২৬ জানুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪৩

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সংশয় বাড়ছে

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সংশয়-অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকার অভিযোগ এ নিয়ে ফের ‘ব্লেমগেম’ শুরু করেছে মিয়ানমার। দেশটির প্রতি অব্যাহত
আন্তর্জাতিক চাপ এবং বাংলাদেশের ‘ছাড় দেয়ার মানসিকতা সম্পন্ন’ নানামুখী উদ্যোগে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু পদ্ধতিগত জটিলতায় শেষ মুহূর্তে এসে এটি অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে গেছে বলে ধারণা দিচ্ছেন প্রক্রিয়াটি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণকারী সরকারি-বেসরকারি দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা। তারা এ-ও বলছেন, বর্মী বাহিনীর বর্বর নির্যাতনে রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশি-বিদেশি কতিপয় এনজিও’র অতি উৎসাহও প্রত্যাবাসনকে প্রলম্বিত করছে! অবশ্য সংশয়, অনিশ্চয়তা বা জটিলতার কথা স্বীকার করলেও সরকারের প্রতিনিধিরা এখনই হাল ছাড়তে নারাজ। তারা বরাবরের মতো ‘টেকসই’ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে চলেছেন।

কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, গোড়ায় গলদ রেখে সই হওয়া দ্বিপক্ষীয় অ্যারেঞ্জমেন্টের কারণে পরবর্তীতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের টার্মস অব রেফারেন্স এবং ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট সই করতে গিয়েও অনেক ছাড় দিতে হয়েছে ঢাকাকে। আর এ জন্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা নিয়ে প্রশ্ন বা সংশয় দেখা দিয়েছে। সংস্কারের উদ্দেশ্যে সমালোচনাকারী বোদ্ধারা বলছেন, কয়েকটি বিষয় এখনো অমীমাংসিত থাকায় আখেরে বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশকেই টানতে হবে। তারা প্রশ্ন তুলছেন ভেরিফিকেশন বা যাচাই-বাছাই নিয়ে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সই হওয়া ৩৩ দফা চূড়ান্ত চুক্তি ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টের’ ১৯তম দফায় যাচাই-বাছাইয়ে একতরফাভাবে মিয়ানমারকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তারা যাদের স্বীকৃতি দেবে কেবল তারাই প্রত্যাবাসন যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মিয়ানমার যাদের ‘না’ বলবে তাদের ফেরত যাওয়ার পথ আপাতত বন্ধ হয়ে যাবে। তারা বাংলাদেশেই থাকবে। দ্বিতীয়ত: যাচাই-বাছাই’র জন্য মিয়ানমার যেভাবে তথ্য চেয়েছে, তাদের নির্ধারিত ফর্মেই বাংলাদেশকে তথ্য সরবরাহ করতে হবে। একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে ইউনিট ধরে নতুন করে তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এতেও জটিলতা আছে। মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকার একাধিক নাম রয়েছে। রোহিঙ্গারা যে নামে একটি এলাকার পরিচায় দেয়, বার্মিজদের কাছে তার অন্য নাম রয়েছে। ফলে নাম সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারণেও অনেক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অযোগ্য বা নাকচ করতে পারে মিয়ানমার। তাছাড়া এখানে আগ্রহী, অনাগ্রহী সব রোহিঙ্গা পরিবারেরই তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রশ্ন ওঠেছে ওই তথ্য-ফর্ম পূরণ এবং হস্তান্তরের পর তা যাচাই-বাছাইয়ে সর্বোচ্চ দু’মাস সময় নিতে পারবে মিয়ানমার। দু’মাস পর তারা যাদের যোগ্য বলে সার্টিফিকেট দেবে তাদের ফেরানোর জন্য প্রস্তুত করবে বাংলাদেশ। কারণ চুক্তি মতে, যাচাই-বাছাইয়ের পর মিয়ানমার যাদের ফেরাতে রাজি হবে সেই সব রোহিঙ্গা পরিবারকেও ফিরে যেতে আগ্রহী হতে হবে। এতে কোনো অবস্থাতেই জোর করা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে প্রত্যাবাসন বিরোধী ক্যাম্পেইন চলছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের তরফেও রাখাইন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় বিশেষ করে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা, অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদের ফেরত পাঠানোর তাগিদ রয়েছে। কোন অবস্থাতেই রোহিঙ্গাদের ফের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না বলে মনে করছে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সমপ্রদায়। সরকারের তরফে অবশ্য প্রত্যাবাসন বিরোধী রোহিঙ্গাদের উস্কানি দেয়ার জন্য কতিপয় এনজিও’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানানো হয়েছে। উদভূত পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসন বিরোধী মনোভাব আরো চাঙ্গা হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সমালোচকদের ব্যাখ্যা আরো এক ধাপ এগিয়ে। তারা বলছেন, রাখাইন পরিস্থিতির উন্নতি দৃশ্যমান হওয়ার আনুষ্ঠানিক তথ্য ঢাকাকে সরবরাহ করার শর্ত রয়েছে দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তিতে। কিন্তু মিয়ানমার এখনো তা করেনি। মিয়ানমারের তরফে তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার দেয়ার ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখলে অবশ্য রোহিঙ্গারা ফিরতে আস্থা পাবেন। তার আগে নয়। মিয়ানমার যেসব পরিবারকে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক হবে তা যদি স্বেচ্ছায় না ফিরে তাতেও প্রত্যাবাসন আটকে যেতে পারে! তৃতীয়ত: অযাচিত প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয়া বা অনাথ রোহিঙ্গা শিশুদের ক্ষেত্রে জটিলতার আশংকা! এ প্রক্রিয়াটি সবচেয়ে জটিল। চুক্তি মতে, এসব শিশু যে পরিবারে থাকবে তাদের আদালতের সনদ প্রয়োজন হবে। অনাথ শিশুদের বিষয়েও তা প্রয়োজ্য হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বর্তমানে মিয়ানমারের ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা থাকলেও বিদ্যমান চুক্তি মতে, ২০১৬ সালের অক্টোবরের পরে আসা ব্যক্তিদের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে। বাকিদের বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা হতে পারে বা বিবেচনায় আসতে পারে। ২০১৬ সালের পরে আসা প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে আলোচনা হলেও বাকিদের আপাতত বাংলাদেশেই থাকতে হচ্ছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=102155