৩০ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০৪

ডিএসসিসির কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি অনিয়ম

তদন্তে কমিটি হচ্ছে

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বিভিন্ন পণ্য কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া ডিএসসিসির এ সংক্রান্ত ক্রয় বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ করা হয়েছে। সম্প্রতি এ ব্যাপারে কয়েকজন ঠিকাদার ডিএসসিসির মেয়রসহ বিভিন্ন দফতরে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ডিএসসিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে তদন্ত করা হচ্ছে। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা যায়, ডিএসসিসির ২১টি বিভাগের ব্যবহৃত মালামালের কমবেশি জোগান দেয় সংস্থাটির ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগ। এ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজই হচ্ছে প্রয়োজনীয় সব মালামাল ক্রয়, মজুদ রাখা ও সময়মতো চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা। এ জন্য ডিএসসিসির বাজেটে প্রতি অর্থবছরের জন্য ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। বরাদ্দকৃত অর্থের বিনিময়ে ওই বিভাগটি প্রায় তিন শতাধিক আইটেমের মালামাল সংগ্রহ করে।
অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন মালামাল বা পণ্য কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে লুটপাটে মেতেছেন সংশ্লিষ্ট দু-একজন। এ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা কয়েকবার অভিযোগ দিলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি ডিএসসিসির প্রশাসন। উল্টো সহজ সরল দু-চারজনকে সন্দেহের তালিকায় ফেলে তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ দিয়ে হয়রানিসহ বরখাস্তের নজির রয়েছে।

এ ছাড়া ডিএসসিসির ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠলেও তারা বহালতবিয়তেই আছেন সংস্থাটির শীর্ষপর্যায়ের কারো কারো আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে। যার কারণে ওই বিভাগে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
সম্প্রতি এ ব্যাপারে চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা অভিযোগের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ডিএসসিসির মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন দফতরে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ডিএসসিসির সচিব শাহাবুদ্দিন খান নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করা হবে। এ জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এতে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযোগ প্রদানকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারটি হচ্ছেÑ ফোর পি লজিস্টিকস, মেসার্স স¤্রাট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, মেসার্স মালিহা এন্টারপ্রাইজ ও মুক্তা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। তারা পাঁচ পৃষ্ঠার লিখিত অভিযোগটি মেয়রের বরাবরে দাখিল করেন ২০১৭ সালের ২৩ জুলাই। অজ্ঞাত কারণে অভিযোগটি ফাইলবন্দী হয়ে আছে।
এর আগেও ২০১৪ সালে ১২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা অভিযোগ করে লিখিতভাবে সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছিল। ওই সময়ও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি জড়িতদের বিরুদ্ধে। যার কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন দিনের পর দিন।

অভিযোগে জানা যায়, উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা প্রেষণে ডিএসসিসির প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ২০১৫ সালের ২ জুলাই যোগদানের পরই তার ব্যক্তিগত সহকারীকে (পিএ) নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এরপর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তারা ঘুষ ছাড়া কোনো কাজে হাত দেন না, কোনো কাজ করেন না। বিভাগীয় প্রধানের আশীর্বাদ পেয়ে ব্যক্তিগত সহকারী হয়ে পড়েন বেপরোয়া। তিনি যোগসাজশ করে অফিসের সব গোপন তথ্য পছন্দের ঠিকাদারকে আগেভাগেই দিয়ে দেন। একই সাথে নিজের পছন্দ অনুযায়ী একই ঠিকাদারকে বারবার কাজ পাইয়ে দেয়া শুরু করেন। এরপর ঠিকাদাররা কাজ পেলে কার্যাদেশ দেয়ার সময় প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তার স্বাক্ষর করিয়ে দেয়ার কথা বলে ঘুষ দাবি করেন। ঠিকাদাররা ঘুষ না দিলে ফাইল আটকে রাখেন। এ ছাড়া মালামাল সরবরাহ করার সময় বিভাগীয় প্রধানের স্বাক্ষরের কথা বলে আবারো ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ না দিলে মালামাল খারাপ বলে ফেরত দেয়ার ভয় দেখান। এরপর টাকা দেয়ার পর বিল নেয়ার জন্য ফাইল উপস্থাপন করতে তিনি নিজের জন্য আরো ঘুষ দাবি করেন। না দিলে প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তার স্বাক্ষর করান না। নিয়ম অনুযায়ী বিভাগের ভাণ্ডার রক্ষকদের কেনাকাটার বিষয়টি দেখার কথা। ডিএসসিসিতে বর্তমানে তিনজন ভাণ্ডার রক্ষক থাকার পরও তাদের কোনো কাজ দেয়া হয় না। বরং প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয়কর্মকর্তা ও তার ব্যক্তিগত সহকারী যোগসাজশ করে সব কেনাকাটা সম্পন্ন করেন।
শুধু তাই নয় তারা যোগসাজশ করে বিভিন্ন কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। পিপিআর ২০০৮ অনুযায়ী বছরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকার বেশি টাকার কোটেশন ৬৯ (১) বা সরাসরি ৮১ (১) কোনো পণ্য কেনাকাটা করা যাবে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করে তারা টাকার সীমা অতিক্রম করে ইচ্ছামতো নিজেরাই কোটেশন ও সরাসরি কেনাকাটা করছেন। এভাবে বিভিন্ন মনোহরী সামগ্রী কিনে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয় একই পণ্য কেনায় দুইবার বিল নিয়েছেন।
ডিএসসিসির ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বই ছাপানোর কাজেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ১০০ জিএসএম আর্ট পেপার ও ৩০০ জিএসএম আট কার্ডের কভার সমৃদ্ধ বাজেট বই ছাপাতে সর্বোচ্চ প্রতিটি ৬০ টাকা খরচ হওয়ার কথা, অথচ এ বই ছাপানো হয়েছে প্রতিটি ২৮৫ টাকা দরে। যাতে প্রতিটি বই থেকে ২১৫ টাকা হিসেবে এক হাজার বই ছাপিয়ে দুই লাখ ১৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

তবে সবচেয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে মশার ওষুধ কেনাকাটায়। প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয়কর্মকর্তা এবং তার ব্যক্তিগত সহকারী কোনো প্রকার উন্মুক্ত টেন্ডার বা ই-টেন্ডার ছাড়াই নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডকে কার্যাদেশ দিয়েছেন। এ কোম্পানির মাধ্যমে ডিএসসিসি এ পর্যন্ত ৩২ কোটি টাকার ওষুধ কিনেছে। এ জন্য ডকইয়ার্ডের কাছ থেকে তারা দুই শতাংশ হারে ৬৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মশার ওষুধ কেনা বাবদ দুই শতাংশ কমিশনের টাকা পাওয়ার পর কয়েকভাগে ভাগ হওয়ার রীতি রয়েছে। এ রীতি অনুসারে প্রধান ভাণ্ডার কর্মকর্তা পেয়ে থাকেন ২৫ শতাংশ, তার পিএ পান ১৩ শতাংশ, দু’জন ভাণ্ডার ও ক্রয়কর্মকর্তা পান ১৩ শতাংশ করে। বাকিটা ওই বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। কিন্তু ওই সিন্ডিকেট সক্রিয় হওয়ার পর থেকে কমিশনের ভাগ কেউই পান না বলে জানা যায়।
ওই বিভাগে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, প্রতি মাসে জরুরি ভিত্তিতে নগদে কিছু প্রয়োজনীয় মালামাল কেনাকাটার জন্য ইমপ্রেসড মানি বাবদ এক লাখ টাকা দেয়া হয়। এ টাকা ওই বিভাগের চারজন ভাণ্ডার রক্ষকের কাছে ভাগ করে দেয়ার কথা। তারা হাতে টাকা রেখে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় মালামাল কিনে নেবেন। অভিযোগ উঠেছে, এ ইমপ্রেসড মানির টাকা পুরোটাই সিন্ডিকেটের হাতে রাখা হয়। মাস শেষে ভুয়া বিল ভাউচার করে ওই টাকা অ্যাডজাস্ট দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয়।

অভিযোগে আরো বলা হয়, এভাবে বছরের পর বছর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে ওই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বর্তমানে বেশ কয়েকটি বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। মিরপুরের বড়বাগ বসতি হাউজিংয়ের ১ নং রোডের ৩ নম্বর বাড়ির তৃতীয়তলায় সি-২ ফ্ল্যাট কিনেছেন। তিনি চিড়িয়াখানা রোড সংলগ্ন বেড়িবাঁধ এলাকায় আট কাঠা জমি কিনেছেন। এ ছাড়া তিনি সাদা রঙের একটি নোয়া গাড়ির (ঢাকা মেট্রো-চ-১৫-৪৫৬৮) মালিক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির ক্রয় বিভাগের কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার নানা হয়রানির শিকার ওই বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিভিন্ন সময়ে তিনি প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তার কাছে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেন, নোট দেন। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেন প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা।
জানা যায়, প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা তার নিজের লেখা বই (শাওন সঙ্গীত) ডিএসসিসির বেশ কয়েকজন ঠিকাদারের মাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। এভাবে তিনি প্রায় দেড় কোটি টাকার বই ছাপিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে ১৬-১৭ জন রয়েছেন। তার মধ্যে প্রধান ভাণ্ডার কর্মকর্তা ও তার ব্যক্তিগত সহকারী মিলে গড়েছেন একটি সিন্ডিকেট। ওই বিভাগের লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অপবাদ সইতে না পেরে বাকিরা হয়রানির ভয়ে সবাই চুপসে আছেন। মাঝখানে একজন ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নেন। সহকর্মীসহ অন্যরা তাকে অনুরোধ করে দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেন। আবার অনেকেই ওই বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে স্বেচ্ছায় বদলির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা সাখাওয়াৎ হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, কোনো অভিযোগই সত্য নয়। বরং ডিএসসিসিতে যোগদানের পরপরই যত অনিয়ম দুর্নীতি ছিল তা সবই বন্ধ করেছেন। এ জন্য তার বিরুদ্ধে এসব করা হচ্ছে। তিনি বলেন, গত ২-৩ মাস ধরে ইমপ্রেসড মানি বন্ধ রয়েছে। ফ্রেম ওয়ার্ক নামে একটি প্রতিষ্ঠান বছরজুড়েই এখানকার সব কাজকর্ম করছে বলে তিনি জানান।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/289473