অ্যাক্টের চেয়েও খারাপ একটা আইন।

ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, এটাতে তো উদ্বেগ আরো বাড়ছে। যে বিষয়গুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারার উদ্বেগ ছিল এটার ধারার এদিক ওদিক করা হয়েছে। কিন্তু একই উদ্বেগ রয়ে গেছে। এটা কোনো অংশেই ভালো আইন না। আরো কঠোর কিছু বিষয় আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেমন কোনো একটা অফিসের ঘটনা গোপনে ধারণ করি সেটা তো জনস্বার্থে করি। নিজেদের স্বার্থে করি না। এটা তো কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যেগুলো আমাদের অনুসন্ধানী রিপোর্টকে অনুৎসাহিত করবে এবং যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এটা নিবর্তনমূলক একটা আইনে পরিণত হয়েছে। আমরা যে আশা করেছিলাম তথ্যপ্রযুক্তি আইন বাতিল করে নতুন একটি আইন করা হবে যেটি গণমাধ্যমসহ আরো অনেক বিষয়কে মুক্ত চিন্তার বিকাশে সহায়তা করবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। দুঃখজনকভাবে দেখছি আরো কঠোর আইনের দিকে গিয়েছে সরকার। এটা আমাদের আরো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। মিডিয়ার সকল পক্ষের মানুষ চিন্তিত। এ ধরনের আইন কেন করা হলো কি কারণে করা হলো বুঝতে পারলাম না আমরা। আশা করি চূড়ান্তভাবে এটা আইন হিসেবে সংসদে অনুমোদন হওয়ার আগে সকল পক্ষের সঙ্গে তারা মতবিনিময় করবেন। প্রকৃত উদ্বেগুলো চিহ্নিত করে তারা এটা সংশোধনের ব্যবস্থা করবেন।

সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের যে বিকাশ এবং বিস্তৃতি হচ্ছিল সে জায়গায় অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ চলছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভেতরে এমন এমন বিধান, নিয়মকানুন সংযুক্ত করা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মুক্ত সাংবাদিকতা বলতে আর কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। বাংলাদেশের মুক্ত সাংবাদিকতা খুব বড়ভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাস্তবায়ন হলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বিষয়টি এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে একটি দুর্নীতির রিপোর্ট যদি করতে হয় তাহলে দুর্নীতিবাজের কাছে একজন সাংবাদিককে যেতে হবে এবং তাকে গিয়ে বলতে হবে যে আপনি দুর্নীতি করেছেন এবং আপনার দুর্নীতির রিপোর্ট আমাদের দেন। যদি দুর্নীতিবাজ সাংবাদিককে তথ্য-প্রমাণ দেয়, তাও শুধু মৌখিকভাবে দিলে হবে না। লিখিতভাবে দিতে হবে। যদি দেয় তাহলে সাংবাদিক সেই রিপোর্টটা করতে পারবেন। যদি সে লিখিতভাবে অনুমতি না দেয়, শুধু মৌখিকভাবে অনুমতি দেয় তারপর কোনো সাংবাদিক তথ্য-প্রমাণ নিয়ে এসে লেখেন, তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির মামলা হতে পারে। তার জন্য ১৪ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। গোলাম মোর্তোজা আরো বলেন, এটা ৫৭ ধারার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর এবং নিপীড়নমূলক। অর্থাৎ সাংবাদিকতার নিজস্বতা, অনুসন্ধান, স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকবে না যদি এখন পর্যন্ত যেভাবে আমরা দেখছি, মন্ত্রিসভায় যেভাবে দেখছি এভাবেই যদি আইন পাস করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলী আর রাজী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আগের ৫৭ ধারা থেকেও নিকৃষ্ট। শুধু সাংবাদিকতা নয় দেশের গণতন্ত্রের জন্য এটি একটি নিবর্তনমূলক আইন। যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কোনো সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্র এখানেও মানুষের যে তথ্য পাওয়ার ও প্রচার করার অধিকার কিংবা বাক স্বাধীনতা রয়েছে তাকে হরণ করার অপপ্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সরকারি কর্মচারীদের নানারকম অপকর্ম, দুর্নীতি ঠেকানোর একটি হাতিয়ার হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=102922