৩০ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫০

রোহিঙ্গা সমস্যা প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ ও করণীয়

গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং মিয়ানমার সরকারের মধ্যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন ৩০০ এবং প্রতি সপ্তাহে ১৫০০ করে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ফেরত যাবার কথা এবং দু’বছরের মধ্যে এভাবে সকল উদ্বাস্তুকে মিয়ানমার সরকারের ফেরত নেয়ার কথা। এই উদ্দেশ্যে গত ১৯ ডিসেম্বর দু’দেশের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপও গঠন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, মিয়ানমার সাইডে দুটি ক্যাম্প স্থাপন করা হবে। একটিতে উদ্বাস্তু গ্রহণ করা হবে, দ্বিতীয়টিতে যাচাই-বাছাই করা হবে। গত ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ থেকে এই প্রত্যাবসানের কাজ শুরু হবার কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের অসহযোগিতার কারণে তা শুরু না হয়ে স্থবির হয়ে গেছে। ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব মাহমুদ আলী এ ব্যাপারে বিদেশী কূটনীতিকদের একটি ব্রিফিং দিয়েছেন। ব্রিফিং-এ প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন এবং বলেছেন যে এ কাজটি কখন শুরু হবে তা বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সরকার চুক্তিটি ভঙ্গ করেছে বলে মনে হয়। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার কি পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তা এখনো জানা যায়নি। যে কোন আন্তর্জাতিক চুক্তিরই একটি Safety Clause থাকে, চুক্তি ভঙ্গ করলে এই Clause অনুযায়ী সংক্ষুব্ধ পক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এই চুক্তিতে এ ধরনের কোন অনুচ্ছেদ আছে কিনা এবং থাকলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালত বা অন্য কোথাও প্রতীকার দাবি করবে কিনা সে সম্পর্কে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করা দরকার।

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যা একটি বিরাট সমস্যা, বিশেষ করে বাংলাদেশের ন্যায় জনবহুল দরিদ্র দেশের পক্ষে এর মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন। মানুষ হিসেবে মানবেতর দাবি অনুযায়ী আমরা তাদের সাহায্য করতে বাধ্য। কিন্তু তাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে প্রত্যাবাসন। প্রত্যাবাসন চুক্তি ব্যর্থ হতে দেয়া যায় না। ইতোপূর্বে বাস্তুহারাদের ব্যাপারে মিয়ানমার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পসমূহে ১০০০ পুলিশ এবং ২২০ জন ব্যাটেলিয়ন আনসার নিয়োজিত রয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ৬,৭৩,১২৩ জন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আসতে বাধ্য হয়েছে। এর আগের ৩ লাখ মিলিয়ে এখন মোট উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১৩ লাখ। রোহিঙ্গা শিবিরসমূহে এই সময়ে ১৩৬২টি শিশু জন্মগ্রহণ করেছে এবং সরকারের সমাজসেবা অধিকতর এদের মধ্যে ৩৬৩৭৩ জন শিশুকে এতিম/অনাথ চিহ্নিত করেছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ৪১টি মেডিকেল টিম রোহিঙ্গা শিবিরসমূহে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে এবং জাতিসংঘসহ দেশ-বিদেশের ৯২টি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাদের বিভিন্ন পরিসেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিভাগীয় কমিশনারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত তাদের জন্য এনজিও ব্যুরো ৪৬৫ কোটি ৮০ লাখ ১৫ হাজার টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে। সাহায্য ও অনুদানের প্রবাহ আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে কিছু কিছু গোয়েন্দা সংস্থার অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক কিছু কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় এই প্রবাহ আরো হ্রাস পেতে পারে বলে অনেকে আশংকা করছেন। এই অবস্থায় চুক্তি অনুযায়ী যদি প্রত্যাবাসনের কাজ সম্পন্ন না হয় তাহলে উদ্বাস্তু নিয়ে বাংলাদেশকে বিরাট সংকটে পড়তে হতে পারে।

এই অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে আরো সতর্ক থাকা এবং বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে আমি মনে করি। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমার সরকার ও সেখানকার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অত্যাচার নিপীড়নের ঘটনা আজকে নতুন নয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকেও তাদের উপর অত্যাচার হয়েছে এবং দলে দলে তারা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আশ্রয়ের জন্য এসেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ছাড়া এর আগের সরকারগুলো এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে কিন্তু মিয়ানমারের অসহযোগিতার জন্য সমস্যাটির সমাধান হয়নি। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে তারা সর্বদা কূটনৈতিক কূটচালের আশ্রয় নিয়েছে এবং বলেছে যে, যারা নাগরিকত্বের প্রমাণ দেখাতে পারবে তাদেরকেই তারা ফেরত নেবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে উৎপীড়িত নির্যাতিত পল্লী গ্রামের বাসিন্দা এ সমস্ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে, তাদের চোখের সামনে আপনজনদের হত্যা করে, তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ লুট করে এবং তাদেরকে মারধর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে তাতে তাদের সাথে কি নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কোন দলিল আনা সম্ভবপর ছিল। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য কোন কোন দেশে জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টের কপি প্রভৃতি এবং জমির দলিল/পরচা, বিদ্যুৎ, পানি ও টেলিফোন পরিসেবার বিল পরিশোধের প্রমাণপত্র চাওয়া হয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেই দেশের হিংস্র বৌদ্ধভিক্ষুরা এই দলিলগুলো তাদের আনতে দেয়নি, জ্বালিয়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই এবং সেটা হচ্ছে তারা যেন সে দেশে ফিরে গিয়ে নাগরিকত্ব এবং সম্পত্তি দাবি করতে না পারে। ইতোপূর্বে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের আরেকটি প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী একই অজুহাতে মিয়ানমার সরকার ছয় লক্ষাধিক উদ্বাস্তুকে গ্রহণ করেনি। তারা এখনও বাংলাদেশের মাটিতে দুঃসহ জীবন যাপন করছে। তাদের নিয়ে গত ৭ মাসে আসা উদ্বাস্তুদের সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ অতিক্রম করেছে। তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক নয়। এই সরকার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে যতটুকু জনমত গঠন করার কথা ছিল তা পারেনি। বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের নীতি-নৈতিকতা অনুযায়ী যতটুকু ইতিবাচক অবস্থানে আছে তাকেও আমরা সংহত করে কাজে লাগাতে পারিনি।

পাঠকদের হয়তো মনে আছে যে, মিয়ানমার সরকার, তার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে ২০১২ সালের জুন মাসে যখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে আসা শুরু করে তখন বাংলাদেশ সরকার নীরব ভূমিকা পালন করে। রাখাইন রাজ্যের মংগদু, আকিয়ার, টাংগস ও বুচিডং এলাকায় সরকারি ছত্রছায়ায় মুসলিম অধ্যুষিত শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া হয় তখন অসংখ্য নারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক ও মহিলাকে তারা হত্যা করে। যুবতি মেয়েদের ইজ্জত নষ্ট করে। এই অবস্থায় আশ্রয় লাভের আশায় যখন তারা সাঁতরিয়ে ও নৌকাযোগে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে আসতে থাকে তখন ঐ বছরেরই (২০১২) ১৪ জুন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক প্রতিনিধি ক্লেইগ স্যান্ডার্স, ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকোলাস ডিন এবং ঢাকাস্থ কানাডীয় হাই কমিশনার হিদাব ক্রডেন প্রমুখ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিজানুল কয়েসের সাথে সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার অনুরোধ করেন। তাদের এই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি ৩০০ বিধিতে জাতীয় সংসদে একটি বিবৃতি দেন। রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ার জন্য জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ পশ্চিমা দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দিপুমনি বলেছিলেন যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আমরা বাধ্য নই। অনুরোধকারী দেশ এবং সংস্থাগুলোকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ না করে তাদের উচিত তাদের বন্ধু রাষ্ট্র মিয়ানমার সরকারের কাছে সংকট নিরসনে অনুরোধ করা। মিয়ানমারের সহিংসতার পেছনে জামায়াতে ইসলামীর ইন্ধন রয়েছে বলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন। সরকারের এই অবস্থান ছিল অবাস্তব ও নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক এবং ঠিক তেমনি দেশের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দলের উপর দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার অপপ্রসায়। এই বিপদে সরকার দেশবাসী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা চাইতে পারতেন কিন্তু তা না করে নিষ্ঠুরতা ও নোংরামীর পরকাষ্ঠা প্রদর্শন করলেন।
এটা না করে যদি তখন সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতেন এবং তাদের ইস্যুটির অনুকূলে দেশে বিদেশে জনমত গঠন করে তাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করতেন তা হলে অবস্থা ভিন্নতর হতো। বাংলাদেশ সরকার দায়িত্ব অবশ্য নিয়েছেন তবে পানি অনেক ঘোলা হবার পর। দুষ্ট লোকদের মতে নোবেল পুরস্কারের লোভ। কিন্তু তাত জুটল না। ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের উপর তদন্ত করেছেন কিন্তু সংস্থার রিপোর্টেই এই সহিংসতার পেছনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ইন্ধনের কথা বলা হয়নি। এই অসত্য কথাটি বলে সরকার এই নির্যাতনের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারকেই উৎসাহিত করেছেন। উদ্বাস্তুরা মিয়ানমারের নাগরিক এটা প্রমাণ করার জন্য নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা অন্য কোন দলিলের প্রয়োজন হয় না। সরকার সক্রিয় হলে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় তা সহজে প্রমাণ করা যায় অথবা মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা যায়। আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে মিয়ানমারের অবস্থা আমাদের তুলনায় এত উন্নত নয় যে আমাদের নাগরিকরা অভিবাসন অথবা জীবনযাত্রার তাগিদে সেখানে যাবে। এরা তাদেরই নাগরিক যাদের তারা বাংলাদেশের নাগরিক বলে তাড়িয়ে দিচ্ছে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে চার শতাব্দরীও বেশী সময় ধরে মুসলমানেরা বার্মারা আরাকান রাজ্য শাসন করেছে। আরাকানের বর্তমান নাম হচ্ছে রাখাইন রাজ্য। ১০০ থেকে ৭৮৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলটি বিভিন্ন হিন্দু রাজবংশের শাসনাধীন ছিল। তখন বার্মার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে আরাকানে অনেক মুসলিম বণিক ও ধর্ম প্রচারক ব্যবসা বাণিজ ও ইসলাম প্রচার করেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম যেসব মুসলিম সাধক আশিয়ার দ্বীপে ৬৬০ খৃষ্টাব্দে এসে ইসলাম প্রচার করেছিলেন, তাদের মধ্যে বদরশাহ আউলিয়া এবং বাবাজি শাহ মুনায়েম দরবেশের নাম উল্লেখযোগ্য। ৭৮৮ থেকে ৯৫৭ পর্যন্ত চন্দ্রবংশের শাসকরা আরাকান শাসন করেন। এই সময়ে মুসলিম মনীষীরা বার্মার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটান এবং হাজার হাজার স্থানীয় বাসিন্দা ইসলামে দীক্ষিত হন। একই সময়ে আরাকানের শাসক নরমেখলা ইসলামধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেন। তিনি মুকু রাজবংশের প্রতিনিধি ছিলেন। নরমেখলা তথা সোলায়মান শাহ’র পর আরো দশজন মুসলিম শাসক ১৪৩০ থেকে ১৫৩১ সাল পর্যন্ত আরাকানের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ১৫৩১ সালে যাবুক শাহ মিন বিন সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি ১৫৫৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। ১৫৫৩ সালে ডিক্কা নামক একজন বৌদ্ধ মগ সিংহাসন দখল করেন। তার দুঃশাসনে মানুষ অতীষ্ঠ হয়ে বাংলার সুলতান সামছুদ্দিন মোজাফফর শাহর সাহায্য কামনা করেন এবং সুলতানের সেনাবাহিনী ডিক্কার শাসনের অবসান ঘটান এবং মুহাম্মদ শাহর উত্তরসুরী গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহ বাংলার সুলতানের অধীনে আরাকান শাসন করেন। ১৫৬০ থেকে ১৫৭১ পর্যন্ত আরাকান রাজ্য দুজন রাজা যথাক্রমে সাহলা ও সিনসেক্কার অধীনে ছিল। ১৫৭১ সালে সিকান্দার শাহ শাসন ক্ষমতায় আসেন এবং ১৫৯৩ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। ১৫৯৩ থেকে ১৬১২ পর্যন্ত সেলিম শাহ, ১৬১২ থেকে ১৬২২ পর্যন্ত হোসেন শাহ এবং ১৬২২ থেকে ১৬৩৮ পর্যন্ত দ্বিতীয় সেলিম শাহ আরাকান শাসন করেন। এ সময় সুদূর বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও ভুলুয়া তথা নোয়াখালী পর্যন্ত আরাকান রাজ্যের সীমা বিস্তৃত ছিল। ১৬৩৮ সালে দ্বিতীয় সেলিম শাহ’র মৃত্যুর পর এই অঞ্চলটিতে মুসলিম শাসনের অবসান হয়। এটি পর্তুগীজ জলদস্যু ও পরে বৃটিশদের করতলগত হয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী বার্মার শাসকরা স্বৈরাচারী হয়ে উঠেন এবং আরাকানসহ দেশটির মুসলিম বাসিন্দাদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন শুরু করেন। তারা অপপ্রচার শুরু করেন যে এরা সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক, এদের পূর্ব পুরুষরা বাঙ্গালী, আসলে তা নয়, রোহিঙ্গাসহ আরাকান বা মিয়ানমারে মুসলিম বাসিন্দাদের কেউই বাইরে থেকে আসা কোন অভিবাসী নয়। তারা সেখানকার মূল ভূখ-েরই বাসিন্দা, জন্ম ও উত্তরাধিকার সূত্রে সে দেশেরই নাগরিক, ভূমিপুত্র। এই সত্য কথাটি আমাদের জোর দিয়ে বলতে হবে এবং আমাদের কূটনৈতিক মিশনসমূহ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রভৃতির মাধ্যমে সারা দুনিয়াকে এই সত্যটি জানিয়ে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফেরৎ নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। চুপ করে থাকলে এ সংকটের সমাধান কখনো হবে না।
যতদিন পর্যন্ত তাদের প্রত্যাবাসন না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ, তাদের অন্ন বস্ত্র ও চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদাগুলো মিটানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য কামনা করা দরকার। তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী। তা না হলে এদের মধ্য থেকে অনেক অপরাধীর সৃষ্টি হয়ে আমাদের জীবনযাত্রাকে বিপদ সংকুল করে তুলতে পারে।

 

http://www.dailysangram.com/post/317248