২৯ জানুয়ারি ২০১৮, সোমবার, ১০:০৫

গুজবে অস্থির শেয়ারবাজার

সাড়ে ৩ মাসে সর্বোচ্চ দরপতন

নতুন বছরের শুরুতে চরম বিভ্রান্ত শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা। বছর শুরুর এ সময় নতুন বিনিয়োগের মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও বড় বিনিয়োগকারীরা উল্টো শেয়ার বিক্রি করছেন। এতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে শেয়ারবাজারে। মূলত নতুন মুদ্রানীতি সংকোচনমুখী হওয়ার আগাম ইঙ্গিত বর্তমান বাজারকে প্রভাবিত করছে বেশি। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের সীমাতিরিক্ত আমানত ফিরিয়ে দিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবিকে শেয়ার বিক্রি করতে হচ্ছে- এমন গুজবে গত ডিসেম্বরে এই দরপতন শুরু হয়। এই দুই ইস্যুকে ঘিরে নানা গুজবই চলতি দরপতনের বড় কারণ।

এ অবস্থায় নতুন করে বিনিয়োগ তো দূরের কথা, অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রায় দুই মাস ধরে তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করছেন। কৌশলীরা গত ডিসেম্বরে শেয়ার বিক্রি করে এখনও হাত গুটিয়ে রেখেছেন। দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এসব ইস্যুতে কোনো বিবৃতি না থাকায় নানান বিভ্রান্তিতে পড়ে অধিকাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী রয়েছেন সিদ্ধান্তহীনতায়। কখনও শেয়ারদর একটু বাড়লেও পরক্ষণেই তা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থার সুযোগও নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। দরপতনকে উস্কে দিতে তারা বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করেছেন। গতকালের লেনদেনের শুরুতেও ব্যক্তি শ্রেণির একাধিক বড় বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রি দরপতনকে ত্বরান্বিত করেছেন বলে জানা গেছে।

গত সপ্তাহটি তুলনামূলক ভালো গেলেও চলতি সপ্তাহের শুরুতেই বড় দরপতন হয়েছে। গতকাল রোববার দেশের দুই শেয়ারবাজার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই ও সিএসই) লেনদেন হওয়া ৮১ শতাংশ শেয়ারের দরপতন হয়েছে। এতে প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭১ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ১৪ শতাংশ হারিয়ে ৬১৪৪ পয়েন্টে নেমেছে। এ দরপতন গত সাড়ে তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত ৯ অক্টোবরের পর সূচকের এত বড় পতন হয়নি।

সাম্প্রতিক দরপতনের ধারা শুরু হয় গত নভেম্বরের শেষে। গত ২৬ নভেম্বর শুরু হওয়া দরপতন প্রায় টানা চলে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ সময়ে তালিকাভুক্ত ৩০২ শেয়ারের মধ্যে ২০৪টিই দর হারায়। এতে ডিএসইএক্স এ সময়ের সর্বোচ্চ অবস্থান ৬৩৬০ পয়েন্ট থেকে ১৬ জানুয়ারি ৬০২৯ পয়েন্টে নামে। সূচকটির পতন হয় ৩৩১ পয়েন্ট বা সোয়া ৫ শতাংশ। তবে সবচেয়ে কমেছে লেনদেনের পরিমাণ।

গত নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার বেশি শেয়ার কেনাবেচা হয়। চলতি জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে এসে তা ৪০০ কোটি টাকার নিচে নেমেছে। গতকালও দুই শেয়ারবাজারে মোট ৩৮৬ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে।

কেন অস্থিরতা : বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবি দুই হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করতে যাচ্ছে- এমন গুজব দিয়ে বর্তমানের অস্থিরতার শুরু। আবার আসন্ন মুদ্রানীতিতে ব্যাংকের ঋণ-আমানত সীমা (এডিআর) একবারে সাড়ে ৪ শতাংশ কমানো হবে বলে এ মাসের শুরুতে ব্যাংকগুলোকে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই দুই ইস্যুর কারণে বড় বিনিয়োগকারীরা দরপতনের আশঙ্কা থেকে নিজের পুঁজি রক্ষায় আগেভাগে শেয়ার বিক্রি করেছেন, যা সাম্প্রতিক দরপতনকে ত্বরান্বিত করেছে।

সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেয়ারবাজারেরই কিছু স্বার্থান্বেষী মহল আইসিবির শেয়ার বিক্রি ও মুদ্রানীতির ইস্যুকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে দরপতনকে উস্কে দিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য শেয়ারদর আরও কমিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে শেয়ার কিনে নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করা। তারা এমনও গুজব ছড়িয়েছে- ডিএসইএক্স সূচক ৫৮০০ পয়েন্টে নামবে।

ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক সমকালকে বলেন, এডিআর কমানো বা না কমানো নিয়ে নানামুখী খবর রয়েছে। এ কারণে অনেকেই অপেক্ষায় থাকতে চান। তবে সার্বিকভাবে এ ইস্যুটি শেয়ারবাজারে গুমোট অবস্থা তৈরি করে রেখেছে বলে জানান তিনি। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইস্যুতে কিছু দিন পর পরই শেয়ারবাজারে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে নানা সময়ে উদ্বেগ জানানো হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। কমিশন মনে করে, এর স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আইসিবির শেয়ার বিক্রি নিয়ে অতিরঞ্জিত তথ্য : সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইসিবির ২ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রির তথ্য সত্য নয়। আইসিবির কাছে গত বছরের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানার চার ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও বিডিবিএলের মোট আমানত ছিল ২ হাজার ৮১০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, অগ্রণীর ৮২০ কোটি টাকা, জনতার ১৯০ কোটি টাকা এবং বিডিবিএলের ১০০ কোটি টাকা। তবে সম্প্রতি সোনালী ও অগ্রণীকে প্রায় আড়াইশ' কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে আইসিবি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ২০১৪ সালের এক সার্কুলার অনুযায়ী কোনো ব্যাংক একক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তার মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ঋণ বা আমানত দিতে পারে। আইসিবির কাছে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের সীমা অতিরিক্ত আমানত রয়েছে যা সমন্বয়ের জন্য বলা হয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত জুন পর্যন্ত আইসিবির কাছে অগ্রণী ও সোনালীর মোট ছিল ২ হাজার ৫২১ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে সীমাতিরিক্ত রয়েছে ১ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের সীমাতিরিক্ত প্রায় ৭৬৯ কোটি টাকা এবং এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ৭৪৩ কোটি টাকা। তবে জনতা ও বিডিবিএলের আমানত আইনি সীমায় আছে। এখানে সমন্বয়ের দরকার নেই। জনতা থেকে আরও প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আমানত নেওয়ার সুযোগ আছে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সীমাতিরিক্ত আমানত ফিরিয়ে নিতে বলেছে। আইসিবিও ইতিমধ্যে ১০০ কোটি টাকা দিয়েছে। বাকি ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মধ্যে ৫০০ কোটি টাকার একটি মেয়াদি আমানতের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ওই টাকা ফেরত দিতে চিঠি পাঠানো হবে। আইসিবি সময় চাইলে এবং তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সায় থাকলে সোনালী ব্যাংকও তা বিবেচনা করবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংশ্নিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কথা বলার পরামর্শ দেন। সংশ্নিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এখনই ফেরত দিতে হলে আইসিবিকে বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করতে হবে- এমন যুক্তি দেখানোয় শেয়ারবাজারের সংবেদনশীলতা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানটিকে আরও সাত থেকে আট মাস সময় দেওয়া হয়েছে। আইসিবি চাইলে এ সময়ের মধ্যে অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে আমানত নিয়ে এই সমন্বয়ের কাজটি শেষ করতে পারবে। এতে শেয়ারবাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে না।

সর্বশেষ প্রান্তিকে অর্থাৎ গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আইসিবি সর্বমোট ৯৮২ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। আবার একই সময়ে কিনেছে ৭৫৯ কোটি টাকার শেয়ার। অর্থাৎ, এই তিন মাসে নিট ২৫৩ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে নিট বিক্রি ছিল ১০০ কোটি টাকার শেয়ার। চলতি জানুয়ারির পুরো হিসাব না পাওয়া গেলেও আইসিবি বিক্রির তুলনায় কিনেছে বেশি।

এ বিষয়ে আরও জানতে আইসিবির এমডি ছানাউল হকের সঙ্গে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, সরকারি-বেসরকারি মিলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আইসিবির কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত আছে। এর মধ্যে শুধু সোনালী ও অগ্রণীর আমানত বেশি। শেয়ারবাজারে সংকট তৈরি না করেই কী করে অতিরিক্ত আমানত ফেরত দেওয়া যায়, তা নিয়ে আইসিবি কাজ করছে বলে জানান তিনি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, এরই মধ্যে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন। সচিব জানিয়েছেন, অতিরিক্ত আমানত ফেরত দিতে আইসিবিকে সময় দেওয়া হয়েছে।

মুদ্রানীতির প্রভাব : বছরের শুরুতে দরপতনে নতুন মাত্রা যোগ করে এডিআর কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগাম ঘোষণা। মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে লাগাম টানতে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য বিদ্যমান এডিআর ৮৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৮০ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ থেকে ৮৮ শতাংশে নামানো হবে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এ খবর প্রকাশের পর আবার শুরু হয় দরপতন।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে এডিআর ইস্যুতে নমনীয় সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে এডিআর সর্বোচ্চ ২ শতাংশ কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আজ সেই মুদ্রানীতি ঘোষণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান পরিস্কার হওয়া যাবে।

 

http://samakal.com/economics/article/18011451